Advertisement
E-Paper

সব চরিত্র কাল্পনিক

৫৯৭ ফুট উচ্চ মূর্তির উদ্বোধনের পর যখন বাগ্‌বিস্তার চলিতেছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই কোনও এক সমান্তরাল বিশ্বে এক ক্ষীণকায়, স্বল্পবস্ত্র বৃদ্ধের পদতলে বসিয়া ছিলেন দুই বিরলকেশ পুরুষ।

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৮ ০০:৫৭
গুজরাতে সর্দার পটেলের ‘বিশাল’ মূর্তি উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: রয়টার্স।

গুজরাতে সর্দার পটেলের ‘বিশাল’ মূর্তি উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: রয়টার্স।

৫৯৭ ফুট উচ্চ মূর্তির উদ্বোধনের পর যখন বাগ্‌বিস্তার চলিতেছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই কোনও এক সমান্তরাল বিশ্বে এক ক্ষীণকায়, স্বল্পবস্ত্র বৃদ্ধের পদতলে বসিয়া ছিলেন দুই বিরলকেশ পুরুষ। তাঁহাদের সম্মুখে টেলিভিশনসদৃশ ভার্চুয়াল রিয়ালিটির যন্ত্র, তাহাতে বক্তৃতা শোনা যাইতেছে। বৃদ্ধ বলিলেন, অনেক কিছুই লইয়াছে, কিন্তু সবটা পারে নাই। আমার চশমা লইয়াছে, চরকা লইয়াছে; তোমার জ্যাকেট লইয়াছে, কিন্তু নামটি ফেলিয়া দিয়াছে— এখন তাহা নূতন নামে দক্ষিণ কোরিয়ায় যাইতেছে; আর, তোমাকে তো সশরীরেই লইয়াছে, শতগুণ বর্ধিত করিয়া। কিন্তু যাহা লইয়াছে, সবই বহিরঙ্গের, জীর্ণ বস্ত্রের ন্যায়। অস্ত্র, অগ্নির অতীত আত্মাকে তাহারা ছুঁইতে পারে নাই। আমরা ভারত বলিতে যাহা বুঝিয়াছিলাম, তাহা চশমা-চরকায় ছিল না, জ্যাকেটেও নহে, শরীরেও নহে। সেই ভারত ছিল আমাদের আত্মায়, আর আমাদের আত্মা ছিল ভারতে। সেই আত্মা ছিল হরিজনের বসতিতে— আজ দলিতদের বিবস্ত্র করিয়া রাস্তায় ফেলিয়া প্রহার করে শাসক দলের বাহুবলীরা। সেই আত্মা ছিল অন্ত্যোদয়ে। যে দেশে অক্সিজেনের বিল মেটানো হয় নাই বলিয়া হাসপাতালে শিশুদের মরিতে হয়, সেই দেশেই তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মূর্তি নির্মাণ করা হয়— দেশের আত্মাকে চিনিলে কি তাহা সম্ভব? দুনিয়ার উচ্চতম মূর্তি স্থাপনের অশালীন দম্ভ যেখানে থাকে, সেখানে কি সেই ভারত-আত্মার ঠাঁই হইতে পারে?

বৃদ্ধের দক্ষিণপার্শ্বে আচকান-চুড়িদার পরিহিত সৌম্য প্রৌঢ়। বামপার্শ্বে ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত প্রৌঢ় তাঁহার দিকে চাহিয়া হাসিলেন। বলিলেন, দেশের একতা কি শুধু করদ রাজ্যগুলিকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত করাতেই নিশ্চিত হইয়াছিল? দেশ বলিতে কি শুধু একটি ভৌগোলিক পরিসর বোঝায়, বন্দুকধারী সৈনিক খাড়া করিয়া রাখিলেই যাহার অখণ্ডতা বজায় থাকে? এই ম্লান ভারতবর্ষ, একশৈলিক গর্বের মতো মাথা উঁচাইয়া থাকা মূর্তি নির্মাণ করিতে যে ভারতবর্ষের পঁচাত্তরটি গ্রাম হইতে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হইল, যাহাদের যথার্থ পুনর্বাসন হইল না, যাহাদের সেচের জলের ব্যবস্থা হইল না, তাহাদের বাদ দিয়া কি দেশের একতা হয়? বিক্ষুব্ধ আদিবাসীদের আটক করিয়া রাখিয়া একতা সম্ভব? আসলে এই মূর্তি আমারও নহে, একতারও নহে— নামে কী বা আসে যায়। এই মূর্তি শুধুমাত্র নেহরু-বিরোধিতার। আমাদের বিবাদের কথা প্রচলিত, অতএব আমাদের প্রতিপক্ষ ঠাহরাইয়া লইতে সমস্যা হয় নাই। অশিক্ষার এই এক সুবিধা, অনেক কিছুই না জানিলে চলে। আমাদের পরস্পরের প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধার কথা না জানিলে চলে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বিষয়ে আমার বিতৃষ্ণার কথা না জানিলে চলে।

দ্বিতীয় প্রৌঢ় বৃদ্ধের উদ্দেশে বলিলেন, বাপু, আপনি তো জানেন, অনেক প্রশ্নেই আপনার সহিত একমত হইতে পারি নাই। বৃহৎ শিল্পকে উপেক্ষা করিয়া গ্রাম স্বরাজের দর্শন, পুঁজিপতিদেরই জাতির সম্পদের অছি ভাবিয়া লওয়া আমার নিকট কখনও যুক্তিগ্রাহ্য ঠেকে নাই। সর্দারের সহিতও মতানৈক্য থাকিয়াছে। শিল্পপতিদের প্রতি তাঁহার পক্ষপাত, অথবা মুসলমান দুষ্কৃতীদের প্রতি কঠোর মনোভাবকে আমি যথেষ্ট ন্যায্য জ্ঞান করি নাই। পরে ভাবিয়া দেখিয়াছি, আমার নিজেরও ভুল ছিল। আধুনিক ভারতের মন্দির গড়িবার সময় আদিবাসীদের স্বার্থের কথাটিকে আমি তেমন গুরুত্ব দিই নাই। দেওয়া উচিত ছিল। আপনারা থাকিলে হয়তো সেই ভুল ধরাইয়া দিতেন। আমাদের মতভেদ ছিল, কিন্তু ভারত বলিতে আমরা যাহা বুঝিতাম, তাহা ভিন্ন ছিল না। সেই ভারতকে কোন মানবিক উচ্চতায় লইয়া যাওয়া জরুরি, সেই প্রশ্নে মতান্তরের তিলমাত্র ছিল না। যে পথেই হউক, প্রান্তিকতম মানুষের ক্লেশ দূর করা, জীবনপথের সুযোগ পৌঁছাইয়া দেওয়া ছিল লক্ষ্য— জন্মগত উচ্চাবচতা যাহাতে জীবনের সম্ভাবনাকে প্রভাবিত না করিতে পারে, তাহাই ছিল দেশ-দর্শন। জাতির যতখানি সম্পদ, তাহার প্রতিটি কড়ি যাহাতে স্বাধীন দেশের ভবিষ্যতের কাজে লাগে, তাহাই ছিল কাঙ্ক্ষিত। তিন হাজার কোটি টাকায় দেশের সম্পদ ও মানবসম্পদ নির্মিত হইলে বোধ করি আমাদের অপেক্ষা বেশি খুশি কেহ হইতেন না।

আলোচনা থামিল। বৃদ্ধ অতি মৃদু স্বরে গান ধরিলেন— ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’। অযোধ্যার মন্দিরে নহে, ভারতের আত্মায় থাকা রাম সেই সন্ধ্যার সুর শুনিলেন নিশ্চয়।

Mahatma Gandhi Jawaharlal Neheru Statue of Unity
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy