ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে উপগ্রহ বিনষ্ট করে ভারত বিশ্বে চার জনের এক জন হল। সরকারের দাবি, প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ভারতের স্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া আর চিনের পরেই। কিন্তু আর একটি তালিকায় ভারতের স্থান সম্পর্কে সরকার নীরব। স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর গুণগত মান ও প্রসারে ভারতে রয়েছে আফ্রিকার কিছু দেশের থেকেও নীচে— একশো পঁচানব্বইটি দেশের তালিকায় ভারতের স্থান ১৪৫। ২০১৯ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ হয়েছে মোট জাতীয় উৎপাদনের মাত্র দুই শতাংশ।
এমন কোনও দেশ আছে কি, যেখানে জনস্বাস্থ্যে বিনিয়োগ না করে সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে? কোনও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কি আছে যেখানে জনস্বাস্থ্যের দায় এড়াচ্ছে সরকার? অন্য দেশ অনেক আগেই উপলব্ধি করেছে যে, আধুনিকতার এক প্রধান শর্ত হল উন্নত সরকারি চিকিৎসা। চিকিৎসার দায়িত্ব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দিলে বঞ্চিত হন অধিকাংশ মানুষ। হাসপাতালের খরচ বহন করতে গিয়ে নিঃস্ব হন তাঁরা।
ভারতের প্রাথমিক চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যের ছবিটা ভয়াবহ। গত ত্রিশ বছরে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ছিটেফোঁটাও স্পর্শ করেনি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিকে। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ‘অচ্ছে দিন’ আসন্ন নয়, স্থগিত। কল্পিত উন্নয়নের বিজ্ঞাপনের পর্দা সরালে দেখা যায়, প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রতি মানুষের আস্থা শূন্য, কারণ ওষুধপত্র ডাক্তার যন্ত্রপাতির কিছুরই জোগান নেই। পরিচ্ছন্নতার বদলে কর্মহীনতার বিষণ্ণতা ও ইঁদুরের আনাগোনা। জনসংখ্যার তুলনায় কেন্দ্রসংখ্যা নেহাত কম, ফলে বহু গ্রামের থেকে দূরত্ব বেশি। অনেকেরই মতে, সেখানে গেলে আরোগ্যলাভের চেয়ে জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভের সম্ভাবনা বেশি।
বিকল্প ‘ঝোলাছাপ’ ডাক্তার, বা ‘হাতুড়ে’। এ নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। যাঁরা হাতুড়েদের শরণাপন্ন হন, পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি শোনার বিলাসিতা সেই মানুষদের জন্য নয়। তাঁদের কাছে প্রশ্নটা চটজলদি পরিষেবা পাওয়ার। দিন-আনি-দিন-খাই মানুষ ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বা অ্যান্টিবায়োটিকের জন্য দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে চিন্তা করেন না। তাঁদের চাই নিকটবর্তী চিকিৎসা এবং সস্তায় সুরাহা। ‘ঝোলাছাপ’ এই সুবিধেগুলি দিলে কেনই বা তাঁরা তা নেবেন না? বেশির ভাগ প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য তো বিশেষজ্ঞের দরকার হয় না।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
কিন্তু প্রশ্ন যখন সরকারের সাফল্য নিয়ে, তখন তো ‘নাই মামার থেকে কানা মামা ভাল’ বলা চলে না। সরকারি নীতির ত্রুটি কোথায়, সে কথা তুলতেই হয়। সরকার যে সত্যটা এড়িয়ে যেতে চায় তা হল, প্রতি গ্রামে, প্রতি বস্তিতে এমবিবিএস ডাক্তার চাইলেও মিলবে না। নির্বাচনের আগে সব দলই স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়, ক্ষমতায় এলে দরিদ্রের চিকিৎসাকে অবহেলা করে। ফলে চিকিৎসার ফাঁক ভরাতে ডিগ্রিহীন তথা হাতুড়ে ছাড়া গতি নেই। প্রশ্ন উঠবে, তবে কি আমরা চাইব হাতুড়ে ডাক্তারে ভরে যাক দেশটা? প্রশ্নটা আমাদের চাওয়া না-চাওয়ার নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠনের সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতে প্রায় ষাট শতাংশ ডাক্তার ডিগ্রিহীন। বিপুল সংখ্যক মানুষ এঁদের ওপরে নির্ভরশীল— অনেকটাই নিরুপায় হয়ে। বেসরকারি ডাক্তারের চেম্বার, নার্সিং হোম এই রোগীদের নাগালের বাইরের। আর বিমার আওতায় প্রাথমিক বা ‘আউটডোর’ চিকিৎসা আসে না। স্বাস্থ্যের জন্য মাথাপিছু খরচ বেড়েই চলেছে, কিন্তু সরকারি বরাদ্দ বাড়ছে না। অতএব শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা না করে, ডিগ্রিহীন চিকিৎসকদের অপরিহার্যতা মেনে নেওয়াই উচিত। এঁদের বেআইনি ঘোষণার চেষ্টা আগেও হয়েছে এবং ব্যর্থ হয়েছে। বিকল্পের অভাবে মানুষ এঁদের কাছেই যাচ্ছেন। তাই গত কয়েক বছরে এই দাবি ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছে যে, সরকারি স্বাস্থ্য নীতিতে ডিগ্রিহীন ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ, অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থাকে স্থান দিতে হবে।
ডিগ্রিহীন ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ রোগ নির্ণয়ে সহায়তা করবে, উত্তম চিকিৎসার সম্ভাবনা বাড়াবে। তাঁদের পরীক্ষা-ভিত্তিক অনুমোদন নিশ্চিত করবে, কারা একেবারেই অযোগ্য। যোগ্য প্রমাণিত হলে তাঁদের একটা নিয়মের কাঠামোয় আনা দরকার, যাতে ঝুঁকি কমে। কী কী প্রাথমিক চিকিৎসার অধিকার এই চিকিৎসকদের দেওয়া যেতে পারে, কোন কোন ওষুধ দেওয়ার অধিকার এঁদের আছে, সেই তালিকারও প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের দ্বারা ডিগ্রিহীন চিকিৎসকদের কাজের তত্ত্বাবধান রোগীর ঝুঁকিও কমাবে, এঁদের দক্ষতাও বাড়াবে।
রাজ্য সরকার, লিভার ফাউন্ডেশন, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ গত কয়েক বছরে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে। তাঁদের থেকে শেখার আছে অনেক। ডিগ্রিহীন চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ, পরীক্ষা, নথিভুক্তি ও নজরদারির কাজটি সরকারি স্বাস্থ্যনীতির মধ্যে আনা হোক। দেশ তার অধিকাংশ নাগরিকের জন্য অনিয়ন্ত্রিত চিকিৎসা বরাদ্দ করতে পারে না।
শ্রীদীপ শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতাত্ত্বিক; শৈলজা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের প্রাক্তন মুখ্য সচিব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy