Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মহাশূন্যের দান

প্রথম তত্ত্বের দাবি ব্রহ্মাণ্ড চিরকাল বিরাজমান, তাহা কোনও এক মুহূর্তে জন্মগ্রহণ করে নাই। আর, বিগ ব্যাং থিয়োরি অনুযায়ী, ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম ১৩৭০ কোটি বৎসর পূর্বে কোনও এক মাহেন্দ্রক্ষণে।

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৯ ০০:৫৩
Share: Save:

ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েল গবেষণার জগতে এক বিচিত্র মানুষ হিসাবে পরিগণিত ছিলেন। অভিনব তত্ত্ব কিংবা অপ্রিয় সত্য কথা বলিতে তাঁহার জুড়ি ছিল না। অপ্রিয় সত্যভাষণ তাঁহার কর্মজীবনেও কুফল প্রসব করিয়াছিল। মহাজাগতিক বস্তু পালসার আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যান্টনি হিউইশ এবং মার্টিন রাইল নোবেল পুরস্কার পান। বাদ পড়েন গবেষিকা জসিলিন বেল। এই অবিচারের প্রতিবাদে মুখর হন হয়েল। নিন্দাও করেন নোবেল কমিটির পুরস্কার নির্বাচনপদ্ধতির। অনেকের ধারণা নোবেল কমিটি সেই নিন্দার প্রতিশোধও লইয়াছিল। ব্রহ্মাণ্ডে উপস্থিত হাইড্রোজেন হিলিয়ামের ন্যায় কতিপয় মৌল বাদ দিলে আর সকলই (এমনকি মানবদেহে বিদ্যমান নাইট্রোজেন বা কার্বনের ন্যায় মৌল) যে দূর-দূরান্তে নক্ষত্রে জন্মিয়াছে— এমত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের মূলে প্রধান ভূমিকা হয়েলের। এতদসত্ত্বেও নোবেল কমিটি তাঁহাকে পুরস্কৃত করে নাই। ১৯৮৩ সালে হয়েলের সহযোগী বিজ্ঞানী উইলি ফাউলারকে উক্ত পুরস্কার দেওয়া হয়। শিষ্টাচারের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া হয়েল অবশ্য ইত্যাকার অবিচারের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন নাই। অনেকের কাছে হয়েলের পরিচয় অধুনালুপ্ত তত্ত্ব স্টেডি স্টেট থিয়োরির প্রবক্তা হিসাবে। উহার পাল্টা তত্ত্ব বিগ ব্যাং থিয়োরি এখন সর্বজনস্বীকৃত।

প্রথম তত্ত্বের দাবি ব্রহ্মাণ্ড চিরকাল বিরাজমান, তাহা কোনও এক মুহূর্তে জন্মগ্রহণ করে নাই। আর, বিগ ব্যাং থিয়োরি অনুযায়ী, ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম ১৩৭০ কোটি বৎসর পূর্বে কোনও এক মাহেন্দ্রক্ষণে। কী রূপে এই ব্রহ্মাণ্ড জন্মিল, তাহা কোনও বিজ্ঞানীই স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারেন না। তাঁহারা কেবল প্রমাণ পান এই ঘটনার যে, ১৩৭০ কোটি বৎসর পূর্বে কোনও মহাবিস্ফোরণ ঘটিয়াছিল, এবং সেই বিস্ফোরণে এই বিশ্ব জন্মলাভ করিয়াছিল। বিজ্ঞানীরা উক্ত বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত না হইবার কারণে ধার্মিকরা ইহার মধ্যে ঈশ্বরের ভূমিকা খুঁজিয়া পান। মজার কথা, ওই মহা-বিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং নামটি কিন্তু হয়েলেরই দেওয়া। ঘোর নাস্তিক হয়েল নিন্দার্থে ওই তত্ত্বের ওই রূপ নাম দিয়াছিলেন। জুতসই শব্দের মহিমা অপার! একদা তাচ্ছিল্য প্রকাশ্যে হয়েল তত্ত্বটিকে যে নামে অভিহিত করিয়াছিলেন, বর্তমানে তাহাই উহার পরিচয়।

বিজ্ঞানী হয়েলের প্রসঙ্গ আসিয়া পড়িল সাম্প্রতিক একটি সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে। খবরে প্রকাশ, মহাশূন্যে ভাসমান ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (আইএসএস)-এর অভ্যন্তরে কতিপয় ব্যাকটিরিয়া পাওয়া গিয়াছে। ব্যাকটিরিয়া সজীব বস্তু, পক্ষান্তরে ভাইরাস নির্জীব। ব্যাকটিরিয়া আপনিই আপনার বংশবৃদ্ধি করিতে পারে, ভাইরাস তাহা পারে না। ভাইরাস পরজীবী, বংশবৃদ্ধি করিতে গেলে উহাদিগকে জীবের স্কন্ধে চড়িতে হয়। আইএসএস-এ ব্যাকটিরিয়ার সন্ধান মিলায় বিজ্ঞানীরা বিস্মিত। তাঁহাদের ধারণা, পৃথিবী হইতে ওই ব্যাকটিরিয়াকুল আইএসএস-এ পৌঁছাইয়াছে। উহাদের বহিয়া নিয়া গিয়াছেন নভশ্চরেরা। কী ভাবে উক্ত বহন সম্ভব হইল, তাহা ভাবিয়া বিজ্ঞানীরা কূল-কিনারা পাইতেছেন না। হায়, হয়েল আজ জীবিত নাই। থাকিলে তিনি বিজ্ঞানীকুলের ইত্যাকার ধন্দ দেখিয়া কৌতুক বোধ করিতেন। পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি বিষয়েও হয়েল চিন্তাভাবনা করিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, এই ব্যাপারে তাঁহার নিজস্ব একটি তত্ত্বও ছিল। পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাবের মূলে বহু পূর্বে কোনও রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া— এই চালু মত হয়েল মানিতেন না। এই ধারণা তাঁহার মতে আজগুবি। এতটা আজগুবি যে, উক্ত প্রকারে পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব মানিলে, ইহাও মানিতে হয় যে, প্রকাণ্ড লোহালক্করের স্তূপের উপর দিয়া ঝড় বহিয়া গেলে, উক্ত স্তূপটি একটি বোইং-৭৩৭ বিমানে পরিণত হইবে! তবে পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব কী প্রকারে? হয়েল বিশ্বাস করিতেন পৃথিবীতে প্রাণ আসিয়াছে মহাশূন্য হইতে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী মহাশূন্যে ভাসমান অবস্থায় ছিল। বৃষ্টির ন্যায় তাহারা পৃথিবীতে পড়িয়াছে। এবং কালে কালে এই গ্রহে প্রাণের বিস্তার ঘটাইয়াছে। মহাশূন্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীরা কী রূপে জন্মাইল, তাহা অবশ্য হয়েল বলেন নাই। সে যাহা হউক, আইএসএস-এ ব্যাকটিরিয়ার উপস্থিতিতে হয়েল বিস্মিত হইতেন না। তিনি বলিতেন, পৃথিবী হইতে নভশ্চরেরা উক্ত ব্যাকটিরিয়াকুলকে আইএসএস-এ বহিয়া লন নাই। মহাশূন্যে বিরাজমান জীবাণুসকল আইএসএস-এ প্রবেশ করিয়াছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE