রহস্যকাহিনি কাহার না পছন্দ। কিন্তু বাজেটে কি রহস্য ফাঁদিতে আছে? অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি চাষির জন্য যে ঘোষণা করিলেন, তাহা বুঝিতে সকলে ‘ক্লু’ খুঁজিতেছে। ফসলের সহায়ক মূল্য নাকি হইবে উৎপাদন-ব্যয় হইতে পঞ্চাশ শতাংশ বেশি। কিন্তু সেই উৎপাদন-ব্যয় কী রূপে ধার্য হইবে? কৃষি উৎপাদনের দাম সুপারিশ করিবার কমিশন (সিএসিপি) সাধারণত সার-বীজ প্রভৃতির মূল্য এবং শ্রমের মূল্যের ভিত্তিতে তাহা নির্ধারণ করে। তাহাকেই গ্রহণ করিলে বাজেটের ‘নূতন’ প্রস্তাবে সহায়ক মূল্যে বিশেষ হেরফের হইবে না। কারণ অনেক ফসলেরই বর্তমান সহায়ক মূল্য উৎপাদন-ব্যয়ের দেড়গুণ বা তাহারও অধিক। কিন্তু জমি ব্যবহার ও চাষের কাজে লগ্নিকৃত টাকা, এই দুইটিকেও উৎপাদন-ব্যয়ের মধ্যে ধরিবার সুপারিশ করিয়াছিল স্বামীনাথন কমিটি। তাহা মানিলে বাস্তবিকই সহায়ক মূল্য অনেক বাড়িবে। সরকার মানিয়াছে কি? রহস্য এখানেই। এবং তাহা রোমাঞ্চের উদ্রেক না করিয়া তিক্ত বিরক্তি জাগাইতে বাধ্য। বাজেট সম্ভবত সরকারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নথি। যথেষ্ট দক্ষতা, যত্ন এবং পারিপাট্যের সহিত তাহা প্রস্তুত করা হইবে, ইহাই প্রত্যাশিত। বিশেষত কৃষিতে যে তীব্র সংকট দেখা দিয়াছে, তাহার সমাধানের আশায় চাষি বাজেট ঘোষণার দিকেই চাহিয়া ছিল। অথচ বাজেট দেখিয়া কৃষি বিশেষজ্ঞরাও বুঝিতে পারেন নাই, চাষি ফসলের কী দাম আশা করিতে পারে। ব্যাখ্যা ক্রমে মিলিবে। কিন্তু অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিবার নির্বাচনী খেলা বাজেটে ছায়া ফেলিল, ইহা দেশের দুর্ভাগ্য।
অস্পষ্টতা কেবল উৎপাদনের ব্যয় নির্ধারণে নহে। মৎস্য বা পশুপালনে কৃষিঋণ দেওয়া হইবে, ঘোষণা করিয়াছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু তাহার জন্য বাজেটে টাকা বরাদ্দ করেন নাই। অর্থাৎ নাবার্ড-প্রমুখ আর্থিক সংস্থা বাজার হইতে টাকা তুলিয়া নূতন নূতন ক্ষেত্রে ঋণ দিবে। সরকারের নিকট ইহা একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত মাত্র, তবু ইহা ‘বাজেট ঘোষণা’ হইল। কৃষি বিপণনের পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য দুই হাজার কোটি টাকা, কিংবা আলু-পিঁয়াজ-টম্যাটোর প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণন ব্যবস্থা তৈরি করিতে (‘অপারেশন গ্রিন’) পাঁচশো কোটি টাকা বরাদ্দ হইয়াছে। কিন্তু এক বৎসরের মধ্যে এই পরিমাণ টাকা খরচ করিবার সাধ্য সরকারের আছে কি? কৃষির অনেক যোজনায় বরাদ্দের সামান্যই খরচ হইয়াছে। বহুলপ্রচারিত মাটির স্বাস্থ্য প্রকল্প তাহার একটি।
কিন্তু বরাদ্দ ও খরচের হিসাবই সব নহে। বাজেট মূলত সরকারের ইচ্ছার প্রকাশ। নাগরিকের প্রতি দায়বদ্ধতা সরকার কী উপায়ে পালন করিতে চাহে, বাজেট তাহার একটি বিবরণ। প্রতি বৎসরেই নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাজেটের প্রস্তাবের সহিত বাস্তব রূপায়ণের বিস্তর ফারাক থাকিয়া যায়। তৎসত্ত্বেও বাজেট-ঘোষণার গুরুত্ব এখানেই যে, তাহা হইতে সরকারের নৈতিক চিন্তাসূত্র, আর্থিক পরিকল্পনার একটি নির্দেশ বোঝা যায়। চাষির উন্নয়নের জন্য নরেন্দ্র মোদী সরকার কোন পথে হাঁটিতে চাহে তাহার সন্ধান এই বাজেটে মিলিল না। শাসনকালের শেষে আসিয়া কেন সহায়ক মূল্য বাড়াইবার ঘোষণা হইল, কৃষিবিমা চাষির কাজে লাগে নাই জানিয়াও কেন বরাদ্দ বাড়ানো হইল, কে বলিবে? চাষির জন্য কিছু অনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি ছুড়িয়া দিল সরকার। যেন বাম হাতে মনসাপূজা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy