নিউজ়িল্যান্ডের প্রতিটি কোণে লেবার পার্টির রক্তিম আভা ছড়াইয়া দিলেন প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডের্ন। সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনে ৪৯ শতাংশ ভোট পাইয়াছে আর্ডের্নের দল, ১৯৫১ সালের পর এই রূপ ভাল ফল কাহারও হয় নাই। ১৯৯৬ সালে নূতন নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরে এই প্রথম নিউ জ়িল্যান্ডে কোনও দল একক ভাবে সরকার গঠন করিতে সমর্থ হইতেছে। এই নির্বাচনে আক্ষরিক অর্থেই দেশের সকল শ্রেণির মানুষ— ধনী শহুরে এলাকা হইতে রক্ষণশীল কৃষি অঞ্চল— লেবার পার্টিকে সমর্থন করিয়াছেন। বহু যুগের সকল রাজনৈতিক পাটিগণিত ওলটপালট হইয়া গিয়াছে। অভূতপূর্ব জয়ের পরেও আর্ডের্ন এই ফলাফলকে কেবল ‘বলিষ্ঠ’ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। নিশ্চিত রূপেই ন্যূনোক্তি। যদিও আর্ডের্নের কর্মপদ্ধতিই এই রূপ, এবং এই রূপেই তিনি বিগত তিন বৎসরে একাধিক কঠিন সঙ্কট সামলাইয়াছেন। তাঁহার প্রবল প্রতিপক্ষও স্বীকার করিবেন, বিনম্র ও অকপট ভঙ্গিতে সরাসরি বাক্যালাপেই জনতার মন জয় করিয়াছেন প্রধানমন্ত্রী।
লেবার পার্টির এই অসামান্য ফলাফলকে তাহাদের আদর্শের জয় অপেক্ষা প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সাফল্য বলিয়া উল্লেখ করাই বিধেয়। আর্ডের্ন ক্ষমতায় আসিবার পরেই নিউ জ়িল্যান্ডের ইতিহাসে ভয়ানকতম সন্ত্রাসবাদী হামলাটি হয়, এক সর্বনাশা অগ্ন্যুৎপাত ঘটে এবং আসে কোভিড-১৯ অতিমারি। টালমাটাল পরিস্থিতিতে মানুষে মানুষে অবিশ্বাস জন্মায়, তৎকালে দেশবাসীর একতা ধরিয়া রাখা সহজ নহে। বিপদকালে সেই কর্তব্য অনমনীয় ভাবে করিয়া গিয়াছেন আর্ডের্ন। অতএব, সাফল্যও মুখ ফিরাইয়া থাকে নাই। কঠোর হাতে অতিমারি নিয়ন্ত্রণ করিয়াছেন, নিশ্চিত করিয়াছেন যাহাতে স্থানীয় সংক্রমণ না ঘটে, দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরিতে পারিয়াছেন নিউ জ়িল্যান্ডের জনতা। ইহা সত্য যে, তাঁহার দেশে জনসংখ্যার আধিক্য কিংবা অপরাপর সমস্যা স্বল্প, সামাজিক বৈচিত্র বা বৈষম্যও বিশেষ নাই, কিন্তু তাহাতে দক্ষ প্রশাসকের কৃতিত্ব কিছুমাত্র খর্ব হয় না। রাষ্ট্রপ্রধানেরা করোনাভাইরাসের সম্মুখে যে ভাবে নাকানিচোবানি খাইতেছেন, তাহাতে নিউ জ়িল্যান্ডকে উদাহরণ বলিয়া চিহ্নিত করা বাঞ্ছনীয়।
জনতার জন্য কাজ করিলে জনতাও যে নেতাকে কিছু ফিরাইয়া দিবে, এই নির্বাচনের ফলাফল তাহার পাথুরে প্রমাণ। এই প্রসঙ্গে আর্ডের্নের বিজয় বক্তৃতার কিয়দংশ উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি জানাইয়াছেন, একে অপরের দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বীকার করিবার যোগ্যতা ক্রমে ক্রমে হারাইয়া ফেলিতেছে মানুষ। নিউ জ়িল্যান্ডবাসী আপনাদের ব্যতিক্রমী প্রমাণ করিতে উৎসুক— জাতি হিসাবে তাঁহাদের শুনিবার সহনশীলতা আছে। এবং, তাঁহাদের শাসনাধীন প্রত্যেক নাগরিকের দল হইয়া উঠিবে লেবার পার্টি, ইহাও অঙ্গীকার করিয়াছেন বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী। বিশেষজ্ঞদেরও অনুমান, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করিবার ফলে আর্ডের্নের আর কোনও রক্ষণশীল জোটসঙ্গীর দরকার না পড়িলেও মধ্য-দক্ষিণপন্থী যে ভোটারেরা তাঁহাকে সমর্থন করিয়াছেন, তাঁহাদের পরিত্যাগ করিতে চাহিবেন না তিনি। সঙ্কটমোচনের কালেই বোঝা গিয়াছে, কতখানি নীরবে এবং কতখানি দৃঢ়চিত্তে কাজ করিতে সক্ষম তাঁহার নেতৃত্বাধীন সরকার। সকল নাগরিককে সঙ্গে লইয়া চলিবার ইচ্ছা না থাকিলে যে দক্ষতা অর্জন অসম্ভব।