Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মারণরোগের সঙ্গে লড়াইয়ে জীবনেরই জেতার কথা

‘আই অ্যাম অ্যান্ড আই উইল’— লড়াই চালানোর আর পাশে থাকার অঙ্গীকার। এটাই ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির ‘ওয়ার্ল্ড ক্যানসার ডে’র থিম। লিখছেন অনির্বাণ জানা‘আই অ্যাম অ্যান্ড আই উইল’— লড়াই চালানোর আর পাশে থাকার অঙ্গীকার। এটাই ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির ‘ওয়ার্ল্ড ক্যানসার ডে’র থিম।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৪:৫৬
Share: Save:

ছেলেটির ফুসফুসের ভিতর ঘাপটি মেরে বসেছিল মারণরোগ। মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্ট আর বমি হচ্ছিল। মুখ দিয়ে উঠে আসছিল রক্ত। ওর লড়াইটা ছিল দেশের হয়ে। মাঠে ওকে একশো শতাংশ দিতে হবে। একশো একুশ কোটি ভারতীয়ের হয়ে ওকে যে লড়তে হচ্ছে!

২০১১ সালে আইসিসি বিশ্বকাপ। ছেলেটি হয়ে ছিল ‘ম্যান অব দ্য সিরিজ’। প্রায় তিন দশকের খরা কাটিয়ে ভারত জিতেছিল বিশ্বকাপ। বুকের ভিতর বাড়তে থাকা ক্যানসার নিয়ে ছেলেটি উড়ে গিয়েছিল আমেরিকায়। সেখানে গিয়ে আবার অন্য লড়াই। বাঁ দিকের ফুসফুসে বাসা বেঁধে থাকা ক্যানসারের জন্য চলেছিল কেমোথেরাপি। পরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসে লড়াকু ছেলেটি।

ছেলেটির নাম ভারতীয় দলের ক্রিকেটার যুবরাজ সিংহ।

নয়ের দশক এবং এই সহস্রাব্দের প্রথম দশকে অনেক যুবকের হার্টথর্ব ছিলেন তিনি। ‘সওদাগর’, ‘মন’, ‘দিল সে’, ‘বোম্বে’, ‘গুপ্ত’, ‘১৯৪২: আ লাভস্টোরি’ প্রভৃতি বাণিজ্যিক সিনেমার স্বপ্নসুন্দরী এই নায়িকা। প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপালের প্রধানমন্ত্রীর পৌত্রী ও মন্ত্রীর কন্যা। পেয়েছেন তিনখানা ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, একটি ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড সাউথ আর স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড। ২০১২ সালে তাঁর ডিম্বাশয়ে ক্যানসার ধরা পড়ে। অপারেশন হয়। ভয়ঙ্কর এই রোগের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হন তিনি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর কেশবিহীন ছবি ঘুরে বেড়ায়। যা কিনা কেমোথেরাপির পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার ফল। সেই ছবি দেখে সাধারণের মনে তাঁর প্রতি ভাললাগার সঙ্গে সঙ্গে শ্রদ্ধা মিশে যায়। আরও মানুষ তাঁকে দেখে ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হাল না ছাড়ার শপথ নেন।

মনীষা কৈরালা। বর্তমানে আবার স্বাভাবিক জীবনে ও কাজকর্মে ফিরে এসেছেন তিনি।

সেলিব্রিটি মানুষদের ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করার লিস্টটা বেশ লম্বা। সোনালি বেন্দ্রে, লিজা রে, অনুরাগ বাসু, মুমতাজকে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে বা হচ্ছে। বিদেশি সেলেবদের মধ্যে আছেন ডাস্টিন হফম্যান, মাইকেল ডগলাস, রবার্ট ডি নিরো, মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা, ওয়ারেন বুফে। ক্যানসারের সঙ্গে এই মানুষগুলো কিন্তু বুক চিতিয়ে লড়েছেন। ভয় পেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাননি। প্রতিনিয়ত লড়াই করছেন শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে এবং মানসিক ভাবেও।

‘আই অ্যাম অ্যান্ড আই উইল’— লড়াই চালানোর আর পাশে থাকার অঙ্গীকার। এটাই ২০১৯ সালের ‘ওয়ার্ল্ড ক্যানসার ডে’র থিম। ৪ ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ আজ পালিত হবে দিনটি। আর এই থিম নিয়ে আগামী তিন বছর ইউনাইটেড নেশনসের সদস্য দেশগুলি লড়াই চালাবে ক্যানসারের বিরুদ্ধে।

তাতে যেমন অংশ নেবেন ক্যানসার আক্রান্ত মানুষগুলি, তেমনই তাঁদের পাশে থাকবেন সহযোগী, সাহায্যকারী, চিকিৎসক, শিক্ষক, ছাত্র, আপনি, আমি— সবাই। জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। কারণ, কিছু কিছু ধরনের ক্যানসার প্রতিরোধ করা যায়। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ক্যানসার সচেতনতা বাড়িয়ে আটকে দেওয়া যায়। খুব তাড়াতাড়ি রোগ ধরা গেলে আরও এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে সারিয়ে তোলাও সম্ভব।

ক্যানসার নিয়ে এত চিন্তাভাবনা কেন? কারণ, সারা বিশ্বজুড়ে ম্যালেরিয়া, টিউবার কিউলোসিস ও এডস-এর মতো রোগে মিলিত ভাবে যত মানুষ মারা যান, তার চেয়ে বেশি জন মারা যান ক্যানসারে।

হিসেব অনুযায়ী, ক্যানসারে ৯.৬ মিলিয়ন মানুষ প্রতি বছরে মারা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমরা কোনও পদক্ষেপ না করলে ২০৩০ সালে ক্যানসারের থেকে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে তেরো মিলিয়ন। অথচ, ঠিকমতো পরিকল্পনা নিয়ে চলতে পারলে প্রতি বছর বাঁচিয়ে দেওয়া যাবে ৩.৭ মিলিয়ন জীবন। আর এইখানেই ‘আই অ্যাম অ্যান্ড আই উইল’-এর গুরুত্বটা। সেই পাশে থেকে লড়াই চালানোর অঙ্গীকার।

কিন্তু এই লড়াই সহজ ছিল না দশরথ ঘোষ বা হামেদা বেওয়ার-এর মতো সাধারণ মানুষের কাছে। দশরথ ঘোষের কোলন ক্যানসার ধরা পড়ার পর মনে হয়েছিল, মৃত্যু যেন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। একটু এগিয়ে গেলেই অমোঘ সত্যর বাহুপাশে জড়িয়ে যাবেন। অন্য দিকে, দশরথবাবুর বয়সও বেশি নয়। দুই মেয়ে পড়াশোনা করছে। অনেকে তাবিজ তন্ত্রের কথা বলেছিল। মেয়ে দু’টির একজন ক্লাস এইট আরেক জন সিক্স। তারা দু’জন প্রায় জেদ করে বাবাকে অপারেশন করাতে নিয়ে যায়। সমস্ত আত্মীয়-পরিজনদের বিরুদ্ধে গিয়ে। প্রায় সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়। অপারেশনের পরে কেমোথেরাপি সরকারি হাসপাতাল থেকে চলেছে।

দশরথবাবু এখন ভাল আছেন। কাজকর্মও শুরু করেছেন। বিশ্রাম নেওয়ার কথা বললে মুচকি হেসে বলেন— ‘‘মেয়ে দু’টোকে মানুষ করতে হবে না? বড় হয়ে ওদের আরও অনেক মানুষের জীবনের দায়িত্ব নিতে হবে যে!”

হামেদা বেওয়ার-এর লড়াইটা আরও কঠিন ছিল। স্তন ক্যানসার ধরা পড়ার পর একঘরে হয়ে গিয়েছিলেন হামেদা। ওঁর খুব ঘনিষ্ঠ লোকজনের মুখোশ খুলে পড়েছিল। যাদেরকে সেই ছোটবেলা থেকে মানুষ করেছেন, তারাই যেন হামেদার মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দিন গুনছিল। জায়গা-জমি মন্দ নয় তাঁর। মৃত স্বামীর পেনশন পান নিয়ম করেই। কারও তোয়াক্কা না করে নিজেই এসেছিলেন সদর হাসপাতালে। এমনকি, ডাক্তারের চোখ কপালে তুলিয়ে দিয়ে ‘হাই রিস্ক কনসেন্ট’-এ নিজেই সই করে দেন হামেদা। অপারেশনের পরে হামেদারও কেমোথেরাপি চলে।

বর্তমানে সুস্থ হয়ে ওঠা হামেদা জানান, তাঁর সম্পত্তি দান করে যাবেন এমন কোনও সংগঠনকে যাঁরা মানুষ বিপন্ন হলে পাশে দাঁড়াবে। মুখোশের ভিতরের মানুষকে দেখতে-চিনতে শিখে গিয়েছেন যে হামেদা।

নদিয়া জেলা হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত ক্যানসার-বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এস পি বিশ্বাস জানালেন যে, অনেক রোগী মনের জোর ধরে রাখতে পারেন না। আর ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইয়ে মনের জোর ভীষণ ভাবে প্রয়োজন। জেলা হাসপাতালে কেমোথেরাপির জন্য পাঁচটি পুরুষ এবং তিনটি মহিলাদের শয্যা আছে। প্রায়শই তিন-চার জনকে একসঙ্গে কেমো দিতে হয়। বিভাগে ডাক্তার আছেন দু’জন। আশি থেকে নব্বই শতাংশ ক্যানসারের ওষুধ হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যেই পাওয়া যায়।

একটা সময় কবিগুরু খুব মানসিক এবং শারীরিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, মৃত্যুর বুঝি আর দেরি নেই। মনের জোর ও চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন— ‘‘তস্য ছায়ামৃতং তস্য মৃত্যু— মৃত্যু যাঁর ছায়া অমৃতও তারি ছায়া। এতদিনে আবার সেই অমৃতেরই পরিচয় পাচ্চি।”

আর হাজার হাজার ক্যানসার আক্রান্ত মানুষকে সেই অমৃতের পরিচয় পাওয়াতে হবে। তাঁদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে হবে— আই অ্যাম অ্যান্ড আই উইল। মারণরোগের সঙ্গে লড়াইয়ে যে জীবনেরই জেতার কথা। শুধু পাশে ভরসার হাতগুলো থাকা চাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cancer World's cancer day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE