রামকৃষ্ণ সেবাদল আশ্রম। ছবি:লেখক
‘একটি হনুমেনে কাণ্ড কর দেখি’—কর্মজগতে এই ছিল গোবিন্দপ্রসাদ সিংহের মন্ত্র। দেশপ্রেমী, নিষ্ঠাবান, সদা তৎপর এই গাঁধীবাদী নেতা তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণপুরুষ এখনও জড়িয়ে রয়েছেন বাঁকুড়ার সঙ্গে।
গোবিন্দপ্রসাদের জন্ম গোবিন্দধাম গ্রামে (তৎকালীন কনেমারা গ্রামে)। ১২৯৬ সনের ৯ জ্যৈষ্ঠ। ছোটবেলা থেকেই আর্তের সেবায় নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। ছোটবেলায় রামায়ণের গল্প শুনে হনুমানের সঙ্গে তাঁর যেন সখ্যতা জন্মে গিয়েছিল। হনুমানের গন্ধমাদন পর্বত তুলে নিয়ে আসার ঘটনা তার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। কাজের মধ্যে নিস্তেজ ভাব কখনও বরদাস্ত করতেন না। চাইতেন নিষ্ঠা, সাহস, বীরত্ব ও তৎপরতা। তাই হনুমানের উদাহরণ দিতেন বারবার।
১৩২২ বঙ্গাব্দের আকালের সময় এক ‘হনুমেনে’ কাণ্ডের মধ্য দিয়েই তাঁর নিষ্ঠা, সাহস ও তৎপরতা প্রমাণ করেছিলেন। আকালের সময় বুভুক্ষু মানুষের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দিতে বাবার কাছে নিজেদের পুরনো ধানের গোলা ভাঙার অনুরোধ করেছিলেন। ছেলের সে অনুরোধ সে সময় ফেলে দিতে পারেননি পিতা দিবাকর সিংহ।
ছাত্রাবস্থা থেকেই গোবিন্দপ্রসাদের মনে অঙ্কুরিত হয় দেশপ্রেমের বীজ। বাঁকুড়া ওয়েসলিয়ান কলেজ থেকে বি এ পাশ করেন তিনি। সেই সময় দিবাকর সিংহ ঠিক করেন, এ বার ছেলের হাতে বিষয়-সম্পত্তি দেখাশোনার ভার সঁপে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হবেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের ভাবাদর্শে দীক্ষিত গোবিন্দপ্রসাদ এ বিষয়ে ছিলেন সম্পূর্ণ নিস্পৃহ। তাই পিতার সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায় না নিয়ে নিজেকে নিয়োজিত করেন পল্লির সংস্কার ও শিক্ষার প্রসারে। এই সময় গঙ্গাজলঘাটি এম ই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ নিযুক্ত হন তিনি। যোগদানের সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যালয়ের উন্নতিতে প্রধান শিক্ষকরূপে তাঁর সুনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। পরিচিত হয়ে যান ‘মাস্টার মশাই’ নামে।
তার পর এই ‘মাস্টার মশাই’-এর প্রচেষ্টাতেই গঙ্গাজলঘাটি এমই বিদ্যালয় জাতীয় বিদ্যালয় হিসেবে ঘোষিত হয়। বিদ্যালয়ে বিদ্যার্জনের পাশপাশি, আত্মনির্ভরতার শিক্ষাদানও চলে। বৃত্তিশিক্ষার অঙ্গরূপে ছাত্রেরা শিখতে শুরু করে চরকায় সুতো কাটা, কাপড় সেলাইয়ের মতো কাজ।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে জেলা কংগ্রেসের সভাপতির পদে মনোনীত হন গোবিন্দপ্রসাদ। একই সঙ্গে বিদ্যালয় ও রাজনীতির কাজ সামলানো সম্ভব হচ্ছিল না ‘মাস্টার মশাই’-এর পক্ষে। প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয় কৃষ্ণচন্দ্র চক্রবর্তীর উপরে। এর পর থেকে সংগঠনে পুরোপুরি সময় দেওয়ার সুযোগ পান গোবিন্দবাবু। কখনও হেঁটে আবার কখনও সাইকেলে চেপে ঘুরতে লাগলেন গ্রাম-গ্রামান্তরে। এগিয়ে চলে বাঁকুড়া কংগ্রেসের অভিযান।
এই সময় ঘটে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা। হঠাৎ করে জাতীয় বিদ্যালয়ে সরকারি সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। গোবিন্দপ্রসাদ পড়লেন মহা সমস্যায়। উপয়ান্তর না দেখে ঠিক করেন স্কুল চালানোর জন্য গ্রামে-গ্রামে ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করবেন। অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব সাগ্রহে গ্রহণ করেন আর এক নিষ্ঠাবান কর্মী অমরনাথ চট্টোপাধ্যায়। অমরনাথ তাঁর নিজের গ্রাম কালিকাপুরে গিয়ে গঙ্গার বিস্তৃত চরে লাক্ষা চাষ করে অর্থ জোগাড়ের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। কিছু দিনের মধ্যেই কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন অমরনাথ।
এই ঘটনায় পুত্রবিচ্ছেদ সম যন্ত্রণা পান গোবিন্দপ্রসাদ। পরে অমরনাথের স্মৃতি রক্ষার্থে ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে তৎকালীন ‘মাছরাঙা জঙ্গল’ নামক স্থানে প্রতিষ্ঠা করেন ‘শ্রীরামকৃষ্ণ সেবাদল আশ্রম’ এবং আশ্রমের সংলগ্ন এলাকার নামকরণ করেন ‘অমরকানন’। ১৯২৫ সালের ২ জুলাই এই সেবাদল আশ্রমের দ্বারোদ্ঘাটন করেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী।
গাঁধীর সঙ্গে ছিলেন বাংলার খাদি শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত ও কবি নজরুল ইসলাম। এই আশ্রমেই বসে নজরুল লেখেন, ‘অমরকানন মোদের অমরকানন/ বন কে বলেরে ভাই আমাদের এ তপোবন’ গানটি। আশ্রমের অনতিদূরেই গোবিন্দপ্রসাদ প্রতিষ্ঠা করেন অমরকানন দেশবন্ধু বিদ্যালয়। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে যখন দ্বিতীয় পর্যায়ে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়, তখন অমরকাননের উপরে নজর পড়ে বৃটিশ সরকারের। বাজেয়াপ্ত হয় অমরকানন আশ্রম এবং রাজবন্দি হন গোবিন্দপ্রসাদ।
স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা সমাজ সংস্কারক এই মানুষটি সারদামায়ের শিষ্য। ছাত্রাবস্থাতেই দীক্ষা নিতে ছুটে গিয়েছিলেন সারদা মায়ের কাছে। প্রথম বার ফিরিয়ে দিলেও, দ্বিতীয় বার দীক্ষা দিতে রাজি হন মা সারদা।
বাঁকুড়ার মানুষ গোবিন্দবাবুর স্মৃতি রক্ষার্থে তৈরি করেছে অমরকানন গোবিন্দপ্রসাদ মহাবিদ্যালয়, উখড়াডিহি গোবিন্দপ্রসাদ উচ্চবিদ্যালয়, কনেমারা গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রেখেছে গোবিন্দধাম। এ ছাড়া, বাঁকুড়া শহরে রয়েছে গোবিন্দপ্রসাদ সিংহ রোড।
লেখক বাঁকুড়ার অমরকানন দেশবন্ধু বিদ্যালয়ের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy