Advertisement
E-Paper

গ্রন্থের কথা শোন তো!

আরে, ইজম-গুলো তো জানতে হবে! এ তো সস্তা নকুলদানা নয়, নকড়াছকড়া করে কয়েকটা খেলাম কয়েকটা রাস্তায় ছড়ালাম! যখন কথা বলব, ওজন করে বলতে হবে। কোনটা স্বৈরতন্ত্র, কোনটা ফ্যাসিবাদ, সব নিখুঁত জানতে হবে, ফুটনোটসহ হজম করতে হবে।

শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০

আরে, ইজম-গুলো তো জানতে হবে! এ তো সস্তা নকুলদানা নয়, নকড়াছকড়া করে কয়েকটা খেলাম কয়েকটা রাস্তায় ছড়ালাম! যখন কথা বলব, ওজন করে বলতে হবে। কোনটা স্বৈরতন্ত্র, কোনটা ফ্যাসিবাদ, সব নিখুঁত জানতে হবে, ফুটনোটসহ হজম করতে হবে। তবে রাজনীতিতে আসতে হবে, মানে, বামপন্থী রাজনীতিতে। এটা একটা পড়াশোনা করা পার্টি। খবরকাগজের নিবন্ধে আমি ঠিকই তো লিখেছি, বিজেপি মোটেই ফ্যাসিস্ট পার্টি নয়। আরএসএস-এর সঙ্গে তার টিকি বাঁধা থাকলেও নয়। ফ্যাসিবাদ কাকে বলে আমি বইয়ে স্পষ্ট পড়েছি। যত ক্ষণ না সে সংজ্ঞা টায়ে-টায়ে মিলে যাচ্ছে, খামকা একটা পার্টিকে ফ্যাসিস্ট বলব কেন, যতই সে আমার জন্মশত্তুর হোক! এটা কী ধরনের রাজনীতি, যে, আমার গালাগালের সুবিধের জন্যে আমি সব কিছুকেই বেঁকিয়েচুরিয়ে একটা গোলা-পাবলিকের পছন্দসই কিন্তু আবোঝা বিশেষণে ঢেলে দেব! যারা চিল্লামিল্লি করছে, সিপিএম হয়ে আমি বিজেপি-কে শুধু স্বৈরাচারী বলেছি কেন, অ-ফ্যাসিস্ট বলে তাদের ছাড় দিয়েছি কেন, তারা ভাল করে পড়েনি। আর যে পড়েনি, সে পড়েছে। মানে, আমার ক্লাস থেকে বহুত নীচে পড়ে গেছে মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গেই। অতটা নীচে তাকিয়ে আমি জবাব দেব না। রুচিতে বাধে, ঘাড়েও লাগে।

হ্যাঁ, ঘাড়টা আমার একটু শক্ত। অনেকে তা নিয়ে টিটকিরি মারে, কিন্তু সে সব হাবিজাবি মিসাইলের ভয়ে আমার ব্রেন কম্পিত হবে! সেই যে বছর আটেক আগে, ইউপিএ সরকার আমেরিকার সঙ্গে কী সব এবিসি চুক্তি করবে বলল, আর আমি বললাম সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে হাত মেলালেই সমর্থন তুলে নেব, সব্বাই তো আমায় পইপই বারণ করেছিল। এমনকী আদারওয়াইজ নিশ্চুপ ও বিরোধিতা-ভীত মনমোহন সিংহ অবধি বললেন, পরোয়া করি না, চুক্তি করবই। আর ধাঁ করে মুলায়ম সিংহ যাদব এসে ইউপিএ-কে বাঁচিয়ে দিলেন। মাঝখান থেকে আমরা সমর্থন প্রত্যাহার করে হাঁ-করা হাবলা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আর সেই যে কংগ্রেস আমাদের কাছ থেকে সরে ক্রমে ক্রমে তৃণমূলের দিকে চলে গেল, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের পতনের চিত্রনাট্যের হুড়হুড় শুরু। মানছি, মুখ পুড়ল, ঘর পুড়ল, কপাল পুড়ল। কিন্তু নীতি তো পুড়ল না। রোম পুড়ল, কিন্তু আমার ব্যায়লা তো অদগ্ধ প্যাঁ-পোঁ!

আমার তাত্ত্বিক গোঁয়ার্তুমির জন্য সিপিএম বাংলার মতো একটা দুর্গ হারিয়ে, এখন ফুটো তেরপলের তলায় মাঠে বসে আছে। এই তো? বেশ হয়েছে। আমার কথা হল, যায় যদি যাক প্রাণ, বই আমার ভগবান। তাত্ত্বিক গোঁয়ার্তুমি বলে কিছু হয় না। তাত্ত্বিক আনুগত্য বলে হয়, তাত্ত্বিক বিশ্বাস বলে হয়, তাত্ত্বিক সমর্পণ বলে হয়। তত্ত্বই সব, সমস্ত, কারণ তা দুরন্ত মনীষীরা প্রাণপণ আইডিয়া নেড়েঘেঁটে নিশ্চিত বুঝে লিখেছেন। উতরোল ঢেউ এলে যারা ভয় পেয়ে তত্ত্বের নৌকো ছেড়ে হাতে-গরম লাভের লাইফবোটে লাফ দেয়, তারা ক্ষীণপ্রাণ, ভিতু, শিরদাঁড়াহীন। সর্বোপরি, তারা নাস্তিক!

অনেকে বলে, বাস্তব বলে একটা ব্যাপার আছে, তা নাকি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেন? তা চারপাশে ঘটে চলেছে বলে? তা আমাকে কেটে কুচিকুচি ভেঙে গুঁড়োগুঁড়ো করতে পারে বলে? কী মুশকিল, শুধু সেই জন্যে তাকে মাথায় তুলে নাচতে হবে! বাস্তব কী ও কেন, আর কী-ই বা তার হওয়া উচিত, এ সবই তো বইয়ে ব্যাখ্যা করা আছে। তবে আমি শুধু শুধু মুখ তুলে তার মোকাবিলা করতে যাব কেন? সেরেফ নোটবইয়ের দিকে তাকাব। তাতে যদি না লেখে, পাগলা ষাঁড়ে করলে তাড়া কেমন করে ঠেকাব তায়— তা হলে ধরে নেব পাগলা ষাঁড় বলে কিছু হয় না, সে কখনও তাড়া করতেই পারে না, তাই ঠেকাবার কোনও সমস্যাই তৈরি হতে পারে না। বাস্তব যদি বইয়ের সঙ্গে না মেলে, বইয়ের দোষ? কক্ষনও না! বাস্তবের দোষ।

এই সিধে কথাটা যারা বোঝে না, তারা ছিঁচকে রাজনীতিক। তারা মুখে যাকে বলে রিয়েলপলিটিক, তার আসল মানে ধান্দাবাজি। মুখে যাকে বলে প্র্যাগম্যাটিজম, আসলে তার মানে সুবিধাবাদ। তাদের কথা মেনে সেই পার্টি চলতে পারে, যারা ক্ষমতা দখল করে পয়সা লুটতে চায়। কিন্তু সেই পার্টি চলতে পারে না, যারা মানুষের ভাল করে ইতিহাসে নাম লিখতে চায়।

এই যেমন ওই ছোঁড়াটা, যে জেএনইউ-এর ঘোটালাটায় তালেগোলে হিরো হয়ে গেল। সে চেঁচাচ্ছে, আমি নাকি ভয় পেয়ে গেছি, যেন নিউ ইয়র্কে পালাই, লড়াইগুলো ওরা লড়বে! আস্পদ্দা! জেএনইউ-তে এসএফআই কারা গড়েছিল খবর রাখিস! ওইটুকু একটা ক্যাম্পাসের মধ্যে মস্তানি ফলাচ্ছিস আর সর্বভারতীয় নেতাকে বানপ্রস্থে পাঠাচ্ছিস! এই ঔদ্ধত্য আসে অশিক্ষা থেকে। এই চটজলদি বিপ্লব আসে ফেসবুক থেকে। এই চিৎকারবাচক ক্রোধ-বিজ্ঞাপন আসে ম্যাক্রোদৃষ্টির অভাব থেকে। ভয় আবার কী রে! আমাদের ভয় নেই, লজ্জা নেই, মান নেই। যা আছে, তা হল জ্ঞান। সেই অনুযায়ী আমি চলব, তাতে পৃথিবী রসাতলে যায়, যাবে। পৃথিবী অবশ্য মোটামুটি ঠিকই আছে, পার্টি রসাতলে গেছে। তা যাক না। আছে দুঃখ, আছে ডেথ-ও, তাই বলে নীতি লাথিয়ে বাঁচা কি অভিপ্রেত!

আর এই এক হয়েছে ইয়েচুরি, আমার লেখার বিরোধিতা করছে। এই তো কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলালি এ বারের ভোটটায়। কী হল? লোকে তোর বাস্তববোধকে তালিয়াঁ দিল? ওরে, মানুষ যতই অগাবগা হোক, দিনের শেষে তার প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। সে শেষমেশ আদর্শের কাছেই ফিরবে। যেমন গরু বহুত ল্যাজ-দাপাদাপি করে সন্ধেয় ঠিইক গোয়ালে ফিরে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। অপেক্ষা করতে হবে। তা লাগুক না দশ বিশ একশো বছর। এক জীবনে সফল হতে হবে কে বললে? শুধু আমাকে নিয়ে একটা মহাবই লেখা হবে কি না, এইটুকু টেনশনে কাটাচ্ছি!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy