Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

হলফনামা

সরকার পক্ষ নিজেদের মতটি সামগ্রিক সমাজের নামে চালাইতে গিয়া ভুলিয়া যাইতেছে যে মাত্র চার বৎসর আগে, ২০১৩ সালে জাস্টিস বর্মা রিপোর্টে যখন বৈবাহিক ধর্ষণকে অন্যায় বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিল, তখন দেশের কত কোণ হইতে কত ধরনের কণ্ঠ তাহাতে গভীর প্রসন্নতা প্রকাশ করিয়াছিল।

শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:৩৮
Share: Save:

বৈবাহিক ধর্ষণ কেন ধর্ষণ নহে, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে দিল্লি হাইকোর্টে তাহার ব্যাখ্যা শুনিয়া বোঝা গেল, গোটা দুনিয়া যে যুগেই বাস করুক না কেন, ভারত এখনও মধ্যযুগে। এবং মধ্যযুগেই থাকিতে মনস্থ করিয়াছে। নতুবা এমন একটি আপাদমস্তক পশ্চাৎপদ এবং রক্ষণশীল যু্ক্তি রাষ্ট্রের পক্ষে সর্বসমক্ষে উচ্চারণ করা অসম্ভব। বিবাহের মধ্যে ধর্ষণ বেআইনি করিতে গেলে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটিই ভাঙিয়া পড়িতে পারে, এমন একটি কথা যে সরকারি আইনজীবীরা তর্কের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করিয়া দিলেন, তাহাতে কেবল তাঁহাদের নিজেদের মানসিক সংকীর্ণতাটিই ধরা পড়িল না, দেশের যুক্তি-বুদ্ধি-তর্কের সামগ্রিক পরিবেশটির চেহারা নূতন করিয়া উদ্ভাসিত হইল। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে অতিরিক্ত মর্যাদা ও গৌরব দিতে এই দেশ চির কালই অভ্যস্ত, সে কথাই এই বক্তব্যে মহাড়ম্বরে উচ্চারিত হইল। বিবাহের নামে স্ত্রী স্বামীর যৌন সম্পত্তিতে পরিণত হইলে সেই অন্যায্য অসমতা ‘ভারতীয় সমাজের নিজস্ব ধরন’, এমন যুক্তি দিয়া এক অতিসংকীর্ণ ভারত-তত্ত্ব রচনা করা হইল।

এই ভারত-তত্ত্ব অবশ্যই বর্তমান শাসক দল ও তাহার প্রযত্নে থাকা আইনজ্ঞদের রচনা। গোটা দেশের নানাভাবী নানাভাষী সমাজ তাহা মোটেও সমর্থন করে না। সরকার পক্ষ নিজেদের মতটি সামগ্রিক সমাজের নামে চালাইতে গিয়া ভুলিয়া যাইতেছে যে মাত্র চার বৎসর আগে, ২০১৩ সালে জাস্টিস বর্মা রিপোর্টে যখন বৈবাহিক ধর্ষণকে অন্যায় বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিল, তখন দেশের কত কোণ হইতে কত ধরনের কণ্ঠ তাহাতে গভীর প্রসন্নতা প্রকাশ করিয়াছিল। সেই রিপোর্টে বর্তমান আইপিসি-র সমস্যাটির ব্যাখ্যা ছিল, এবং স্বামী স্ত্রী সহ সমস্ত রকম সম্পর্ক বা অ-সম্পর্কের ক্ষেত্রে যৌন সংসর্গের একমাত্র ভিত্তি পারস্পরিক বোঝাপড়া তথা সম্মতি, এই কথা দৃপ্ত ভাবে উচ্চারিত হইয়াছিল। আইনের ৩৭৫ ধারা যে ভাবে স্ত্রীর বয়স পনেরো বৎসরের উপর হইলেই বৈবাহিক যৌনতা কখনও ধর্ষণ বলিয়া গণ্য করে না, তাহার আইনগত ও সমাজগত অন্যায্যতা তুলিয়া ধরিয়াছিল। চার বৎসরের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের হলফনামা সমস্ত যুক্তি অমান্য করিয়া বলিল, অন্য দেশে বৈবাহিক ধর্ষণ নিষিদ্ধ হয় হউক, ভারতে তাহা চলিবে না, ভারতের ‘সংস্কৃতি’ই অন্য রকমের।

আদালতের হলফনামা নানা যুক্তিজালে এই রক্ষণশীল অবস্থানকে ব্যাখ্যা করিতে চাহিয়াছে। আদালতের বাহিরে কিন্তু সরকারি প্রতিনিধিরা কোনও দর্শনের ধার ধারিতেছেন না, সোজাসুজি নারী-মর্যাদার প্রশ্নটিকে অবমাননা করিয়া বিদ্বেষবাক্য বর্ষণ করিতেছেন। মিজোরামের প্রাক্তন রাজ্যপাল স্বরাজ কৌশল তীব্র ব্যঙ্গে বলিয়াছেন, বৈবাহিক ধর্ষণ নিষিদ্ধ করিবার অর্থ, ঘরে ঘরে পুলিশ চৌকি বসানো। সমাজের ক্ষমতার ভারসাম্যটি কোন দিকে হেলানো, গুরুত্বপূর্ণ রাজপুরুষরাও যখন সে সব বিচার না করিয়া নির্দ্বির্ধায় পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার পক্ষে নিজেদের দৃঢ় ভাবে প্রোথিত করেন, বোঝাই যায়, রাজনীতি সমাজকে কোন দিকে লইয়া যাইতে চাহিতেছে। ফলত, ভারতীয় নারীরা সুবিচার ও সুরক্ষা পাইবার সুযোগটি হারাইতে বসিয়াছেন, আর ভারতীয় সমাজ তাহার নির্যাতন ও নিষ্পেষণের ফাঁস হইতে মুক্ত হইবার পথগুলি নিজ হাতে বন্ধ করিতেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Marital Rape Women Justice Protection
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE