Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
মিলিয়ে আসা আলোর পথ
Harishankar Vasudevan

কলকাতার বড় মাপের চিন্তাবলয়ের প্রতিনিধি হরিশঙ্কর বাসুদেবন

সব পরিচয় ছাপিয়ে প্রধানত শিক্ষক আর শিক্ষাবিদ বাসুদেবন ছিলেন প্রকৃত অর্থে এক জন কসমোপলিটান মানুষ।

হরিশঙ্কর বাসুদেবন (১৯৫২-২০২০)

হরিশঙ্কর বাসুদেবন (১৯৫২-২০২০)

কিংশুক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০২০ ০০:০৯
Share: Save:

সদ্য করোনার শিকার হরিশঙ্কর বাসুদেবন (১৯৫২-২০২০) ছিলেন এই শহরের গর্ব করার মতো এক জন। প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ, ইউরোপীয় ইতিহাসের খ্যাতনামা শিক্ষক, রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া বিষয়ে দেশের অন্যতম প্রধান বিশেষজ্ঞ এবং— যেটা খানিক অজানা— দক্ষ প্রশাসক। চার দশকের বেশি সময়ব্যাপী তাঁর কর্মজীবনের সিংহভাগ কেটেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। এ ছাড়া কর্মজীবনের শুরুতে তিনি দিল্লির রামজস কলেজে ও পরে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট–এর অধিকর্তার দায়িত্বভার সামলেছেন, এবং এনসিইআরটি-র পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন কমিটির সভাপতি থেকেছেন। এবং এই সবই তিনি করে গিয়েছেন কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ না হয়ে, ভারতীয় শিক্ষাজগতে সাফল্যের ক্ষেত্রে যা ক্রমশ এক দুর্লভ ঘটনা হয়ে উঠেছে। এই সব ছাপিয়ে বাসুদেবন ছিলেন এক অনন্য মাত্রার মানুষ, যেমন মানুষও আজ দুর্লভ। সদা হাসিমুখ, উষ্ণহৃদয়, দয়ালু, বন্ধুবৎসল, উদারমনস্ক এবং প্রকৃত অর্থে বিচক্ষণ।

আর সব পরিচয় ছাপিয়ে প্রধানত শিক্ষক আর শিক্ষাবিদ বাসুদেবন ছিলেন প্রকৃত অর্থে এক জন কসমোপলিটান মানুষ। কেরলের মেনন পরিবারে বড় হওয়া বাসুদেবনের প্রভু গুরভায়ুরে ছিল অবিচল আস্থা, জীবনের শেষ অবধি। কিন্তু কেনিয়ার ব্রিটিশ উপনিবেশে শৈশবের সিংহভাগ এবং কৈশোর কাটানোর পরে বাসুদেবন উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান কেম্ব্রিজ, ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য কাজ করেন উনিশ শতকের রুশ আঞ্চলিক শাসনব্যবস্থার ইতিহাস নিয়ে। শৈশব ও কৈশোরে ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের ফলে বাসুদেবন অনেকাংশে ইউরোপীয় মূল্যবোধ এবং চিন্তাধারা আত্মস্থ করে ফেলেন। পরে দেশে ফিরে কলকাতায় চার দশক অধ্যাপনা করলেও অনেকের চোখেই বাসুদেবন ছিলেন ‘পাক্কা সাহিব’। অথচ যারা কাছ থেকে দেখেছে তারা জানে যে বাসুদেবনের কসমোপলিটান সত্তায় আসলে অনেকগুলি স্তর, যা সহজ-সরল সাহেবিয়ানার ছক দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়।

ইতিহাসবিদ হিসেবে বাসুদেবনের পরিচিতি ঘটনাচক্রে তাঁর প্রথম কাজটির, মানে ডক্টরাল থিসিসের সুবাদে হয়নি। ডিগ্রি শেষ করে ভারতে ফিরে ১৯৭৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং ইউরোপীয় (বিশেষত রুশ) ইতিহাসের পঠনপাঠনকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। রুশ ভাষা ছাড়াও ল্যাটিন, জার্মান ও ফরাসি ভাষা জানার সূত্রে বৌদ্ধিক চেতনার ইতিহাস (ইনটেলেকচুয়াল হিস্ট্রি) এবং শিল্পায়নের ইতিহাস চর্চাকেও এক নতুন মাত্রা দেন তিনি। ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্কটকালে ভারতবর্ষ যখন আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় তার বৃহত্তম মিত্রের দিকে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রয়েছে, সেই সময় বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং পত্রপত্রিকায় বাসুদেবন সোভিয়েট ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে লেখালিখি শুরু করেন। রুশ ইতিহাস এবং রাজনীতির অধ্যয়নে তাঁর খ্যাতি।

এর পর দিন পাল্টাল, সোভিয়েট আর্কাইভগুলি গবেষকদের জন্য খুলে দেওয়া হল। দুই সহকর্মী পূরবী রায় এবং শোভনলাল দত্তগুপ্তের সহায়তায় বাসুদেবন ১৯১৭-৪৭ সময়কালীন ভারত-রুশ সম্পর্ক নিয়ে তথ্য এবং দলিলের দুটি সঙ্কলন বার করলেন এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে। প্রায় ওই একই সময়ে ভারত সরকার রুশ প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে যে দল পাঠায়, বাসুদেবন সেই দলের সদস্য ছিলেন। সেই সূত্র ধরে পরবর্তী কালে ১৯৯১-উত্তর ভারত-রুশ সম্পর্কের ইতিহাস নিয়ে বাসুদেবন লেখেন শ্যাডোজ় অব সাবস্ট্যান্স। তবে আফানাসি নিকিতিন নামক রুশ পর্যটকের জীবন এবং জীবনী-নির্মাণ নিয়ে লেখা বইটিই সম্ভবত ওঁর সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে লেখা বই। প্রায় দেড় দশকের গবেষণার ফসল ওই বইটি বাসুদেবনের নিজেরও বড় কাছের।

বাসুদেবনকে প্রথম দেখি ১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের সেমিনার-এ। বামশাসিত পশ্চিমবঙ্গে বড় হওয়ার ফলে সবিস্ময়ে দেখেছিলাম যে মতাদর্শের রোদ-চশমা ছাড়াও লেনিনকে দেখা এবং বোঝা সম্ভব। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পড়তে গিয়ে বাসুদেবনের কাছে ইউরোপীয় ইতিহাস, শিল্পায়নের ইতিহাস, ঠান্ডা যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক চিন্তনের ইতিহাস পড়তে গিয়ে মনে হয়েছিল আধুনিক ইতিহাসের এমন কিছু নেই যা ভদ্রলোক জানেন না। এর পর যখন ওঁরই কাছে ইরানের ইসলামি বিপ্লব নিয়ে গবেষণা শুরু করি, তত দিনে বাসুদেবন প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের দক্ষিণ অংশে মধ্য এশিয়ার তুর্কি প্রজাতন্ত্রগুলি নিয়ে বিস্তর পড়াশুনো করে ফেলেছেন, এবং এগুলি পারসিক সাংস্কৃতিক বলয়ের মধ্যে হওয়ার কারণে ইরান সম্বন্ধেও ওঁর আগ্রহ জন্মেছে গভীর।

মধ্য এশিয়া নিয়ে ওঁর এই আগ্রহ একটা পূর্ণতা পায় ২০০৭-১০ সালে, যখন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ়-এর অধিকর্তা নিযুক্ত হলেন তিনি। বরুণ দে, রণবীর সমাদ্দার, জয়ন্ত কুমার রায়ের হাতে গড়া এই প্রতিষ্ঠানটি বরাবর ‘এরিয়া স্টাডিজ়’-এর জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। বাসুদেবন এসে একটি উদারমনস্ক অ্যাকাডেমিক কমিটির সঙ্গে হাত মিলিয়ে গবেষকদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেন। তাঁর নেতৃত্বে গবেষণা ও প্রকাশনার মান অনেক উঁচুতে উঠে গেল। ওই প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা পরে বলতেন, বাসুদেবনের সময়কালই ছিল ওখানকার স্বর্ণযুগ।

কর্মজীবনের শেষ দিকে বাসুদেবন আবার ফিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের এরিয়া স্টাডিজ় এবং বৈদেশিক নীতির চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়েন, এবং এই বার ভারতের পূর্ব দিকে তাকাতে শুরু করেন। প্রধানত চিন এবং মায়ানমার নিয়ে জীবনের শেষ দশকে বাসুদেবন বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং বিস্তর পড়াশোনা করেন। ওই সময়েই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মায়ানমারের ডাগন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সেতু গড়ে তোলেন তিনি।

হরি বাসুদেবন চাইলে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে পড়াতে বা গবেষণা করতে যেতে পারতেন। কিন্তু এক বার বন্ধুবর মুশিরুল হাসানের ডাকে তিন বছরের জন্য দিল্লি যাওয়া ছাড়া কোথাও যাননি, ১৯৭৮ থেকে কলকাতাতেই শিকড় ফেলেছিলেন। এই শহরেই প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ তপতী গুহঠাকুরতার সঙ্গে ঘর বেঁধে তিনি কলকাতার মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন, এবং মোটের ওপর কলকাতাও তাঁকে আপন করে নিয়েছিল। কর্মজীবনের সিংহভাগ সময় কলকাতায় বসে বিদেশ নিয়ে চর্চা করা হরি বাসুদেবন এক অর্থে তাই বাঙালির সেই লুপ্তপ্রায় প্রজাতির এক জন উজ্জ্বল সদস্য, যাঁরা ঘরে বসে ঘরের জানলা খুলে দিতে পারেন সকলের জন্য, যাতে বাইরের হাওয়া সহজে ঢুকতে পারে, চার পাশে অনেককে সমৃদ্ধ করতে পারে।

এই শহরে কোনও বিদেশি গবেষক এসে কলকাতা সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করলে বাসুদেবন নিজের উদ্যোগে তাঁদের শহরের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন, যাতে তাঁরা বাসুদেবনের চোখ দিয়ে শহরটাকে দেখতে পান। নিজেও পরম উৎসাহ

ভরে গোটা শহরে দুর্গাপূজা দেখে বেড়াতে ভালবাসতেন, বাঙালি খাবার খেতেন তারিয়ে তারিয়ে। তেমন স্পষ্ট বাংলা না বলতে পারলেও কলকাতাতেই সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন, আবার পোঙ্গল এবং ওনাম পালনও করতেন নিষ্ঠাভরে, কিংবা বড়দিন পালন করতেন উৎসাহে। কেনিয়ায় এবং পরে ইংল্যান্ডে থাকার সুবাদে বড়দিন ওঁর কাছে স্বাভাবিক ভাবেই উৎসবের দিন হয়ে গিয়েছিল। মনে পড়ে, ইদ আল ফিতরের সময় বাকরখানি, জন্মাষ্টমীর সময় নানখাটাই পেলে চোখে-মুখে কেমন ফুটে উঠত শিশুসুলভ খুশি। এই কি যাকে আমরা বলি বহুমাত্রিক কসমোপলিট্যানিজ়ম? তা, সে যা-ই হোক না কেন, আজ কলকাতার বুক থেকে হারিয়ে যেতে বসেছেন এই মাপের মানুষরা। বাসুদেবনের অকালপ্রয়াণ শহরের রংটাকে আর একটু ফ্যাকাশে করে দিল, মাপটাকে আর একটু ছোট।

ইতিহাস বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Harishankar Vasudevan Historian
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE