Advertisement
E-Paper

নষ্ট শসা, পচা চালকুমড়োর...

হিমন্তবিশ্ব শর্মাই যে কেবল কর্মফলের দোহাই দিয়েছেন তা নয়, অতীতে এমন উদাহরণ তো আরও আছে। ‘ধ্রুপদী’ উদাহরণ মহাত্মা গাঁধীর জীবন থেকেই দেওয়া যায়।

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৭ ০১:০৩

হিমন্তবিশ্ব শর্মা বলেছেন, তিনি নতুন কথা বলেননি। হক কথা। অসমের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী তিনি। ‘প্রাচীন জ্ঞান’ ‘সনাতন ধর্ম’ তাঁর নখদর্পণে। কাজেই কর্মফল ভোগের কথা বলে তিনি এমন কী আর ভুল করেছেন! অনন্ত কর্মের চাকা ক্রমান্বয়ে ঘুরছে। ঘর্ঘর করে শব্দও বোধহয় হচ্ছে। সেই কর্মফলের চাকার শব্দ সবাই শুনতে পাচ্ছেন না এই যা! মন্ত্রী মশাই পেয়েছেন। সাবধানও করে দিয়েছেন। জননায়ক হিসেবে তাঁর ‘যোগ্য’ কাজ! প্রতি মুহূর্তে কর্মচক্রের ঘূর্ণনে নির্দিষ্ট হয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা। আপনি কি ক্যানসারে আক্রান্ত? তা হলে আপনি অথবা আপনার পূর্বতন কোনও পুরুষ বা রমণী মহাপাপ করেছিলেন। হিসেবনিকেশ করে সেই পাপের ফলে আপাতত আপনাকে কোনও দৈবশক্তি রোগাক্রান্ত করেছেন। পাপের ফল ভোগ করবেন না?

হিমন্তবিশ্ব শর্মাই যে কেবল কর্মফলের দোহাই দিয়েছেন তা নয়, অতীতে এমন উদাহরণ তো আরও আছে। ‘ধ্রুপদী’ উদাহরণ মহাত্মা গাঁধীর জীবন থেকেই দেওয়া যায়। ১৯৩৪ সাল। বিহার প্রবল ভূমিকম্প কবলিত। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ‘মরণ দোল’ গল্পে সেই ভূমিকম্পের বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘আকাশ এখনো রক্তাভ ধূলায় আচ্ছন্ন হইয়া আছে। নীচে, উইঢিবির উপর উইয়ের মত অসংখ্য লোক ইটের স্তূপের উপর ঘুরিয়া বেড়াইতেছে , প্রিয়জনের নাম ধরিয়া ডাকিতেছে, উচ্চৈস্বরে চিৎকার করিয়া কাঁদিতেছে।’ এই যে মানুষ বিপুল প্রকৃতির কাছে উইয়ের মতো তুচ্ছ ক্ষুদ্র, তা মহাত্মা গাঁধীকে বিশেষ নৈতিকতার উপলব্ধিতে আন্দোলিত করেছিল। মনে হয়েছিল তাঁর, খরা বন্যা ভূমিকম্প, এ সবের প্রত্যক্ষ কারণ হয়তো আছে, কিন্তু এ সবের সঙ্গে মানুষের নৈতিক স্খলনের যোগ গভীর। বিহারের ভূমিকম্প নাকি ‘ডিভাইন চাসটিসমেন্ট ফর দ্য গ্রেট সিন’— মহাপাপের ভগবানদত্ত শাস্তি। কোন পাপের ওপর নেমে এল এই বিভীষণ দৈব আঘাত? মহাত্মা মনে করেন হরিজনদের অস্পৃশ্য করে রাখার পাপেই এমন বুঝি হল। কৌতুক করে বলেছিলেন এ কথাও— সনাতনবাদীরা উলটে দাবি করতেই পারেন অস্পৃশ্যতার বিরোধিতা করছেন মহাত্মা, সেই পাপেই এই ভূমিকম্প। অস্পৃশ্যতাই সনাতন বিধি। গাঁধী সনাতন মতের বিরোধী বলে এই প্রলয়। রবীন্দ্রনাথ প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাননি যে এমন কথা বলতে পারেন গাঁধী। আর যদি সত্যিই বলে থাকেন এ কথা তা হলে তিনি নাচার, কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না কর্মফলের এই হেতুহীন দোহাই।

হিমন্তবিশ্ব শর্মা ‘দার্শনিক যুক্তি’র কথা বলেছেন বটে, তবে গাঁধীর মতো নীতি-তাড়িত দার্শনিকতা থেকে কর্মফলের কথা বলেছেন বলে মনে হয় না। গাঁধীর সঙ্গে হিমন্তের মাত্রাগত তুলনা চলে না। তাঁর উদ্দেশ্য অনেক সোজা-সাপটা, সরল। একদা কংগ্রেসের এখন বিজেপির হিমন্তবিশ্ব তাঁর দেশের আমজনতাকে বিলক্ষণ চেনেন। সনাতন ধর্মকর্মের ভয় দেখালে কাজ হয়। সনাতন ধর্মের তাস ঠিক মতো খেলতে পারলে ভোটে সুফল পাওয়া যায়। তাই তিনি ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের বলেছেন কাজ না করলে পাপ হবে। পাপের নানা রকম ফল। ক্যানসার তেমনই ফল। এককালে তো কুষ্ঠ পাপের ফল বলেই বিবেচিত হত। এখন বিজ্ঞানের কল্যাণে কুষ্ঠের দিন গিয়েছে। ক্যানসার বেশ মহামারির আকার ধারণ করেছে। কাজেই কর্মফলের ভয় যদি দেখাতেই হয়, ক্যানসার দিয়ে দেখানোই ভাল। সে জন্যই তাঁর সৎ স্বীকারোক্তি, ‘নতুন কথা’ তিনি কিছুই বলেননি।

এই দেশে মাঝে মাঝেই মৃতদেহ জমিয়ে রাখার দস্তুর ইদানীং চোখে পড়ে। মৃতদেহটি পচে গেছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। তবু আগলে বসে থাকা, ফেলব না ফেলতে দেব না। কুসংস্কারের দুর্গন্ধও বোধ করি এই দেশে বেশ জনপ্রিয়। হিমন্তবিশ্ব ভারতবর্ষীয় সমাজের যথার্থ প্রতিনিধি। কর্মফলবাদ পুরনো কথা। নতুন নয়। কর্মফলের দোহাই দিয়ে মানুষের এত ক্ষতি করা হয়েছে যে ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখায় পড়েছি আমরা, বংশানুক্রমে বর্ণাশ্রমকে টিকিয়ে রাখার জন্য ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র কর্মফলকে ব্যবহার করেছে। কর্মফলের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে জন্মান্তরবাদ। লোককথার গল্পের সেই নেকড়েটির কথা অবধারিত ভাবে মনে পড়ে, ভেড়ার ছানাটিকে যে বলেছিল, ‘তুই জল ঘোলা করিসনি বটে, তবে তোর বাবা জলঘোলা করেছিল।’ লোককথা প্রাতিষ্ঠানিক বঞ্চনার বিরোধিতা করতে চায়। এই গল্পটিও দাঁত-নখওয়ালা কর্মফলবাদের বিরোধী।

এই কর্মফলবাদের দোহাই দিয়ে হিমন্তবিশ্ব কিন্তু নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে বা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কেউ যদি কাজ না করেন তা হলে তাঁকে কর্মফলের বা পাপের ভয় দেখাতে হবে কেন? ফাঁকিবাজদের সামলানোর জন্য কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা মন্ত্রীর দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালন না করে কর্মফলের দোহাই দেওয়া হাস্যকর। তবে এ দেশে হাস্যকরকে হাস্যকর বলার মতো লোকের সংখ্যা ক্রমশই কমছে। কাজেই ধরে নেওয়া যায় এই কর্মফলের দার্শনিকতায় সনাতনপন্থীরা খুশি হবেন। ভারত আবার পিছন দিকে এগিয়ে গিয়ে সনাতনের গরিমায় স্থবির হয়ে উঠবে।

বিশ্বভারতীতে বাংলা শিক্ষক

Himanta Biswa Sarma responsibility Assam Minister
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy