Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সূর্যের সঙ্গে ধরিত্রীর বিবাহ: বসন্ত উৎসব

সাঁওতাল, মুণ্ডা, হো, ওঁরাও সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে বসন্ত উৎসব মাঙ্গলিক ও ধর্মীয় উৎসব। তার যেমন বহিরঙ্গ রয়েছে, তেমনই রয়েছে অন্তরের দর্শন। প্রাকৃতিক সম্পদকে ঐশ্বরিক নিবেদনের পরে, প্রকৃতির সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। এই হল ‘বাহা’। লিখছেন নচিকেতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বাহা’তে পূজিত হন ‘বোঙ্গা’গণ (পবিত্র আত্মা অথবা দেবতা), দেবী ‘জাহের এরা’, ‘মঁড়েকো-তুরুইকো’ (পাঁচ-ছ’জন) ও ‘দেবী গোঁসাই’।

বাহা উৎসব। —নিজস্ব চিত্র

বাহা উৎসব। —নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৯ ০২:১০
Share: Save:

প্রকৃতি এখানে আক্ষরিক অর্থে ‘দখিন দুয়ার’ খুলে দেয়। বিছিয়ে থাকে শাল, মহুয়া ফুল। বাতাসে ওড়ে পিয়ালের রেণু। অযোধ্যা, দলমা, দামোদর নদের উপকূল, পঞ্চকোট মাঠা অরণ্যানী সংলগ্ন সাঁওতাল পল্লিতে ধামসা-মাদল আহ্বান করে বসন্ত উৎসব। তবে এ শুধু রঙের উৎসব নয়, এ এক বিবাহ উৎসব। ধরিত্রীর সঙ্গে সূর্যের। যে বিবাহ শেষে নবকুলের সূচনা হয়। বংশ রক্ষা হয় অরণ্যের, শস্যের। ফাল্গুনী দোল পূর্ণিমায়।

সাঁওতাল, মুণ্ডা, হো, ওঁরাও সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে বসন্ত উৎসব মাঙ্গলিক ও ধর্মীয় উৎসব। তার যেমন বহিরঙ্গ রয়েছে, তেমনই রয়েছে অন্তরের দর্শন। প্রাকৃতিক সম্পদকে ঐশ্বরিক নিবেদনের পরে, প্রকৃতির সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। এই হল ‘বাহা’ অথবা এই হল ‘সারহুল’।

‘বাহা’তে পূজিত হন ‘বোঙ্গা’গণ (পবিত্র আত্মা অথবা দেবতা), দেবী ‘জাহের এরা’, ‘মঁড়েকো-তুরুইকো’ (পাঁচ-ছ’জন) ও ‘দেবী গোঁসাই’। ‘মঁড়েকো-তুরুইকো’ দেবতারা পাঁচ ভাই। তাঁদের মা ‘জাহের এরা’। পাঁচ ভাইয়ের স্ত্রী ‘গোঁসাই এরা’। এই পূজার স্থান ‘জাহের থান’, যা প্রতি সাঁওতাল গ্রামেই থাকে। পূজার কাল মূলত ফাল্গুনী পূর্ণিমা। ত্রিদিবসীয়। অর্থাৎ, তিন দিন ধরে পালিত হয় এই পূজার প্রথা। প্রথমদিন ‘উম্‌’ (অধিবাস ও স্নান সম্পর্কিত, ‘সারদি’ (মূল উৎসব) ও ‘সেন্দরা’ (শিকার)।

উম্‌ পর্বে পবিত্র শাল নিকুঞ্জে (জাহের) দু’টি দেব-কুটির রচনা করা হয়। একটি ‘গোঁসাই এরা’র এবং অন্যটি ‘মারাং বুরু’ ও অন্য দেবতাদের জন্য। সাধারণত অগ্রণী যুবক কুল ও আগ্রহী পুরুষেরা স্নান অন্তে ‘নায়েকে’ অর্থাৎ, পুরোহিতের বাড়িতে আতিথ্য সেরে আচার পালন করেন। ‘নায়েকে’র বাড়িতে পবিত্র নাগাড়া, শিঙ্গা বাদন করা হয়। নির্দিষ্ট লোকাচার শেষে সকলের জন্য বারি সিঞ্চন করা হয়। ‘নায়েকে’ সর্বজনীন শান্তিকল্যাণ মন্ত্র উচ্চারণ করেন। এ বার নৃত্যগীত, বসন্তদিনের গান, পুরাণাশ্রিত গান, মাঙ্গলিক নিজস্ব সৃষ্টি ও শৈলির সমবেত নৃত্যে মেতে ওঠেন গ্রামবাসী। নব বসন্ত নিমন্ত্রিত হন।

দ্বিতীয় দিন ‘সারদি মাহা’। সমবেত ভক্তদের নিয়ে জাহের থানে আসেন ‘নায়েকে’। ভক্তেরা নিয়ে আসেন ধামসা, মাদল, তির-ধনুক, ‘সাকাম সিকড়ি’, ‘বারসি’, ‘হাপা’ প্রভৃতি দেব-আয়ুধ ও সপুষ্প শালমঞ্জরি। সঙ্গে থাকে ধূপ-ধূনা, সিঁদুর, আতপচাল, মঙ্গলঘট প্রভৃতি উপকরণ নৈবেদ্য এবং দেবভোগ্য মোরগ। অন্তিমে গানে গানে ‘জাহের’ বন্দনা, শালবৃক্ষের বন্দনা এবং শাল ও মহুয়ার নিবেদন। রমনীকুল আঁচল পেতে শাল ফুল আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করেন। ঘরে বিতরণ করা হয় শান্তিবারি তুল্য ‘বাহাদঃ’ শাল ফুল।

‘সেন্দরা’ বা শিকার। ‘বাহা’র তৃতীয় ও শেষ দিবসের উপজীব্য। গ্রামের যুবকেরা নায়েকের আশীর্বাদ নিয়ে শিকারে যান। আয়োজিত ‘সাগুন-সুপারি’ (বিশেষ প্রথা) ও জলক্রীড়া। এটি অনেকটা হোলি খেলার মতো।

আদিবাসী জীবনের অর্থনৈতিক ইতিহাসে খাদ্য সংগ্রহ ও শিকারের উৎসব হল ‘সারহুল’। মূলত ওঁরাও সম্প্রদায়ের উৎসব এটি। তাঁদের প্রাক কৃষিযুগের শিকার উৎসব রূপান্তরিত হয়েছে কৃষি উৎসবে। ওঁরাও-জীবনে খাদ্যসংগ্রহের দু’রকমের উৎসব। ‘খাদ্দি’ বা ‘সারহুল’ এবং ‘ফাগু’। ‘ফাগু’ সম্ভবত সংস্কৃতায়নের ফসল। তবে দু’টোই নববর্ষের সূচক। ফাগুন পূর্ণিমা ছাড়াও ফাগুন-চৈত্রের অন্য যে কোনও দিনে পালিত হতে পারে এই উৎসব। আদিতে এ ছিল কৃষি নববর্ষ।

ওঁরাও-বিশ্বাসে পর্যাপ্ত শালমঞ্জরি বিকশিত হলে পর্যাপ্ত শস্য উৎপাদন হয়। শালের ডালে ডালে পাখির কুজনে তাঁরা মরসুমি বাতাসের পূর্বাভাস পান। বুঝতে পারেন শ্রাবণ মেঘের আনাগোনা ও বৃষ্টিপাত। এই বর্ষা-কল্পনা ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে শুরু হয় ‘সারহুল’-এর দেবতাদের নিকট প্রার্থনা। গবেষকদের মতে, ‘সারহুল’-এর বহিরঙ্গে কৃষি হলেও অন্তর্দশনে ‘উর্বরতা’ বোধ। কারণ, ‘ধরিত্রীর বিবাহের আয়োজন হয় এই পরবে। বসন্ত নববর্ষে প্রার্থিত হয় বন্যপ্রাণের সম্পদ ও বংশধারা।

‘সারহুল’ উৎসবটি ফাল্গুনী বা চৈতালি, যাই-ই হোক না কেন তা দ্বি-দিবসীয়। প্রথমদিন ‘উপাস’ ও দ্বিতীয় দিন ‘ছেংগনা কাটি’। গ্রামের প্রধান, ‘পাহান’ (পুরোহিত) ও পুজার (সহকারী পুরোহিত) এই উৎসবের দিন ঠিক করেন। পুজারির স্ত্রী উৎসব শুরুর এক পক্ষকাল আগে থেকে গ্রামবাসীদের ঘর-ঘর থেকে শস্য সংগ্রহ করেন। শস্যের বিক্রয় লব্ধ অর্থ দিয়ে কামার, কুমোর, বাদকের প্রাপ্য উপকরণ ক্রয় হয়। উৎসবের প্রাক্‌-পর্বে ‘সারনা’তে (শালফুলের পবিত্রকুঞ্জ) রেড়ির চারা ও শিমূল পল্লব রোপিত হয়। পরদিন সকালে পুরোহিত পূজা করেন।

‘উপাসে’র দিন কৃষিকার্য নিষিদ্ধ। ‘পাহান’ উপোস দিয়ে থাকেন। ‘সারহুল’-এর একটি প্রথা হল ‘খেকেল বেঞ্জা’ বা ধরিত্রীর বিবাহ। এই উৎসব উদ্‌যাপিত না হলে গ্রামবাসী নববৎসরের শস্য, অরণ্যসংগ্রহ বা ফুলচয়ন অনধিকার বলে মনে করেন। ‘উপাস’ বা প্রথম দিনে ‘দাড়ি ছিটনা’ (অধিবাস সদৃশ), পুরোহিত-বাড়িতে ‘ছিগরি গাড়া’ (পরবের পতাকা প্রোথিত করা), মধ্যরাত্রে পবিত্র কলস বারি ‘সারনা’তে স্থাপন ও জলের পূর্ণকলসে জলের পরিমাপ নিরীক্ষণ ইত্যাদি নিষ্ঠা ভরে পালিত হয়। পুরোহিতের বাড়ির আঙিনায় গ্রামীণ রমণীরা ‘সারহুল’-এর বসন্তগান, ‘ইসম সিন্দরি’ (পাহান-পাহানিয়ানের বিবাহ), শুভ আত্মার আবাহন, ‘জাহের থান’-এ অনুগমন, ধর্মেশ পূজন (প্রধান দেবতা) ও প্রসাদভোজন ইত্যাদি সম্পন্ন করেন।

দ্বিতীয় দিনে ‘ছেংগনা কাটি’। এ দিন গ্রামীণ নারীদের ব্রত ও উপবাস। ‘পাহান’ নিজ সম্প্রদায়ের প্রথা ও বিশ্বাস সহযোগে পূজা করেন গ্রামের মঙ্গল কামনায়। পুরোহিত ও তাঁর অনুগামীরা গ্রামে বিতরণ করেন ‘সকুন পানি’ বা মঙ্গল বারি, ‘সারনা’র ফুল। রাত জুড়ে প্রসাদ নৃত্য-গীতের আয়োজন। এই রাতকে বলে ‘খাদ্দি’।

‘সারহুল’ বহিরঙ্গে ধর্মীয় উৎসব। কিন্তু এক কথায় তা ‘উর্বরতা’ রক্ষার প্রতীক। প্রকৃতি থেকে মানুষ এখন বিচ্ছিন্ন। ‘বাহা’ বা ‘সারহুল’ সেই বিচ্ছিন্ন নাড়ির টানের কথাই মনে করিয়ে দেয়। যেখানে প্রকৃতি বন্ধু, পরিবার।

লেখক সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Baha Holi Holi Celebration Dol
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE