Advertisement
E-Paper

বলিউড যখন বিদ্রোহী

সকালে কাগজ খুললে মাঝেমধ্যেই আলিয়া ভট্টর ছবি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, নানান ভঙ্গিমায়। একটা ছবি তো গত মার্চে বার তিনেক বেরল বাংলা ইংরেজি দু’রকম দৈনিকেই।

শিলাদিত্য সেন

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০

সকালে কাগজ খুললে মাঝেমধ্যেই আলিয়া ভট্টর ছবি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, নানান ভঙ্গিমায়। একটা ছবি তো গত মার্চে বার তিনেক বেরল বাংলা ইংরেজি দু’রকম দৈনিকেই। টি শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আলিয়া, তাতে লেখা: এফ ফর ফেমিনিস্ট। অনেকেরই প্রশ্ন, বিনোদনে চোবানো বলিউডের ছবি, সেখানে আবার ফেমিনিজম নিয়ে টানাটানি কেন? মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মাস বলেই?

আমাদের খেয়ালই থাকে না, বলিউড যতই বিনোদনের ঘেরাটোপে থাকুক, সে যখন কোনও নায়িকাকে আইকন করে তোলে, তাঁকে তখন সামাজিক ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতেই হয়। নিজের গায়ে ‘ফেমিনিস্ট’ ছাপ্পা মারা টি শার্ট চাপানোকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন আলিয়া, পর পর তাঁর অভিনীত স্বাধীনচেতা কিছু চরিত্রের ভিতর দিয়ে। যেমন হাইওয়ে বা ডিয়ার জিন্দেগি। দু’টি ছবিতেই নিজের শর্তে বাঁচতে চান আলিয়া, মেয়ে হয়ে বাঁচার যাবতীয় প্রতিকূলতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে। দু’টি ছবিতেই তিনি বেপরোয়া, এমনকী আক্রমণাত্মকও। ডিয়ার জিন্দেগি-তে তো কাউকে নাকই গলাতে দিতে চান না নিজের পেশায় বা ব্যক্তিগত জীবনে। হালফিল বদরিনাথ কী দুলহনিয়া আবার রীতিমতো থাপ্পড় পণপ্রথায় অভ্যস্ত পুরুষের গালে।

আমাদের মধ্যে বড় একটা শিক্ষিত অংশের বিশ্বাস, পপ্রথা প্রায় নাকি উঠেই গেছে এ দেশ থেকে। বাস্তবটা অবশ্য অন্য রকম। অরিজিতা দত্ত, পারমিতা চক্রবর্তী, রুচিরা গোস্বামী, স্বাতী ভট্টাচার্য সম্প্রতি জানিয়েছেন, ‘আশির দশকে বছরে গোটা পাঁচশো মেয়ে মরত পণের কোপে, নব্বইয়ের দশকের শেষে তা দাঁড়ায় বছরে ছ’হাজার, এখন তা বছরে প্রায় আট হাজার।’ (৯ মার্চ, আনন্দবাজার)। বদরিনাথ... ফিল্মে আলিয়া-র চরিত্রটি, বৈদেহী, বিয়ের রাতে পালিয়ে গিয়েছিল, পরে যখন তার হবু বর বা প্রেমিক বদরি পালানোর কারণটা জানতে চায়, বৈদেহী বলে— তুমি কেন তোমার বাবাকে আটকাওনি পণ নেওয়া থেকে?

পণপ্রথার বিরোধিতাতেই ক্ষান্ত থাকেনি এ ছবি, প্রতিটি মেয়ের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বার্তাতে পৌঁছতে চেয়েছে। এই স্বাবলম্বনের ব্যাপারটা, বিশেষত মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা প্রায়-অচ্ছুৎ বলিউডি ফিল্মে। পেশায় সফল হওয়ার জন্যে বহু দূর যেতে প্রস্তুত, এমন মেয়েরা সাধারণত বলিউডের ছবিতে মুখ্য হয়ে ওঠে না। যদি বা সে রকম উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়ে ঠাঁই পায় ছবিতে, তার বাইরের কাজকর্মেই জুড়ে রাখে বলিউড, অন্দরমহলে আসতেই দিতে চায় না। যেন কাজখ্যাপা মেয়েকে কোনও পুরুষ ভালবাসতেই পারে না, যদি-বা বেসে ফেলেও, বিয়ে করা দূর অস্ত্।

এই দশকের শুরু থেকেই ও রকম পেশায় যুক্ত অথচ পর্যুদস্ত মেয়েদের নিয়ে একের পর এক ছবি। ডার্টি পিকচার্স, হিরোইন, যব তক হ্যায় জান, বম্বে ভেলভেট, সুলতান... তনু ওয়েডস মনু রিটার্নস-এ কঙ্গনা রানাউত-এর দ্বৈত চরিত্রের কথা ভাবুন, তুখড় অ্যাথলিট দাত্তো প্রেমিকের মন পেতে সুন্দরী তনুর কাছে হেরে যায়। তনুর রূপ ছাড়া আর কিছু নেই, কোনও কাজকর্মই নেই। এই পেশাহীন প্রেমাস্পদকেই বউ হিসেবে ভারী পছন্দ বলিউডের পুরুষের।

নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে এমনটাই চলে আসছে, পেশাহীন মেয়েদের অনবরত বিবাহ-মাতৃত্বে বেঁধেছে বলিউড। একমুখী প্রেমে গদগদ জীবনে পেশা যেন উৎপাত। অন্য স্বরও কি নেই? আছে, অনুপাতে কম হলেও, তার শুরুও নতুন শতকেই। সালাম নমস্তে, কভি আলবিদা না কহেনা, লাভ আজকল, জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা, দিল ধড়ক্‌নে দো, বেফিকরে-র মতো ছবিতে কর্মব্যস্ত মেয়েদের দেখা যাচ্ছে। তবে পেশার স্বাধীনতা পেতে মেয়েদের মুক্তি খুঁজতে হচ্ছে বিদেশের মাটিতে! কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে বদরিনাথ...-এ বৈদেহীর মতো আদ্যন্ত দেশি কাজপাগল মেয়ে খুব-একটা চোখে পড়ে না। দমবন্ধ বাঁচা থেকে মুক্তি পেতে, বাবাকে বরপণ দেওয়া থেকে মুক্তি দিতে উত্তরপ্রদেশ ছেড়ে চাকরির খোঁজে মুম্বই চলে যায় সে। বিমানসেবিকার চাকরি নেয়। পেশা অক্ষুণ্ণ রাখার শর্তে বদরিকে বিয়ে করে। বিয়ের পর সিঙ্গাপুরে দু’বছর চাকরি করে টাকা জমিয়ে উত্তরপ্রদেশে শ্বশুরবাড়ি ফিরে এসে ব্যবসা শুরু করে। তার এই উদ্যোগ তার বড় জা উর্মিলাকেও নিজের পেশার স্বীকৃতি এনে দেয়। বৈদেহী বা উর্মিলাকে দেখে মেয়েদের কর্মশ্রম বা পেশাকে সম্মান করতে শেখে বদরি।

এটাই আবার নতুন প্রজন্মের পুরুষের লক্ষণ। এত কাল ভারতীয় নারীপুরুষের মধ্যে যে হায়ারার্কি, যেখানে নারী বাধ্যত অনুগত থাকত পুরুষের, সেখান থেকে সরে আসছে নতুন প্রজন্ম। আজকের নতুন নারীর জন্যে পুরুষকেও নতুন ভাবে প্রস্তুত হতে হবে, পরিবার বা বিবাহপ্রথায় বদল আনতে হবে, পালটাতে হবে মূল্যবোধ।

নারীদিবসের মাসে যখন রমরমিয়ে চলছিল ছবিটি, ঠিক তখনই উত্তরপ্রদেশের শাসনভার চলে গেল রক্ষণশীল রাজনীতির কব্জায়, যে রাজনীতি কখনওই মনে করে না, নারী আর পুরুষ সমান। বৈদেহীর সূত্রে আলিয়া-র আইকন হয়ে ওঠা সেই ধারণারই বিরুদ্ধাচরণ। প্রগতিপন্থী রাজনীতিকরা একটু ভেবে দেখুন, আপনাদের বাঁধা বুলির চাইতে বলিউডের ফর্মুলা-ফিল্ম বোধ হয় কখনও কখনও বেশি শক্তিশালী।

Feminism Bollywood
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy