Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

পরিকাঠামোর অভাবেই দুর্বল স্বাস্থ্য পরিষেবা

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির জন্য পরিকাঠামোর পরিবর্তন ও বিকাশ অত্যন্ত প্রয়োজন। আর তার জন্য চাই পর্যাপ্ত অর্থ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু সমালোকদের একাংশ মনে করেন, আমাদের সরকারি বাজেটে এই বিষয়ে বিশেষ জোর দেওয়া হয় না। লিখছেন অচিন্ত্যকুমার দত্তস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির জন্য পরিকাঠামোর পরিবর্তন ও বিকাশ অত্যন্ত প্রয়োজন। আর তার জন্য চাই পর্যাপ্ত অর্থ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।

শয্যা নেই। ঠাঁঁই মিলেছে বারান্দায়। ফাইল ছবি

শয্যা নেই। ঠাঁঁই মিলেছে বারান্দায়। ফাইল ছবি

শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৯ ০২:০৬
Share: Save:

প্রতি বছরের মতো এ বারেও সারা বিশ্ব জুড়ে ৭ এপ্রিল ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস’ পালিত হল। ১৯৫০ সাল থেকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু) নেতৃত্বে নানা আলোচনা, সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান, প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছরেও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এই দিনটি উপলক্ষে নানা আয়োজন করেছিল। এ বারের বিশ্বস্বাস্থ্য দিবসের আলোচ্য বিষয় ছিল, ‘সর্বত্র সকলের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা’। পরিভাষায় এর অর্থ হল সকলের জন্য উন্নত মানের চিকিৎসা পরিষেবা সুনিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা পরিষেবাকে আরও সক্রিয় ও সচল করে তোলা। ভারতেও নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে এই দিনটি পালিত হয়েছে।

কিন্তু এ দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবার পাশে বিস্ময়সূচক চিহ্ন বসালেও আশ্চর্যের কিছু নেই। স্বাধীনতার সাত দশক পার করেও ভারতের অনেক রাজ্যে চিকিৎসা পরিষেবা নিম্নমানের। জনস্বাস্থ্যর দুরবস্থা চোখে পড়ার মতো। ১৯৭৮ সালে ‘আলমা আটা ডিক্লারেশন’-এর পরে ভারতের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি নতুন করে নির্ধারিত হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাস্থ্য পরিষেবায় স্বনির্ভরতা অর্জন ও প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রের মাধ্যমে সকলের জন্য স্বাস্থ্য বাস্তবায়িত করা। কিন্তু তা সফল হয়নি। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারি অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় ছিল অনেক কম। ১৯৫০-’৫১ সালে এই খাতে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ ছিল জিডিপি-র শতকরা ৩.২২ ভাগ। ’৮০-র দশকে তার পরিমাণ ছিল ১.০৫ ভাগ। পরবর্তী তিন দশকে এর বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। ১৯৯৭-২০০০ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রতিবেদন অনুসারে জানা যায়, ভারতে স্বাস্থ্যখাতে মাথা পিছু ব্যয়ের পরিমাণ শ্রীলঙ্কা ও তাইল্যান্ড থেকেও কম ছিল।

বস্তুত দীর্ঘদিন যাবৎ স্বাস্থ্য পরিষেবা অবহেলিত। ফলে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ও হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবার ঘাটতি দেখা যায় এবং সেই সুযোগ নিতে এগিয়ে আসে বিভিন্ন বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়ী। ক্রমশ তাঁরা ভারতের স্বাস্থ্য বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় আজও তাদের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ শিথিল।

জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার পরিষেবার প্রসার ও বিকাশের লক্ষ্যে সম্প্রতি ভারত সরকারের উদ্যোগে কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ‘আয়ুষ্মান ভারত’ তার মধ্যে অন্যতম। অনেক রাজ্যে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে এই পরিকল্পনা অনেকাংশে রূপায়িত হয়েছে। ২০১৯-’২০ সালে এই খাতে অর্থ বরাদ্দ বেড়ে হয়েছে ৬৪০০ কোটি টাকা। আর একটি পরিকল্পনার নাম ‘মিশন ইন্দ্রধনুষ’। এটি মূলত টিকাকরণ পরিকল্পনা। প্রধান উদ্দেশ্য গ্রাম ও শহরে সকল শিশুকে টিকাকরণের আওতায় নিয়ে আসা। এই সব উদ্দেশ্যে এ বছর অন্তর্বর্তী বাজেটে অর্থ বরাদ্দ বেড়েছে। তা ছাড়া ২০১৫-’১৬ সালে দরিদ্রসীমার নীচে অবস্থিত প্রায় চার কোটি দশ লক্ষ পরিবারকে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবুও এ কথা অস্বীকার করা যাবে না, স্বাস্থ্য খাতে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ জাতীয় স্তরে যথেষ্ট কম। অগণিত মানুষ এখনও স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত এবং বিনা চিকিৎসায় মারা যান।

ভারতের মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর দেশে উন্নত মানের স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানে রাজ্যগুলির দায়িত্ব কোনও অংশেই কম নয়। বরং বেশিই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান সম্ভবত সন্তোষজনক নয়। পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিষেবা অবহেলিত, দুর্বল বলে মাঝেমধ্যেই অভিযোগ ওঠে। সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে পশ্চিমবঙ্গ অনেকটাই পিছিয়ে বলেও অভিযোগ। প্রতি বছর ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি এবং সোয়াইন ফ্লু জনগণকে আতঙ্কিত করে তোলে। এগারোটি জেলায় এখনও কালাজ্বরের আক্রমণ হচ্ছে। যক্ষা রোগীর সংখ্যাও কম নয়। এই ধরনের রোগের চিকিৎসারও পর্যাপ্ত বন্দোবস্ত দেখা যায় না। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালগুলির দিকে তাকালে এ বিষয়ে সন্দেহ থাকে না।

এ রাজ্যে স্বাস্থ্যখাতে অর্থ বরাদ্দ সন্তোষজনক নয়। কিন্তু অনান্য ক্ষেত্রে বরাদ্দের বহর কম নয়। এ কথা বললে হয়তো ভুল হবে যে স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গে স্বাস্থ্য পরিষেবার যেমন প্রসার ঘটার প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম। অনেক স্থানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেখানে ঠিক ও উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার বন্দোবস্ত নেই। চিকিৎসক, ওষুধ, চিকিৎসার উপকরণ এবং পরীক্ষাগারের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। অনেক শহরে আজও আধুনিক স্বাস্থ্যবিধান ব্যবস্থা দেখা যায় না।

পরিকাঠামোর অভাবই বোধ হয় দুর্বল স্বাস্থ্য পরিষেবার অন্যতম কারণ। এর পরিবর্তন ও বিকাশ অত্যন্ত প্রয়োজন। আর তার জন্য চাই পর্যাপ্ত অর্থ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু সমালোকদের একাংশ মনে করেন, সরকারি বাজেটে তা বিরল। পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিষেবার সাধারণ মানুষের অসন্তোষ প্রায়ই দেখা যায়। কখনও কখনও চাপা উত্তেজনা হিংস্রতার রূপ ধারণ করে ফিরে আসে। চিকিৎসকের অভাব, জরুরি ও জীবনদায়ী ওষুধে টান, রোগীর শয্যার অভাব প্রভৃতি হয়তো অনেকক্ষেত্রে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের উপরে চাপ তৈরি করে এবং অসংযত আচরণের পথে ঠেলে দেয়। ফলে রোগীর লোকজনদেরও সহিষ্ণুতার বাঁধ ভেঙে যায়। জন্ম নেয় বচসা ও সঙ্ঘাত। এই অবস্থার পরিবর্তন সকলেরই কাম্য এবং একে বাস্তবায়িত করতে সরকারি উদ্যোগও অধিক প্রয়োজন।

প্রায় প্রত্যেক হাসপাতালে চিকিৎসকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। অথচ রোগীর চাপ ক্রমেই বাড়ছে। স্বভাবতই কাজের চাপ বেশি। অত্যধিক কাজের চাপে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরাও হয়ত বিভ্রান্ত হন। কিন্তু চিকিৎসকের পেশা অন্যদের থেকে আলাদা। এই পেশায় যোগ দানের আগে চিকিৎসককে ‘কোড অব মেডিক্যাল এথিকস’ মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। এটি আইনসিদ্ধ। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কাউন্সিল (প্রফেশনাল এটিকেট অ্যান্ড এথিকস) রেগুলেশন ২০০২-এর মধ্যে এই কোড লিপিবদ্ধ। এই কোড অনুসারে এক জন চিকিৎসক রোগীর ডাকে সাড়া দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। রোগীকে তিনি কোনও অবস্থাই অবহেলা করতে পারেন না। তাঁর প্রতি অশোভন আচরণ করতে পারবেন না।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু শহরে বিশেষত, বর্ধমানের চিকিৎসকদের একাংশের ব্যবহার নিয়ে অভিযোগ তোলেন রোগী ও তার পরিজনেরা। তাঁদের অভিযোগ, আজকাল নাকি প্রায়ই দেখা যাচ্ছে চিকিৎসকেরা নানা নীতি বিরুদ্ধ কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। রোগের প্রতি অবহেলা ও তার ফলে রোগীর মৃত্যু থেকেই রোগীর আত্মীয়দের মধ্যে জন্ম নেয় ক্ষোভ, ক্রোধ ও বিদ্বেষ। স্বজন হারানোর যন্ত্রণা কেবল তিনিই বোঝেন যাঁকে হারাতে হয়। তা তিনিই সাধারণ মানুষই হোন বা চিকিৎসক। বেশ কয়েক বছর আগে অভিযোগ উঠেছিল, এক চিকিৎসকের স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল আর এক চিকিৎসকের অবহেলায়। কর্তব্যরত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে তিনিও অভিযোগ করেছিলেন। তবে তা নিয়মতান্ত্রিক পথে। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রতিবাদ যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল। স্বজন হারানোর যন্ত্রণা চিকিৎসকদের উপলব্ধি করতে হবে। কেন রোগীর আত্মীয় পরিজনেরা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন এ কথা ভাবার সময় এসেছে। চিকিৎসক ও সরকার উভয়কেই তা উপলব্ধি করতে হবে।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Health Service Poor Infrastructure
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE