নির্মলকুমার বসু এক জন মহীরুহ ছিলেন। গবেষক, শিক্ষক, বক্তা লেখক, সচিব এবং পরিচালক হিসেবে ইতিহাস, ভূগোল, নৃতত্ব, সমাজতত্ত্ব, সমীক্ষা, রাজনীতি, গাঁধীচর্চা, জাতীয়তাবাদ, সাহিত্য, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এ রকম বহু ক্ষেত্রে তাঁর অনায়াস বিচরণ ছিল। বিশ শতকের প্রথম ভাগে এক বিশেষ রকম বহুধাবিস্তৃত বাঙালি মনীষার প্রতিভূ নির্মলকুমার। সেই মনীষা আজ অতীত, বাস্তবে, কল্পনাতেও। তাই নির্মল বসুর লেখা আমাদের পড়া জরুরি। আক্ষেপ, সেই সব লেখার অনেকগুলিই আজ দুষ্প্রাপ্য। অভীক কুমার দে অক্লান্ত পরিশ্রম এবং যত্নে নির্মলকুমারের ডায়রি প্রকাশ করে চলেছেন। ডায়রিগুলি পড়লে এই ‘অবিশ্বাস্য’ মানুষগুলো কী ভাবে দৈনন্দিন যাপন করতেন তার একটা ছবি মেলে।
গাঁধীকে কাছ থেকে দেখেছিলেন একান্ত সচিব নির্মলকুমার। তাই গাঁধীচর্চায় এই ডায়রি এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য। গাঁধীর শেষ বয়সের ব্যাক্তিজীবন বিষয়ে কিছু বিতর্কে এই ডায়রির সাক্ষ্য এক রকম ‘নৈর্ব্যক্তিক সত্য’ তুলে ধরবে, এমনটাই ভূমিকায় লিখেছেন সম্পাদক। সেই কথা মাথায় রেখে কেবল ডায়রি নয়, বিভিন্ন অভিলেখ্যাগার ঘুরে নানা প্রাসঙ্গিক চিঠিপত্র এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ সাজিয়ে দিয়েছেন তিনি। অর্থাৎ গাঁধীচর্চার বৃহত্তর ক্ষেত্রে এই ডায়রির একটা স্থাননির্দেশ করে নির্দিষ্ট একটি পাঠের দিকে পথনির্দেশ করতে চেয়েছেন।
সেই পথে গেলে পাঠক মোটেও নিরাশ হবেন না। গাঁধীর ব্যক্তিগত জীবনচর্যা নিয়ে বেশ কিছু তথ্য আছে এই ডায়রিতে। তাদের সাজিয়ে নির্মলকুমারের লেখা বই প্রকাশ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আপত্তি করেছিলেন। তবে নির্মল বসু দমবার পাত্র ছিলেন না। সেই বই প্রকাশ হয়েছিল। সে কথা সম্পাদকীয় ভূমিকায় আছে।
এই ডায়রি আরও কিছু পাঠে সাহায্য করবে। তার একটা হচ্ছে গবেষক নির্মলকুমারের স্বধর্মচর্চার হিসেব। গবেষণা তাঁর ‘স্বধর্ম’, এ কথা স্বয়ং গাঁধীকে স্পষ্ট করে বলছেন নির্মলকুমার, উনিশশো ছেচল্লিশের শেষে, নোয়াখালিতে, যখন বাংলা দাঙ্গার আগুনে পুড়ছে। গাঁধী তখন একান্ত সচিব নির্মলকুমার এবং আরও ক’জন ঘনিষ্ঠ অনুগামীকে নিয়ে দিনের পর দিন অসুস্থ শরীরে হেঁটে চলেছেন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের সঙ্গে শান্তির আশায় কথা বলছেন। সেই সময়েও নির্মলকুমারকে দ্বিধাহীন প্রশ্ন করার অধিকার দিচ্ছেন গাঁধী।
অগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ডায়রিতে কেবল গবেষক-অধ্যাপক এবং সেখানে বিস্তর পরিবার, আত্মীয়, ছাত্র সুহৃৎ, সম্পাদক প্রকাশকের কথা। প্রতিটি পাইপয়সা খরচের হিসেব, নিজের জন্য কেউ একটা নিউকাট জুতো কিনে দিলে কুণ্ঠাবোধ, অথচ পরিবারের সকলের জন্য উপহার কেনার কথায়, আপদে বিপদে সর্বদা তাঁর ডাক পড়ে। সকালবেলা প্রতিদিন পড়ালেখা, তার পর কখনও পড়ানো, কখনও বক্তৃতা আলোচনা। বহুবিধ মানুষের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত এবং লেখাপড়ার আলোচনা, রাতে খেয়ে ফেরা।
এই ছেচল্লিশেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগ থেকে ভূগোল বিভাগে স্থানান্তরিত হচ্ছেন তিনি। সেই স্থানান্তর কেন ও কী ভাবে, সেই বিষয়ে যা তথ্য রয়েছে, তার সাহায্যে নির্মলকুমারের গবেষণার ইতিহাসের কিছু জট ছাড়ানো যায়। গাঁধী বিষয়ে নিয়মিত লিখছেন, বলছেন। ছোট লেখা, বড় বই তৈরি হচ্ছে। স্টাডিস ইন গাঁধীজম লেখা হচ্ছে। শুরু হচ্ছে হিন্দু সমাজের গড়নের প্রথম খসড়া লেখা। মুন্ডাদের নিয়ে অধ্যায়টি বারবার কেন বদল করছেন? খেয়াল রাখতে হবে হিন্দু সমাজের গড়নই নৃতাত্ত্বিক নির্মলকুমারের সবচেয়ে ‘বড়’ কাজ। আর একটা বিষয়ে সোৎসাহে অনেকগুলো ক্লাস নিচ্ছেন। প্রি-হিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল। সম্প্রতি শেষ করা ওড়িশার মন্দির নিয়ে গবেষণার প্রভাব সেখানে কতটা? সেই বিষয়ে বই বিশ্ববিদ্যালয় না অন্য প্রকাশক, কে বার করলে ভাল হয়, তার চিন্তাভাবনা। আর লেখা হচ্ছে অনেক প্রবন্ধ এবং পুস্তক সমালোচনা, ভয়ানক দ্রুত গতিতে। বেশ কয়েকবার এক দিনে একটা গোটা অধ্যায় শেষ করছেন। একবার দেখছি একদিনে প্রায় সাতটা সমালোচনা লিখছেন।
ডায়রিতে নির্মলকুমারের বাক্যগুলো ছোট, বিস্তারিত এন্ট্রি কম। খানিকটা যেন কবে কোথায় কী করেছিলেন সেই হিসেব লিখে রাখছেন, যাতে পরে ভুলে না যান। বোধহয় একসঙ্গে অনেক খাতা কাগজপত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করতেন এবং তাদের অনায়াসে সামলাতেন। নিজেই লিখেছেন স্বয়ং গাঁধী তাঁর ফাইলিং খুব পছন্দ করতেন। পরিশিষ্টে কৃষ্ণ কৃপালনিকে লেখা চিঠি এবং গাঁধীর সঙ্গে তাঁর একটি দেড় ঘণ্টার ব্যক্তিগত কথোপকথন বিষয়ে অন্য একটি খাতায় বিস্তারে লেখার কথা লিখেছেন। নির্মলকুমারের সমস্ত কাগজপত্র একসঙ্গে পড়া গেলে বিশ শতকের বাংলা এবং ভারতের একটা জরুরি ছবি তৈরি হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তার একটা রূপরেখার হদিশ দিয়ে যায় নির্মলকুমারের ‘ছেচল্লিশের ডায়রি’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy