বাঙালি জাতি ও সংস্কৃতির বিবর্তনে আমাদের আইকনরা কয়েক প্রজন্ম ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমর্ত্য সেন প্রমুখ যে কী ভাবে বাংলার সামাজিক চালচিত্র গঠনে ও নৈতিক বুননে অবদান রেখে গিয়েছেন, আমরা তা সচরাচর খেয়াল করি না। আজকের বাঙালির পরিচিতিটা কিন্তু তাঁদেরই গড়ে-দেওয়া। আর, তাঁদের মধ্যে একটি মিলও লক্ষণীয়। সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে যুদ্ধটা জিততে তাঁদের অবস্থান একই রকম এবং সুস্পষ্ট। কেবল স্বামী বিবেকানন্দের জীবন ও কাজ খুঁটিয়ে দেখলেই তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। শুধু সামনে তাঁর জন্মদিন আসছে বলে নয়, নানা কারণেই মনে হচ্ছে, তিনি ঠিক কী বলে গিয়েছেন সেটা আবারও আমাদের মনে করা এবং করানো প্রয়োজন। তিনি তো কেবল উপদেশ দেননি। নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়েছেন, কেমন ভাবে বাঁচা উচিত।
এই যেমন, সরফরাজ হোসেনকে আলমোড়া থেকে তাঁর লেখা চিঠিতে পাই (১০ জুন ১৮৯৮), ‘‘...অদ্বৈতবাদ ধর্মের এবং চিন্তার শেষ কথা, কেবল অদ্বৈতভূমি হইতেই মানুষ সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়কে প্রীতির চক্ষে দেখিতে পারে। আমার বিশ্বাস যে, উহাই ভাবী শিক্ষিত মানবসমাজের ধর্ম। হিন্দুগণ অন্যান্য জাতি অপেক্ষা শীঘ্র শীঘ্র এই তত্ত্বে পৌঁছানোর কৃতিত্বটুকু পাইতে পারে, কারণ তাহারা হিব্রু কিংবা আরব-জাতিগুলি অপেক্ষা প্রাচীনতর; কিন্তু কর্মপরিণত বেদান্ত— যাহা সমগ্র মানবজাতিকে নিজ আত্মা বলিয়া দেখে এবং তদনুরূপ ব্যবহার করিয়া থাকে— তাহা হিন্দুগণের মধ্যে সর্বজনীনভাবে এখনও পুষ্টিলাভ করে নাই।’’
‘‘পক্ষান্তরে আমাদের অভিজ্ঞতা এই যে, কখনও যদি কোন ধর্মের দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনে এই সাম্যের কাছাকাছি আসিয়া থাকে, তবে একমাত্র ইসলাম ধর্মের লোকেরাই আসিয়াছে; এইরূপ আচরণের যে গভীর অর্থ এবং ইহার ভিত্তিস্বরূপ যে-সকল তত্ত্ব বিদ্যমান, সে-সম্বন্ধে হিন্দুদের ধারণা পরিষ্কার এবং ইসলামপন্থিগণ সে-বিষয়ে সাধারণতঃ সচেতন নয়। এই জন্য আমাদের দৃঢ় ধারণা যে, বেদান্তের মতবাদ যতই সূক্ষ্ম ও বিস্ময়কর হউক না কেন, কর্মপরিণত ইসলামধর্মের সহায়তা ব্যতীত তাহা মানব-সাধারণের অধিকাংশের নিকট সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক। আমরা মানব-জাতিকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই— যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরানও নাই; অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরানের সমন্বয় দ্বারাই ইহা করিতে হইবে। মানবকে শিখাইতে হইবে যে, সকল ধর্ম ‘একত্বরূপ সেই এক ধর্মে’রই বিবিধ প্রকাশ মাত্র, সুতরাং যাহার যেটি সর্বাপেক্ষা উপযোগী সেইটিকেই সে বাছিয়া লইতে পারে। আমাদের নিজেদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলামধর্মরূপ এই দুই মহান মতের সমন্বয়ই... একমাত্র আশা। আমি মানসচক্ষে দেখেছি এই বিবাদ-বিশৃঙ্খলা ভেদপূর্বক ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ লইয়া মহা মহিমায় ও অপরাজেয় শক্তিতে জাগিয়া উঠিতেছে।’’