সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি প্রত্যঙ্গকে আর একটি শরীর কী ভাবে গ্রহণ করছে, তার উপর নির্ভর করে সামগ্রিক ভাবে দেহটির স্বতঃস্ফূর্ত চলনশক্তি ও কর্মক্ষমতা। অপরকে গ্রহণের এই প্রক্রিয়ায় একটা পরস্পরবিরোধী সত্তা কাজ করে। অভিবাসীদের পরিস্থিতি অনেকটা সে রকমই। অভিবাসী নিজভূমে স্বচ্ছন্দ ও সন্তুষ্ট নয় বলেই তার পরবাসযাত্রা। কিন্তু পরভূমিকে সে আঁকড়ে ধরলেও সেখানে তার সামাজিক স্বীকৃতি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে। স্থানীয় মূলধারার সংস্কৃতিকে সে হজম করতে না পারলেও মেনে নিতে হচ্ছে, আবার সেই জমিতেই নিজস্ব সংস্কৃতির বীজ থেকে চারাগাছ রচনার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে সে, যা তার স্বপ্নানুযায়ী এক দিন হয়তো মহীরুহ হবে। এই ভাবনাকে অনুসরণ করেই সে অব্যাহত রাখে তার কর্মক্ষেত্রে স্থানীয় লোক-সংসর্গ, আর বাকি সময়টুকু জুড়ে থাকে তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে আবদ্ধ সমবায়-কেন্দ্রিক সামাজিক জীবনযাত্রা। এ হল মূলত দু’নৌকোয় পা দেওয়া অনাবাসী-অবস্থান।
সমগ্র ভূমণ্ডলের সমস্যাজর্জরিত দেশগুলোর সীমান্ত জুড়ে ছেয়ে আছে হয় যুদ্ধের দাঙ্গার তাণ্ডব, অথবা শরণার্থী নিয়ে অসন্তোষ। তুলনামূলক ভাবে অনুন্নত-দরিদ্র একটা দেশের মানুষের ঢল উন্নত দেশের দিকে ধাবমান হয়— কখনও নিরাপত্তার প্রশ্নে, কখনও-বা উন্নত মানের জীবনের স্বপ্নে। একটি দেশ থেকে চারাগাছ উপড়ে অন্য দেশের অজানা অপরিচিত মাটিতে পুঁতে দিলে তার টিকে থাকা ও বেড়ে ওঠা সহজ কাজ নয়। একই কথা প্রযোজ্য শিকড়হীন অভিবাসীর ক্ষেত্রেও। যারা পরভূমের মাটির জল-হাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে, নিজস্ব সংজ্ঞায় বাসযোগ্যতা অর্জনের শর্ত খুঁজে নেয়।
যেমন এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইনত অনুমোদিত অভিবাসী-নাগরিক ছাড়াও, আইনানুগ নথিপত্রহীন বহু অবৈধ উদ্বাস্তু এই দেশে দিন যাপন করে বাঁচে, নিজস্ব এক সমাজ তৈরি করে। শহরের বুকেই বেআইনি মেক্সিকান শরণার্থীরা, মাটি থেকে বেশ উপরে গাছের সংলগ্ন ‘ট্রেলার’ নামের অস্থায়ী আস্তানা নাকের ডগায় রেখে ঘুরে বেড়ায়। অধিকাংশেরই সন্তান জন্মসূত্রে এখানকার নাগরিক হলেও এরা নয়। জেনেশুনেও এ সব দিব্যি এড়িয়ে চলতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের। কারণ এমন অসংখ্য বেআইনি অভিবাসীর জন্য অগুন্তি কারাগার কোথায়? এদের কেউ কেউ ভাগ্যকে বাজি রেখে গাড়ি চালায়। ধরা পড়লে আঠারো ঘা। স্বাস্থ্য বিমা নেই, পার্মানেন্ট রেসিডেন্স সার্টিফিকেট নেই, ড্রাইভার্স লাইসেন্স নেই। সরাসরি পড়তে হয় মোটা জরিমানা ও মামলার মুখে।
অন্য সমস্যাও আছে। মনোবাসনা পূরণের পর নতুন দেশটির প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কোনও প্রতিদানের আগ্রহ শুরুর দিকে থাকে না অধিকাংশ অভিবাসীর। কিন্তু সময়ের সঙ্গে দেখা যায়, তারা নিজেরা জাতিগত বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর হলেও, এক সময় সঙ্কর প্রজাতি হিসেবে ‘ল্যান্ড অব ইমিগ্র্যান্ট’ নামের অবদানের উপকরণ হয়ে গিয়েছেন নিজের অজান্তেই।
ভৌগোলিক নিয়মের আবশ্যিকতায়, পাশাপাশি অবস্থিত দু’টি ভিন্ন জাতির মধ্যে জাতীয়-মিশ্রণ অবশ্যম্ভাবী। তাই বোধ হয় সাংস্কৃতিক আলিঙ্গনের উদাহরণ হয়ে, প্রকাশ্য ভাবে শপিং মল-এ জাতীয় বিপণন কোম্পানির ন্যাশনাল চেন দেওয়ালি উদ্যাপন করছে, দোকানের শাখা ভারতীয় বাজার সামগ্রীর বিভাগ তৈরি করছে, যেখানে পাওয়া যাচ্ছে ‘সাধনা বাসমতী চাল’। একই রকম সত্যি, জর্জিয়ার আলফারেট্টা শহরের জনপ্রিয় বিপণিতে সাদা চোখের নিরিখে অনাবাসীদের ভিড়ে শ্বেতাঙ্গরাই যেন সংখ্যালঘু। সেই কারণেই তাকে অনাবাসীরা মজা করে নাম দিয়েছে: আলফাপুরম্।
আবার অন্য দিক থেকে ভাবলে, দু’টি দেশের সাংস্কৃতিক মিশ্রণ সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করলেও, অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে বেনোজলের মতো ঢুকে পড়ে অনুপ্রবিষ্ট দেশটির সংস্কৃতি ও মানসিকতা, যা হয়তো মূল দেশটির চরিত্রহননের সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত রেখে দেয়। দেশ থেকে মানুষটিকে উপড়ে অন্য দেশে আনা যায়, মানুষটির ভিতর থেকে দেশকে বার করা সত্যিই দুষ্কর। তাই হয়তো পার্টির জন্য পোশাক কিনে, ব্যবহার করে, পোশাকি দোকানে তিন দিন পর ফেরত দেয় অনাবাসী। এই ছলচাতুরি ধরতে পেরে বিপণন তালিকার ‘লাইফটাইম ওয়ারান্টি’ তুলে নিয়েছে একটি কোম্পানি। বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টায় হয়তো ছুরি ধার করার যন্ত্রের ডেমো দিচ্ছে বিক্রেতা— কেনার আগ্রহ না দেখিয়ে অনাবাসী বলে ওঠে, ‘‘বাড়ির সব ক’টি ছুরি এখানে আনলে করে দেবে?” পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় যে দেশ শুচিবায়ুগ্রস্ত, সে দেশে গণেশ চতুর্দশীর দিন সুইমিং পুলে গণেশকে চান করাতেও পিছপা হয় না অনাবাসী।
তবুও অভিবাসী আগমন বন্ধ হওয়ার নয়, স্তব্ধ হওয়ার নয় দ্বিজাতিক সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বও। ইতিহাসের প্রয়োজনেই এই মানবিক সমস্যাগুলোর সৃষ্টি হয়তো। ‘সফটওয়্যার কোডিং’-এ যেমন ভারতীয়রা, তেমনই রাস্তা মেরামত, বাড়ি তৈরি— শ্রমসাধ্য কাজ সবই মেক্সিকান-নির্ভর। কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর অভাবই আমেরিকার মূল সমস্যা। জর্জিয়ার রাস্তায় বেকার শ্রমিকদের বসে থাকতে দেখেছি, যদি কেউ কায়িক শ্রমের জন্য নিয়ে যায়।
যদি আক্ষরিক অর্থে অনাবাসী আগমন বা অভিবাসী অনুপ্রবেশ রোখা যায়, তা হলে ফল হিসেবে সঙ্গে সঙ্গে দেশটির জাতীয় অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। তা ছাড়া, সীমান্ত সিল করে দেওয়া হলে এই বিশ্বায়নের যুগে, ‘মহামিলনের সাগরতীরে’-র ভাবনার বলিদান হবে যে! সুতরাং প্রশ্ন ওঠে, এই সমস্যার সমাধান কী?
প্রত্যেকটি দেশের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রাখার অধিকার অবশ্যই আছে। আবার বৈচিত্র ও ঔদার্যের মধ্যেও একটা জাতির পরিপূর্ণতা প্রকাশ পায়। তাই বহুজাতিকতার মিশ্রণ অব্যাহত থাকুক। কিন্তু অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের স্রোত বন্ধের জন্য চাই সুনির্দিষ্ট, বুদ্ধিদীপ্ত আইন, যা দেশীয় অর্থনীতির চাহিদাভিত্তিক ও কর্মদক্ষতা ভিত্তিক নানা ক্ষেত্রের জন্য সাময়িক ভিসা অনুমোদন করবে।
বাস্তব হল, ওবামা সরকারের সময় নির্বাসনের সংখ্যা বর্তমান সরকারের সময় থেকে ঢের বেশি। কিন্তু এই অনুপ্রবেশ-রোধের নীতিটি রিপাবলিকানদের নির্বাচনী প্রচারের তুরুপের তাস বলে, সংখ্যার হিসেবে না গিয়ে নিরুত্তর থাকাই শ্রেয় বলে মনে করে তারা। তাই এ ভাবেই মূল সমস্যাটির চোখে ঠুলি ও মাথায় টুপি পরিয়ে, অভিবাসী সমস্যাকে ঘিরে যেমন এত দিন ঘোঁট পাকিয়ে এসেছে, তেমন ভবিষ্যতেও পাকাবে নিরন্তর রাজনীতির কূটনৈতিক-কৌশলের জট ও জটিল জাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy