Advertisement
১৭ জুন ২০২৪
Editorial News

কিছুই যেন নিয়ন্ত্রণে নেই শিক্ষাঙ্গনে

প্রথমে ত্রাহি মধুসূদন রব উঠল একের পর এক কলেজ থেকে। মেধা তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও ভর্তি হওয়ার উপায় নেই, মোটা অঙ্কের নগদ জমা করতে হবে কলেজ আগলে থাকা ‘দাদা’দের হাতে।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৮ ০০:২৮
Share: Save:

সংশয়, ধন্দ, ধোঁয়াশা, অস্বচ্ছতা, অব্যবস্থা এবং কিয়ৎ নৈরাজ্য। রাজ্যের শিক্ষাঙ্গনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত এখন এই শব্দগুলোর দাপট। কেন এই পরিস্থিতি, দায় কার, নিরসন কোন পথে? স্পষ্ট জবাব নেই এ সব কোনও প্রশ্নেরই।

প্রথমে ত্রাহি মধুসূদন রব উঠল একের পর এক কলেজ থেকে। মেধা তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও ভর্তি হওয়ার উপায় নেই, মোটা অঙ্কের নগদ জমা করতে হবে কলেজ আগলে থাকা ‘দাদা’দের হাতে।

হইচই যখন দৃষ্টিকটূ ভাবে বাড়তে লাগল, তখন পুলিশকে সক্রিয় হতে বললেন মুখ্যমন্ত্রী, তার পরে পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে নিজেও পৌঁছে গেলেন একটি কলেজে। মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ দেখেই হোক বা অন্য কোনও কারণে, এত দিনে নড়েচড়ে উঠল উচ্চ শিক্ষা দফতর। মন্ত্রী প্রথমে বৈঠক করলেন, তার পরে সাংবাদিক বৈঠক করলেন। তাঁর দলের ছাত্র সংগঠন কোনও ভাবেই তোলাবাজির সঙ্গে যুক্ত নয়, বহিরাগত তথা প্রাক্তনীরা এ সব করছেন বলে দাবি করলেন। ছাত্র সংগঠনের সভানেত্রীর কণ্ঠেও একই সুর শোনা গেল, তিনিও বহিরাগতদের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে নিজে দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করলেন।

ভাল কথা। মেনে নেওয়া গেল যে, তৃণমূল ছাত্র পরিষদ ভর্তি দুর্নীতিতে জড়িত নয়। বহিরাগতদের জুলুম রুখতে সংগঠনটি সক্রিয় হবে, তাও মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু তার পরেই উপর্যুপরি দুটো খবর এল। প্রথম খবর— চারটি কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ইউনিট ভেঙে দিয়েছেন সংগঠনের প্রধান জয়া দত্ত। দ্বিতীয় খবর— তৃণমূল ছাত্র পরিষদের শীর্ষ পদ থেকে জয়া দত্তকে সরিয়ে দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

হিসেব গুলিয়ে যায়, ধাঁধা লাগে ভাবনার প্রবাহে। তৃণমূল ছাত্র পরিষদ তো জড়িতই নয় দুর্নীতিতে। সবই তো বহিরাগতদের কুকীর্তি। তেমনই তো শোনা যাচ্ছিল। তা হলে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ইউনিট ভাঙা হল কেন? কেনই বা সরতে হল সভানেত্রী জয়া দত্তকে? স্পষ্ট উত্তর মেলে না। অসঙ্গতির কাঁটা খচখচ করে ওঠে।

অসঙ্গতি, অস্বস্তি সব দূরে সরিয়ে রাখতে অবশ্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল বাংলা। আপাতত রেহাই মিলুক এ ঘোর আতান্তর থেকে, আপাতত কলেজ পাক পড়ুয়ারা, বাকি কথা পরে ভাবা যাবে। এমনই ভাবতে শুরু করেছিলেন পরিত্রাণকামী নাগরিক। কারণ শিক্ষামন্ত্রী পরিত্রাণের দিশা দেখাতে শুরু করেছিলেন। ভর্তি দুর্নীতি রুখতে রাজ্য সরকার সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ করছে বলে পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন। কলেজে গিয়ে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই, অনলাইনে ভর্তি হওয়া যাবে, ক্লাস শুরু হওয়ার পরে নথিপত্র যাচাই করে নেওয়া হবে। পার্থবাবু এমনই ঘোষণা করেছিলেন। সকলেই ভেবেছিলেন, এ যাত্রা রক্ষা পাওয়া গেল। কিন্তু ভুল ভাঙল রাত পোহাতেই। ফের সংশয়, ফের ধন্দ, ফের অব্যবস্থা কলেজে কলেজে। ভর্তি হওয়ার জন্য আর কলেজে আসার দরকার নেই, অনলাইনেই সব হয়ে যাবে, সে না হয় বোঝা গেল। কিন্তু মেধা তালিকায় নাম বেরনো সত্ত্বেও নির্দিষ্ট তারিখে যাঁরা ভর্তি হতে পারেননি, তাঁদের কী হবে? অনলাইন ভর্তি কবে থেকে চালু হবে? অনলাইন ব্যবস্থায় পুরো ভর্তি প্রক্রিয়াই কি নতুন করে হবে? না কি ভর্তি যতদূর হয়ে গিয়েছে, তার পর থেকে বাকিটা অনলাইনে হবে? প্রশ্নের পাহাড় জমেছে কলেজগুলোর সামনে। কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে কোনও উত্তর নেই। শিক্ষা দফতরের তরফ থেকে কোনও স্পষ্ট নির্দেশিকা নেই। পড়ুয়ারা ঘুরে মরছেন বিভ্রান্ত-উদভ্রান্ত।

আরও পড়ুন: প্রবেশিকা নয় কেন যাদবপুরে, প্রতিবাদে রাত পর্যন্ত ঘেরাও উপাচার্য

আরও পড়ুন: ভর্তিজটে সরানো হল টিএমসিপির সভানেত্রীকে

ভর্তি দুর্নীতি রুখতে প্রশাসন কতটা তত্পর, নগরপালের কলেজ পরিদর্শনে তা কিছুটা স্পষ্ট হল। কিন্তু পড়ুয়ারা কি আদৌ রেহাই পেলেন? পেলেন না। বেহালা থেকে মধ্য কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হতে আসা অর্ণব রায় এখনও জানেন না, তিনি ভর্তি হতে পারবেন কি না। বারাসতের সৌরভ পালও একই অবস্থায়। তা হলে কীসের অনলাইন, কীসের নিয়মবদল!

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি নিয়ে এই অব্যবস্থা, তখন প্রায় একই কারণে বিশৃঙ্খলা যাদবপুরেও। প্রথমে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানালেন, ভর্তির জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষা হবে। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর মত, প্রবেশিকা পরীক্ষা হলে সব বিষয়ের জন্যই হওয়া উচিত। নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ের জন্য নয়। এর পরেই মত বদল করলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জানিয়ে দিলেন, প্রবেশিকা প্রত্যাহার করা হচ্ছে, উচ্চমাধ্যমিকের নম্বরের ভিত্তিতেই ভর্তি নেওয়া হবে। এই ঘোষণায় অসন্তুষ্ট ছাত্র সংগঠন, শুরু হয়ে গেল বিক্ষোভ, ঘেরাও।

ছাত্র সংগঠনের মত, প্রবেশিকা বহাল রাখতে হবে। শিক্ষামন্ত্রীর চাপে প্রবেশিকা প্রত্যাহার করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসিত চরিত্র বিসর্জন দেওয়া হয়েছে— মনে করছেন আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও সিদ্ধান্তে অনড়। পড়ুয়াদের কী ভাবে ভর্তি নেওয়া হবে, প্রবেশিকার ভিত্তিতে, না কি নম্বরের ভিত্তিতে— সে সব স্থির করা পড়ুয়াদের কাজ নয়, কর্তৃপক্ষের কাজ। বলেছেন উপাচার্য, বলছেন রেজিস্ট্র্রার। কিন্তু সে তত্ত্ব মানতে নারাজ বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীরা। অতএব অচলাবস্থা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও।

বিশৃঙ্খলাটাই যেন দৃশ্যপট হয়ে উঠেছে বাংলার শিক্ষাঙ্গনে। কোনও কিছুই যেন সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হতে চাইছে না। শিক্ষা দফতর বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনও কিছু নিয়ন্ত্রণেও যেন রাখতে পারছেন না। অতএব অব্যবস্থা, অতএব বিভ্রান্তি, অতএব দুর্ভোগ। এই দৃশ্যকে যদি ‘অরাজকতা’ আখ্যা দেওয়া হয়, খুব অত্যুক্তি হবে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE