Advertisement
E-Paper

বেদনার পরিমাপ

সুখ বা দুঃখ মাপিবার সমীকরণ বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিবার বা গম্ভীর আলোচনাচক্রে তাহা উপস্থাপিত করিবার তৃপ্তি অবশ্যই রহিয়াছে, কোনও এক স্তরে সেইগুলি গৃহীত হইলে নিশ্চয় ইহাদের ব্যবহারিক উপযোগিতার কথাও ভাবা যাইতে পারে।

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৮ ০১:১৬

ইদানীং সুখ মাপা হইতেছে, স্বাচ্ছন্দ্য মাপা হইতেছে, বুদ্ধ্যঙ্কের ন্যায় আবেগের অঙ্কও মাপা হইতেছে, কিন্তু তাহা বলিয়া নির্যাতিতার বেদনার পরিমাপ? এবং সেই অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ হিসাব? ইহা আধা কল্পবিজ্ঞান আধা কৌতুক-নকশা মনে হইতে পারে, কিন্তু বাস্তবে আমাদের রাজ্যে এই উদ্ভট কাণ্ডটি অনুষ্ঠিত হইতেছে। ভিন্ন রাজ্যের যৌনপল্লিতে পাচার হইয়া যাওয়া এক কিশোরী পলাইয়া আসেন, তাঁহার ক্ষতিপূরণের জন্য পুলিশ ফাইল প্রেরণ করে জেলার লিগাল সার্ভিস অথরিটি (ডালসা)-র নিকট। কিন্তু ‘মেডিক্যাল ট্রমা’-র মাত্রা জানিতে চাহিয়া ফাইল ফেরত আসিয়াছে। এক জন মানুষকে প্রহার করিলে, তিনি কত একক মানসিক অাঘাত পাইলেন, তাহা কি আদৌ পরিমাপ করা সম্ভব? এক কিশোরীকে পাচার করিবার পর তাঁহার যে ভীতি, অসহায়তা, তাঁহার উপর যৌন নির্যাতন চালাইলে তাঁহার যে তীব্র যন্ত্রণা, অপমান, আত্মঘৃণা, সর্বনাশের বোধ, সামাজিক অসম্মানের আশঙ্কা ও সেই অসম্মানের শিকার হইবার পর যে গ্লানি— তাহার পরিমাপ সম্ভব? একই আঘাত ভিন্ন ব্যক্তির হৃদয়ে ভিন্ন প্রভাব বিস্তার করিতে পারে। এমনকি ব্যক্তির নিজের পক্ষে হিসাব করা কঠিন, সে কত আঘাত পাইয়াছে। হয়তো কেহ ভাবিল, নিদারুণ নিপীড়নে তাহার হৃদয়ের তেমন ক্ষতি হয় নাই, পরে মনস্তত্ত্ববিদ আবিষ্কার করিলেন, ওই পরিস্থিতির ফলে তাহার ক্রোধ বিরক্তি বিপন্নতা অসহিষ্ণুতা বহু গুণ বাড়িয়া গিয়াছে, উৎসটি গুলাইয়া গিয়াছে মাত্র। মানুষের মন অতি জটিল, তাহাকে বিশ্লেষণ ও ব্যবচ্ছেদের প্রয়াস জরুরি, কিন্তু তাহা বলিয়া চরম বিপর্যয়ের পর তাহার বেদনা মাপিবার স্পর্ধা অভূতপূর্ব। গত বৎসর রাজ্য সরকার তালিকা করিয়াছে, কোন ক্ষেত্রে নির্যাতিতা কত ক্ষতিপূরণ পাইবেন। উহা মানিলেই আপাতত কিছু মানুষকে স্বস্তি ও সহায়তা দান করা যাইতে পারে।

সুখ বা দুঃখ মাপিবার সমীকরণ বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিবার বা গম্ভীর আলোচনাচক্রে তাহা উপস্থাপিত করিবার তৃপ্তি অবশ্যই রহিয়াছে, কোনও এক স্তরে সেইগুলি গৃহীত হইলে নিশ্চয় ইহাদের ব্যবহারিক উপযোগিতার কথাও ভাবা যাইতে পারে। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, নির্যাতিতাকে ক্ষতিপূরণ প্রদান কোনও বায়বীয় বস্তু নহে, কোনও দুর্দান্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য আলোচনার মগজ-ব্যায়ামের উপর নির্ভর করিয়া থাকিলে তাহার চলিবে না। ‘‘তৈলাধার পাত্র না পাত্রাধার তৈল’’ এ রূপ তর্কে ইহাকে বদ্ধ রাখিলে, মূল সামাজিক কল্যাণেচ্ছাটিই ব্যাহত হইবে। যাঁহার মুখ অ্যাসিডে পুড়িয়া বিকৃত হইয়া গিয়াছে, যে শিশুকে দিনের পর দিন যৌন নির্যাতন করা হইয়াছে, তাঁহাদের ক্ষতি আদৌ কখনও পূরণ হইবে কি না তাহা নির্ণয় দুষ্কর, তাহার উপর যদি সামান্য আর্থিক ক্ষতিপূরণটুকু দিবার প্রক্রিয়াও এমন ভাবে থামিয়া যায়, সেই সাহায্যটুকুও তাঁহাদের নিকট না পৌঁছায়, তবে তাহা অতীব দুর্ভাগ্যজনক। এমনিতেই এই দেশে এই রাজ্যে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে নহে, প্রকাশ্যে সরবে রোদন করে, এবং তাহা লইয়া বিশেষ হেলদোল লক্ষ করা যায় না। আজ সমগ্র বিশ্বে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গর্জন উঠিয়াছে, সচেতনতা বহু গুণ বর্ধিত হইয়াছে, সেই প্রেক্ষিতে এই ক্ষতিপূরণ প্রত্যাখ্যানকে, উদ্ভট যুক্তিতে ন্যায়বিচার কর্তন বলিয়া মনে হয়। নির্যাতিতারা দ্বিতীয় বার বঞ্চিত হইলে, সেই দুর্ভাগ্যের পরিমাপ সম্ভব নহে!

Financial compensation oppressed consolation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy