Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

দিন-রাতের টেস্ট ক্রিকেট, না সবার ঘরে সুস্থায়ী বিদ্যুৎ?

যে কোনও স্টেডিয়ামেই সাধারণত প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়। আমাদের দেশের যে কোনও বড় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এর পরিমাণ মাসে প্রায় ৪ লক্ষ কিলোওয়াট-ঘণ্টা, অর্থাৎ বছরে ৪৮ লক্ষ কিলোওয়াট-ঘণ্টা ।

ইডেন গার্ডেনস।

ইডেন গার্ডেনস।

আদিত্য ঘোষ
জার্মানি শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৯ ০১:১৮
Share: Save:

ভাগ্যিস ইডেনে ভারত-বাংলাদেশের ‘ঐতিহাসিক’ দিন-রাতের টেস্ট আড়াই দিনেই শেষ হয়েছে! বিরাট কোহালির দল বাকি আড়াই দিনের বিদ্যুৎ সাশ্রয় করার জন্যে নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

যে কোনও স্টেডিয়ামেই সাধারণত প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়। আমাদের দেশের যে কোনও বড় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এর পরিমাণ মাসে প্রায় ৪ লক্ষ কিলোওয়াট-ঘণ্টা, অর্থাৎ বছরে ৪৮ লক্ষ কিলোওয়াট-ঘণ্টা । এই হিসেবের মধ্যে অবশ্য ফ্লাডলাইটের বিদ্যুৎ খরচ ধরা নেই। এক দিনের আন্তর্জাতিক আর আইপিএল ম্যাচের হিসেবে ফ্লাডলাইটের বিদ্যুৎ খরচা ধরলে এর পরিমাণ হবে বছরে আন্দাজ প্রায় ৬২ লক্ষ কিলোওয়াট-ঘণ্টা। অর্থাৎ, দেশের এক একটা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সারা বছর যত বিদ্যুৎ লাগে, তা দেশের ৫৭৪০টি বাড়ির গড় বাৎসরিক বিদ্যুৎ খরচের সমান।

দেশের অন্তত ২৫টি ক্রিকেট স্টেডিয়াম ধরলে হিসেব দাঁড়ায়, প্রায় দেড় থেকে দু’লক্ষ বাড়ির বাৎসরিক ব্যবহারের উপযুক্ত বিদ্যুৎ আপাতত আমাদের ক্রিকেট স্টেডিয়ামগুলি ব্যবহার করছে। আমাদের দেশের পরিবারপিছু বিদ্যুৎ খরচ এখনও খুবই কম। উন্নত দেশেও এই অনুপাত কিন্তু বেশ চমকপ্রদ। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত মেলবোর্ন স্টেডিয়ামে খেলার মাসে প্রায় ১৬.৫ লক্ষ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়, যা সেখানকার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের প্রায় ৪০০০ বাড়ির মাসিক বিদ্যুৎ ব্যবহারের সমতুল্য।

এই হিসেবটা মনে রাখার কারণ খুবই সরল। যে পরিমাণ হইচই ইডেনের দিন-রাতের টেস্ট ম্যাচকে নিয়ে হল, তাতে অনুমান করা যায়, এর জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়বে। অথবা, বাড়িয়ে নেওয়া হবে। আরও বেশি দিন-রাতের টেস্ট ম্যাচ আয়োজিত হবে আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। অতএব, এই বিদ্যুৎ খরচ এক লাফে বহু গুণ বাড়বে, কারণ টেস্ট ম্যাচ পাঁচ দিনের খেলা। অর্থাৎ, পাঁচটি এক দিনের ম্যাচের সমান। এমনিতেই টি-টোয়েন্টি আর আইপিএল-এর কল্যাণে দিন-রাতের এক দিনের ম্যাচের সংখ্যা বাড়ছে। তার ওপর যদি পাঁচ দিনের খেলাও ফ্লাডলাইটে হতে শুরু করে, তা হলে শুধু ক্রিকেট বাবদই আমাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে। শুধু তা-ই নয়, বিদ্যুতের এই ব্যবহার দেশের প্রান্তিক মানুষের বিদ্যুতের অধিকারের দাবিকে খর্ব করবে।

সাধারণ মানুষ কতখানি বিদ্যুৎ পাচ্ছেন? গোটা দুনিয়ার তুলনায় ভারত কোথায় দাঁড়িয়ে? ওয়ার্ল্ড এনার্জি ইনস্টিটিউট বা বিশ্ব শক্তি প্রতিষ্ঠান অক্টোবর মাসে প্রকাশিত তার সাম্প্রতিকতম ‘ট্রাইলেমা ইনডেক্স ২০১৯’-এ, ভারতকে ১০৯ নম্বর স্থান দিয়েছে। ব্যাপারটা খুব গৌরবজনক নয়। পাকিস্তান রয়েছে ১১০তম স্থানে। বাংলাদেশ ১১৪ নম্বরে। শ্রীলঙ্কা আমাদের অনেক আগে, ৮৫ নম্বরে। আফ্রিকার অনেক অনুন্নত দেশও ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে এই সূচকে। আমাদের মতোই বড়, উন্নয়নশীল দেশ ব্রাজিল রয়েছে ৩৯ নম্বরে। এই সূচক থেকে কী বুঝব? সমীক্ষাটির তিনটি বিভাগ। প্রথম হল এনার্জি সিকিয়োরিটি বা শক্তি-নিরাপত্তা। অর্থাৎ, দেশের কত অংশ মানুষ নির্ভরযোগ্য শক্তির জোগান পান। দ্বিতীয় বিভাগটি দেখে, উৎপাদিত শক্তির সমবণ্টন হচ্ছে কি না, যা নির্ধারণ করা হয় ক্রয়সামর্থ্য ও প্রাপ্তির ভারসাম্যের মাধ্যমে। তৃতীয়ত দেখা হয়, দেশের শক্তিব্যবস্থা ‘সাস্‌টেনেব্‌ল’ বা সুস্থায়ী কি না, অর্থাৎ কী ভাবে আর কোন কোন উপাদান ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে— কয়লা, না কি সৌরশক্তি, পারমাণবিক চুল্লি।

এই তিন বিভাগে সর্বোচ্চ ১০০ নম্বরের মধ্যে ভারতের প্রাপ্তি যথাক্রমে ৫৮, ৪৮ এবং ৪২। কিন্তু যেটা সবচেয়ে চিন্তার বিষয়— আশ্চর্য ভাবে, শক্তির নিরাপত্তায় ২০০০ সাল থেকে ভারতের ক্রমশ অবনতি হয়েছে। অর্থাৎ, যদিও আমরা সম্প্রতি ঘটা করে দেশের একশো শতাংশ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার দাবি করছি, সেটা নিতান্তই বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যবস্থায় গ্রামাঞ্চলের সংযুক্তি, নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ পরিষেবা প্রাপ্তির বা ব্যাপ্তির প্রমাণ নয়। গ্রামগঞ্জে গেলেই সে দাবির অসারতা প্রমাণ হয়ে যায়। দিল্লির জাতীয় রাজধানী অঞ্চল বা এনসিআর-এ প্রতিটি বহুতলে জেনারেটরের মাধ্যমে বিকল্প বিদ্যুৎ জোগানের ব্যবস্থা করা আছে। অন্য দুই বিভাগে উন্নতি করা সত্ত্বেও, দ্বিতীয় বিভাগে, অর্থাৎ সমবণ্টনে, ভারতের স্থান তুলনামূলক ভাবে সবচেয়ে খারাপ। তৃতীয় বিভাগে খারাপ ফলাফল অবশ্য অপ্রত্যাশিত নয়, কারণ দেশের প্রথম দাবি শক্তি নিরাপত্তা আর সমবণ্টন। কিন্তু ভারত তাতেও ব্যর্থ, অর্থাৎ আমাদের তথাকথিত উন্নয়নের মানদণ্ডে বৈষম্য দূরীকরণ বিশেষ গুরুত্ব পায়নি।

তা হলে তর্কটা দাঁড়াল, সর্বসাধারণের বিদ্যুতের দাবি আর ক্রিকেটের বিনোদনের দাবির মধ্যে। বর্তমান জীবনযাত্রার কথা ভাবলে বিদ্যুৎ আর বিলাসিতা নয়, অপরিহার্য-প্রয়োজন। তাই সর্বজনীন বিদ্যুতের দাবিকে কোনও ভাবেই খারিজ করা যায় না। তা হলে ক্রিকেটের বিনোদন, যা কিনা দিনের আলোতেও হতে পারে, তাকে রাতে করার যৌক্তিকতা নিয়ে চিন্তা করাই সমীচীন বলে মনে হয়। দ্বিতীয়ত, ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে কী কী ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্র করে তোলা যেতে পারে, তাই নিয়ে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন।

কী ভাবে স্টেডিয়ামগুলিকে পরিবেশগত ভাবে আরও বেশি সাস্‌টেনেব্‌ল বা সুস্থায়ী করে তোলা যেতে পারে, তাই নিয়ে পরিকল্পনা করাও জরুরি। বিশ্বের দু’টি স্টেডিয়াম— ক্রিকেটের মক্কা লর্ডস আর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন— সম্প্রতি এই নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা গঠন করেছে। এর অঙ্গ হিসেবে লর্ডসে নিযুক্ত হয়েছেন এক জন সাস্‌টেনেবিলিটি ম্যানেজার, যাঁর কাজ লর্ডসের কার্বন ফুটপ্রিন্ট আর বর্জ্য উৎপাদন কমানো। ভদ্রলোকের নাম রাসেল সেমোর। তিনি দাবি করছেন, তাঁরা লর্ডসে একশো ভাগ বায়ুবিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন, জলের ব্যবহার ৩৫% কমানো হয়েছে আর বর্জ্য বহুলাংশে বর্জন করা সম্ভব হয়েছে। মেলবোর্ন ২০১৮ সাল থেকে কার্বন-নিরপেক্ষ হওয়ার চেষ্টা করছে।

ভারতেও দু’টি ক্রিকেট স্টেডিয়াম— বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী আর মুম্বইয়ের ব্র্যাবোর্ন— সৌরশক্তি উৎপাদনের ব্যবস্থা করেছে। চিন্নাস্বামী এই প্রতিস্থাপন করেছে জার্মান সরকারের প্রযুক্তিগত সাহায্যে, ২০১৫ সালে। আর ব্র্যাবোর্ন— যেখানে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় রুফটপ সৌরশক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা রয়েছে— এই পরিকাঠামো তৈরি করেছে টাটা পাওয়ার-এর মাধ্যমে। তবে বলে রাখা ভাল, এই ব্যবস্থাতেও এই দু’টি স্টেডিয়াম তাদের ব্যবহৃত বিদ্যুতের মাত্র ২৫ ভাগ সাশ্রয় করতে পারবে। তা ছাড়া, ফ্লাডলাইট এতে চলে না, তার জন্যে প্রয়োজন জেনারেটর। আর এই জেনারেটর-উৎপাদিত বিদ্যুৎ হল প্রধানতম সমস্যা— কার্বন নিঃসরণ, দূষণ আর উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে। প্রসঙ্গত, বিশ্বের সবচেয়ে সুস্থায়ী স্টেডিয়াম বলে দাবি করা হয় আমস্টার্ডাম-এর অ্যারেনা আর সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল স্টেডিয়ামকে, যারা নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর পর বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এবং তা স্থানীয় গ্রিডে সরবরাহ করে। ব্র্যাবোর্নও হয়তো সেই কাজ করতে পারবে, সেখানেও বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয় না। অ্যারেনা স্টেডিয়ামে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে সেই জল মাঠে ব্যবহার করা হয়, যাতে দিনে প্রায় ৩০০০ লিটার জল বাঁচে। তারা গ্রীষ্মে তাপ সংরক্ষণ করে শীতকালে মাঠে বরফের মোকাবিলাও করে।

আমাদের দেশে ক্রিকেট প্রায় ধর্মের পর্যায়ে পড়ে। দুঃখজনক ভাবে, ক্রিকেটের বাণিজ্যিকীকরণ আমাদের দেশে যত দ্রুত হয়েছে, বিনোদন হিসেবে ক্রিকেট যত জনপ্রিয় হয়েছে, সেই অনুপাতে তার সামাজিক, অর্থনৈতিক, ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা আর দায়িত্ববোধ তৈরি হয়নি। বাজার ও বাণিজ্যিক মূল্যবোধ উষ্ণায়নের মূল কারণ হিসেবে ক্রমেই চিহ্নিত হচ্ছে বিশ্ব জুড়ে। ক্রিকেটের মতোই বাজারও শক্তি ও বিদ্যুতের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক। কিন্তু আমাদের দেশের বড় একটি অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ— দেশের মানুষকে সুলভে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করা— তা কি বাজারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? এ ক্ষেত্রে কিন্তু ক্রিকেট ও ক্রিকেটাররা অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারেন। কিন্তু তার জন্যে প্রয়োজন বাণিজ্যিক মনোভাব খানিকটা বর্জন করে, পরিবেশগত ও সামাজিক দায়বদ্ধতাকে গুরুত্ব দেওয়া। বাংলাদেশকে আড়াই দিনে হারালেই দায়িত্ব শেষ হয় না, ক্রিকেটারদের দায়িত্ব এখনও বাকি।

সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট, হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি, জার্মানি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Eden Gardens Pink Ball Flood Light
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE