Advertisement
২২ মার্চ ২০২৩

তির-ধনুক থেকে ঘুড়ি, কতই না প্রতীক

নির্বাচনে যাঁরা স্বতন্ত্র ভাবে লড়েন, সেই নির্দল প্রার্থীদের জন্য অজস্র প্রতীক বরাদ্দ থাকলেও দেখা গিয়েছে, বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের প্রতীকগুলিই অন্য অঞ্চলের নির্দল প্রার্থীরা বেশি পছন্দ করেন। ঘুড়ি-আম-সাইকেল-লণ্ঠন ইত্যাদি প্রতীক অন্য রাজ্যের নির্দল প্রার্থী পেতেই পারেন। লিখছেন অতনু বর্মন।১৯৫১ সালে এ দেশের প্রথম লোকসভা নির্বাচনে ১৪টি প্রতীক চিহ্ন অনুমোদন করে নির্বাচন কমিশন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতীক তখন ছিল জোড়া বলদ। জাতীয় কংগ্রেস এবং এই মুহূর্তে বৃহত্তম দল বিজেপি, উভয়েই এ যাবত তিন বার তাদের নির্বাচনী প্রতীক চিহ্ন পরিবর্তন করেছে।

এক ফ্রেমে চার প্রধান দলের প্রতীক চিহ্ন। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।

এক ফ্রেমে চার প্রধান দলের প্রতীক চিহ্ন। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৯ ০১:৪৫
Share: Save:

সাধারণ নির্বাচনে ভোটপ্রার্থী যে কোনও রাজনৈতিক দলের হয়েই লড়ুন কিংবা নির্দল হিসেবে, একটি প্রতীক চিহ্নই হয়ে ওঠে তাঁর কবচকুণ্ডল। আমাদের দেশে ভোটের ময়দানে লড়তে আসা রাজনৈতিক দলগুলির নির্দিষ্ট প্রতীক আছে। সেই প্রতীক অনুমোদন করে নির্বাচন কমিশন। আবার নির্দল প্রার্থীর ক্ষেত্রে যেমন লন্ঠন, চেয়ার, উদীয়মান সূর্য, হাতি প্রভৃতি প্রতীক বন্টন করে থাকে নির্বাচন কমিশনই। প্রতীক চিহ্ন ব্যবহারের কারণ এ দেশের মানুষের একাংশের অক্ষর জ্ঞান না-থাকা। প্রার্থীর নামটি তাঁরা পড়তে পারবেন না বলেই ছবির আমদানি। ভোটের প্রচারেও তাই রাজনৈতিক দলগুলির প্রার্থী এবং নেতা-কর্মীরা বা নির্দল প্রার্থীও নিজের নির্বাচনী প্রতীক চিহ্ন চেনাতে যথেষ্ট পরিশ্রম করেন। দেওয়ালে দেওয়ালে তাই লেখা থেকে ‘এই চিহ্নে ভোট দিন’।

Advertisement

১৯৫১ সালে এ দেশের প্রথম লোকসভা নির্বাচনে ১৪টি প্রতীক চিহ্ন অনুমোদন করে নির্বাচন কমিশন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতীক তখন ছিল জোড়া বলদ। জাতীয় কংগ্রেস এবং এই মুহূর্তে বৃহত্তম দল বিজেপি, উভয়েই এ যাবত তিন বার তাদের নির্বাচনী প্রতীক চিহ্ন পরিবর্তন করেছে। ‘৫২ থেকে ’৭১ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস জোড়া বলদ চিহ্নেই লড়েছে। তখন পরিচিত স্লোগান ছিল—‘ভোট দেবেন কোনখানে/ জোড়া বলদের মাঝখানে।’ একাত্তর সালে জোড়া বলদ চিহ্নের বদলে কংগ্রেস ব্যবহার করতে শুরু করলো গাই-বাছুর চিহ্নটি। রসিক বাঙালি তৎকালীন রাজনৈতিক মেলবন্ধনকে মাথায় রেখে ছড়া লিখেছিল—‘দিল্লি থেকে এলো গাই/ সঙ্গে বাছুর সিপিআই’। সাতাত্তরে ইন্দিরা গাঁধী ‘ইন্দিরা কংগ্রেস’ গঠনের পরবর্তী কালে জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক হয় ‘হাত’। মজার ব্যাপার, ’৫১ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সালে ‘হাত’ প্রতীক চিহ্নটি ছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের (রুইকার গ্রুপ)। সাতাত্তরে সেটিই কংগ্রেসের প্রতীক হয়ে গেল। অবশ্য হাতের আঙুলের গঠন দু’টি প্রতীকের ক্ষেত্রে সামান্য আলাদা।

বিজেপি প্রথম দিকে যখন ভারতীয় জনসঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত, তখন তার নির্বাচনী প্রতীক ছিল ‘প্রদীপ’। এই প্রদীপ অনেকটাই আরব্য উপন্যাসের আলাদিনের প্রদীপের মতো দেখতে। সাতাত্তরে দলের নাম হয় জনতা পার্টি। প্রতীক তখন লাঙল কাঁধে কৃষক। একটি চাকার ভিতরে কৃষক যেন হেঁটে চলেছেন, এই রকম। পরবর্তী কালে বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টি পদ্মফুলকেই তাদের দলীয় প্রতীক হিসেবে বেছে নেয়। সিপিআইএমের নির্বাচনী প্রতীকেও বদল হয়েছে। কাস্তে হাতুড়ির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘তারা’। সিপিআইয়ের প্রতীক কাস্তে ও ধানের শিষ সূচনার সময় থেকেই এক থেকেছে। অপেক্ষাকৃত নবীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের ঘাসফুলও এখনও বদলায়নি।

নির্বাচন কমিশনের তালিকায় বর্তমানে সাতটি জাতীয় দল ও ৬৪টি আঞ্চলিক দলের প্রতীক চিহ্ন নির্দিষ্ট ভাবে সংরক্ষণ করা থাকলেও একই প্রতীক অঞ্চলভেদে আলাদা রাজনৈতিক দল ব্যবহার করে থাকে। যেমন ধরা যাক বাই সাইকেল। এই প্রতীকচিহ্নটি উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি, মণিপুরে মণিপুর পিপলস পার্টি, জম্মু ও কাশ্মীরে জেকেএনপিপি (জম্মু কাশ্মীর ন্যাশনাল প্যান্থার্স পার্টি)-র প্রতীক।

Advertisement

এই রকমই আর একটি জনপ্রিয় প্রতীক হলো তির-ধনুক। ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গে তির-ধনুক ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার প্রতীক। আবার মহারাষ্ট্রে শিবসেনাও ওই প্রতীকে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। দু’টি তির-ধনুকের ছবি অবশ্য আলাদা। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার জন্মের আগে সিপিআইএমএল অর্থাৎ সোজা কথায় নকশালদের যে অংশ সংসদীয় গণতন্ত্রে আস্থা জানিয়ে নির্বাচনে লড়ত, তাদেরও প্রতীক ছিল তির-ধনুক।

নির্বাচন কমিশনের ১০ ও ১০-এ সারণিতে নিবন্ধীকৃত এমন আরও কিছু নির্বাচনী প্রতীক চিহ্ন বৈচিত্রময় ভারতকে অভিনব করে তুলেছে। আরএসপি দলটির মূল অবস্থান মূলত কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গে। এদের প্রতীক বেলচা ও কোদাল। পশ্চিমবঙ্গের আর একটি দল ফরোয়ার্ড ব্লক। তাদের প্রতীক চিহ্ন প্রতিষ্ঠাতা সুভাষচন্দ্র বসুর সময় থেকে আজও ‘সিংহ’। এই সিংহ কিন্তু বেশ জাঁদরেল। যেমন-তেমন ভাবে আঁকা নয়। ভোটের সময় সেই সিংহ আঁকার শিল্পী আজকাল পাওয়াই যায় না, এমন আক্ষেপ শোনা যায় ফরওয়ার্ড ব্লকের অনেক নেতার মুখে।

ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ও শিবসেনার প্রতীক তির-ধনুক থেকে শুধু তিরটিই বরাদ্দ এখন জনতা দলের (জেডিইউ), যা মূলত বিহারের আঞ্চলিক দল। জনতা দলের দু’টো ভাগ। বিহারে সে দলের নাম জনতা দল ইউনাইটেড (ডেজিইউ)। এই দলের প্রধান বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। অন্য দিকে কেরল ও কর্ণাটকে তাদের নাম জনতা দল সেকুলার। বিহারের জেডিইউ যেখানে ধনুক ছাড়া শুধু তির নিয়ে ভোট যুদ্ধে নামে সেখানে, এইচ ডি দেবেগৌড়া ও কুমারস্বামীর দল জনতা সেকুলারের প্রতীক চিহ্নটি যথেষ্ট নান্দনিক। ‘ফসল মাথায় কৃষক রমণী’— এমন প্রতীক আঁকতে এলেম লাগে। যে কেউ পারেন না।

উত্তরপ্রদেশের রাষ্ট্রীয় লোকদলের জন্য নির্ধারিত প্রতীক হল হ্যান্ডপাম্প, সোজা কথায় নলকূপ। ভারতের জাতীয় পুষ্পটি (পদ্ম) ভারতীয় জনতা পার্টির দখলে গেলে কী হবে, জাতীয় ফল আম কিন্তু পুদুচেরির একটি আঞ্চলিক দলের দখলে। দলের নাম পাটালি মাক্কাল কাটচি বা পিএমএকে। বাংলো বলতে আমরা বুঝি সুদীর্ঘ বারান্দাযুক্ত বাগানশোভিত বিলাসবহুল গৃহ। বিহারের লোকজনশক্তি সেই বাংলো প্রতীকেই ভোটে অংশ নিয়ে থাকে। আরব্য উপন্যাসের মর্জিনার হাতের অথবা বিলিতি পেত্নির বাহন ‘ঝাঁটা’ খুবই হালের প্রতীক চিহ্ন। দিল্লি ও পঞ্জাবের আঞ্চলিক দল আম আদমি পার্টি বা আপ-এর নির্বাচনী প্রতীক।

বৈচিত্রের পূণ্যভূমি ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দলও বৈচিত্রময়। তেলঙ্গানার একটি আঞ্চলিক দল হল এআইএমআইএম (অল ইন্ডিয়া মজলিস ইত্তেহাদুল মুসলিমিন)। এদের নির্বাচনী প্রতীক হল ঘুড়ি। তবে ভারতবর্ষে মাত্র একটি দলেরই নির্বাচনী প্রতীক চিহ্ন হল বই। মেঘালয়, মণিপুর ও নাগাল্যান্ডের সেই দলটির নাম ন্যাশনাল পিপলস পার্টি। নির্বাচনে যাঁরা স্বতন্ত্র ভাবে লড়েন, সেই নির্দল প্রার্থীদের জন্য অজস্র প্রতীক বরাদ্দ থাকলেও দেখা গিয়েছে, এই সব আঞ্চলিক দলের প্রতীকগুলিই অন্য অঞ্চলের নির্দল প্রার্থীরা বেশি পছন্দ করেন। ঘুড়ি-আম-সাইকেল-লণ্ঠন ইত্যাদি প্রতীক অন্য রাজ্যের নির্দল প্রার্থী পেতেই পারেন।

এত বড় একটি দেশের গণতন্ত্রের রাজসূয় যজ্ঞটি কিছুকাল আগেও মানুষের হাতে পরিচালিত হতো যা দেখতে ভিড় করতেন বিস্মিত ভিনদেশি পর্যটক। বোতাম টেপা ভোটের কর্মযজ্ঞ দেখতেও আসেন দেশ-বিদেশের সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞর দল। নির্বাচনের ক্যানভাসে এত বিচিত্র প্রতীক চিহ্ন যদি পাশাপাশি সাজিয়ে দেওয়া হয়, তবে তা বর্ণময় ছবির বই হয়ে উঠতে পারে। এই বৈচিত্রই ভারতবর্ষের পরিচয়। সেকেন্দার শাহ সেই কবেই বলেছিলেন, ‘সত্য সেলুকস, কী বিচিত্র এই দেশ!’

লেখক স্কুলশিক্ষক এবং সাহিত্য ও নাট্যকর্মী, মতামত নিজস্ব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.