Advertisement
E-Paper

দুঃসাহস

রাষ্ট্রযন্ত্রের নেকনজরে থাকিবার জন্য কী করিতে হইবে, তাহার ফর্মুলাও পরিচিত— সরকার-বিরোধী, যুক্তিবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রতিবাদী মানুষদের প্রথমে ‘দেশদ্রোহী’ হিসাবে চিহ্নিত করিতে হইবে, এবং তাহার পর তাঁহাদের নিধনকামনা করিতে হইবে।

শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:১৪

কয়েকটি অতি মাঝারি মাপের সিনেমার পরিচালক একটি বই লিখিয়াছেন, এবং তাহার প্রচারের স্বার্থে একটি আলটপকা মন্তব্য করিয়া বিতর্ক বাঁধাইবার চেষ্টা করিয়াছেন। সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় স্তম্ভে সচরাচর এমন ঘটনা ঠাঁই পায় না। কিন্তু, এই সম্পাদকীয় নিবন্ধটি বিবেক অগ্নিহোত্রীর ‘আরবান নকশাল’ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই। মন্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ। বিবেক অগ্নিহোত্রীর কারণে নহে— এই প্রসঙ্গে তিনি নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। কোনও এক ব্যক্তিবিশেষ সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘শহুরে নকশাল’-দের সমর্থকদের তালিকা নির্মাণ করিবার ডাক দেওয়ার সাহস পাইতে পারেন, ঘটনাটির গুরুত্ব এইখানেই। অগ্নিহোত্রী কেন মন্তব্যটি করিলেন, তাঁহার বইয়ের বিক্রি বাড়াইতে, না কি প্রধানমন্ত্রীর পারিষদবৃত্তে নিজের আসনটিকে আরও খানিক পাকা করিয়া লইতে, সেই প্রশ্ন অবান্তর। কথাটি তাঁহার সাহস লইয়া। তাহাও, ব্যক্তি অগ্নিহোত্রীর নহে, তাঁহার ন্যায় আরও অনেক ‘দেশপ্রেমিক’-এর, এই গোত্রের মন্তব্য করিতে যাঁহাদের গলা কাঁপে না। যে দিন পুলিশ দেশের প্রথম সারির পাঁচ মেধাজীবীকে নকশালপন্থীদের সহিত সংযোগের অভিযোগে গ্রেফতার করিল, সে দিনই ‘শহুরে নকশাল’দের তালিকা নির্মাণের ডাকের মধ্যে যে হিংস্রতা আছে, আইন হাতে তুলিয়া লইবার আহ্বান আছে, তাহা নজর এড়াইবার নহে। ‘শহুরে নকশাল’দের চিহ্নিত করিলেই তো খেলা ফুরায় না— ‘দেশপ্রেমী’রা জানেন, সেই ‘দেশদ্রোহী’দের কী ভাবে শায়েস্তা করিতে হয়। অগ্নিহোত্রী সেই সবক শিখাইবার ডাকই দিতেছিলেন। এই ভারত তাঁহাকে সেই সাহস দিয়াছে। ঠিক যেমন অন্যদেরও সাহস দিয়াছে বিরোধীদের ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’, ‘সিকুলার’ বা ‘প্রেস্টিটিউট’ হিসাবে চিহ্নিত করিয়া দেওয়ার। রাষ্ট্রযন্ত্রের আশীর্বাদ না থাকিলে কি আর এই সাহস হয়?

বিবেক অগ্নিহোত্রীর মন্তব্যের দায়টি বিজেপির উপরই বর্তায়। শুধু এই কারণে নহে যে অগ্নিহোত্রীর (প্রকাশ্য) রাজনৈতিক আনুগত্য নরেন্দ্র মোদীর প্রতি। শুধু এই কারণেও নহে যে দেশ জুড়িয়া ‘শহুরে নকশাল’ খুঁজিবার ডাকে বিজেপির কর্মী-সমর্থকরা প্রবল উৎসাহে সাড়া দিয়াছেন, দলের মেজো-সেজো নেতারা বিভিন্ন ভাবে মন্তব্যটিকে সমর্থন জুগাইয়াছেন। টুইটারে অগ্নিহোত্রীর এক লক্ষাধিক ‘ফলোয়ার’-এর তালিকায় বিজেপির বেশ কিছু নেতা আছেন। তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিসক্রিয়। তাঁহাদের মধ্যে এক জনেরও মনে হয় নাই যে এই ভঙ্গিতে কিছু সহনাগরিকের বিরুদ্ধে লোক খেপাইবার প্রচেষ্টা অতি অগণতান্ত্রিক ও বিপজ্জনক— বিজেপির প্রথম দায় এইখানে। তাঁহার মন্তব্যের জন্য পুলিশ-প্রশাসন এখনও তাঁহার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করে নাই, ইহা বিজেপির দ্বিতীয় দায়।

আরও বড় দায় সেই পরিবেশটি সৃষ্টি করায়, যেখানে কেহ অবলীলায় এমন মন্তব্য করিয়া ফেলিতে পারে; সেই আশ্বাসটি দেওয়ায় যে সরকার-বিরোধীদের বিরুদ্ধে যেমন আক্রমণই শানানো হউক না কেন, তাহার জন্য কাহাকে কোনও সমস্যায় পড়িতে হইবে না। টেলিভিশনের সান্ধ্য তর্জার দেশপ্রেমী অ্যাঙ্কর হইতে চটুল উপন্যাস-লেখক অথবা স্বঘোষিত বাবা, প্রত্যেকেরই কি রাষ্ট্রপ্রদত্ত কবচকুণ্ডল নাই? রাষ্ট্রযন্ত্রের নেকনজরে থাকিবার জন্য কী করিতে হইবে, তাহার ফর্মুলাও পরিচিত— সরকার-বিরোধী, যুক্তিবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রতিবাদী মানুষদের প্রথমে ‘দেশদ্রোহী’ হিসাবে চিহ্নিত করিতে হইবে, এবং তাহার পর তাঁহাদের নিধনকামনা করিতে হইবে। কাহাকে দাগিয়া দিতে হইবে কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদের সমর্থক হিসাবে, কাহাকে চিহ্নিত করিতে হইবে সেনাবাহিনীর শত্রু হিসাবে, আর কাহাকে নকশাল হিসাবে। ব্যস, বাকিটুকু রাষ্ট্রযন্ত্র বুঝিয়া লইবে। এমন পরিস্থিতি তৈরির দায় না লইয়া বিজেপির উপায় কী?

Urban Naxal Social Media Narendra Modi BJP
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy