Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus in West Bengal

অগ্রিমের দাবি

কলিকাতার বেসরকারি হাসপাতাল ভদ্রলোক বটে, সর্বদাই তাহাদের এক কথা। সেই কথাটি ইহাই যে, চিকিৎসা পাইতে হইলে অগ্রিম দিতে হইবে।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

কলিকাতার বেসরকারি হাসপাতাল ভদ্রলোক বটে, সর্বদাই তাহাদের এক কথা। সেই কথাটি ইহাই যে, চিকিৎসা পাইতে হইলে অগ্রিম দিতে হইবে। বিনা তর্কে, এবং বিনা বিলম্বে। চাহিদা বেশি নহে, বাইপাসের ধারে একটি হাসপাতাল মাত্র লাখ তিনেক টাকা দাবি করিয়াছিল। আত্মীয়-পরিজন ওই কয়টি টাকা জোগাড় করিবার পূর্বেই যদি রোগী প্রাণ হারাইয়া বসেন, তাহার জন্য কি হাসপাতালকে দোষী সাব্যস্ত করা চলে? অনেকে আবার প্রশ্ন তুলিতেছেন, সরকারের কথা বেসরকারি হাসপাতাল মানিতেছে না কেন? রাজ্য সরকারের নিযুক্ত কমিশন তো অগ্রিমের অঙ্ক পঞ্চাশ হাজার টাকা বাঁধিয়া দিয়াছে। তাহার ছয় গুণ দাবি করিবার যুক্তি কী? অনেকে আরও একটু আগাইয়া প্রশ্ন করিতেছেন, অগ্রিম আদৌ লওয়া হইবে কেন? স্বাস্থ্যবিমা থাকিলে ‘ক্যাশলেস’ চিকিৎসা পাইবার কথা। হাসপাতালগুলি তাঁহাদের প্রশ্ন করিতে পারে— সোমবার সকালে যে চলচ্চিত্রের টিকিট মাত্র আশি টাকা, রবিবার বিকালে তাহাই তিনশো আশি টাকায় কি কখনও বিক্রি হইতে দেখেন নাই? ইহাই বাজার অর্থনীতির মূল কথা— জোগানের তুলনায় যাহার চাহিদা অধিক, বাজারে তাহার দাম বাড়িবেই। জোগান না বাড়িলে তাহা ক্রমশ দুর্লভ হইয়া যাইবে। ইহাই নিয়ম। চিকিৎসা তো আর ব্যতিক্রম হইতে পারে না। এই অতিমারির কালে রোগী অধিক, শয্যা কম। বিশেষত কোভিড রোগীকে অধিকাংশ হাসপাতাল দূর করিয়া দেয়। যে কয়টি হাসপাতাল রোগী ভর্তি করিবার ঝুঁকি লইবে, তাহাদের ঘাড়ে টাকার ঝুঁকিও চাপানো হইবে কেন? যাহা সম্ভাব্য খরচ, তাহার সবটাই অগ্রিম দাবি করিয়া হাসপাতাল নিজেকে বাঁচাইতে চাহিয়াছে কেবল। হাসপাতালগুলি হয়তো প্রশ্ন করিবে— রোগীর বাঁচিবার অধিকার আছে, আর হাসপাতালের নাই?

বাণিজ্যের নিরিখে বেসরকারি হাসপাতালের অবস্থানে ভুল কিছু নাই, সমস্যা কেবল একটিই। হাসপাতালের কারবার প্রাণ লইয়া। মানুষের প্রাণের মূল্য এমনই, যে তাহার সম্মুখে সকল যুক্তি-তর্ক নিরর্থক হইয়া যায়। অগ্রিম দাবি করা উচিত কি না, পঞ্চাশ হাজার টাকা যথেষ্ট কি না, মরণাপন্ন রোগীর সম্মুখে সে সকল বিতর্ক অর্থহীন। দার্শনিক বার্নার্ড উইলিয়ামস বলিয়াছিলেন, ডুবন্ত মানুষকে বাঁচাইতে জলে ঝাঁপাইবার পূর্বে একটিমাত্র চিন্তা করিলে, তাহাও অতিরিক্ত চিন্তা। শ্বাসকষ্টে আর্ত রোগীর চিকিৎসা শুরুর উপর যে শর্তই আরোপ হউক, তাহা অন্যায়। তাহার ন্যায্যতার বিচার অনর্থক। অগ্রিমের সীমা পঞ্চাশ হাজার টাকা বাঁধিয়া সরকারি কমিশন আপস করিতে চাহে। কিন্তু ইহাতে রোগী ভর্তির পূর্বে অগ্রিম টাকা দাবি করিবার প্রথাটি মান্যতা পাইল। তাহাতে রোগীর বিপন্নতা বাড়িবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। অতিমারিতে বেসরকারি চিকিৎসা মধ্যবিত্তের নাগালের বাহিরে গিয়াছে, স্বাস্থ্যবিমা কার্যত অচল সিকি। হাসপাতাল এড়াইয়া জীবনের ঝুঁকি বাড়াইতেছেন বহু রোগী, তাহার সম্ভাবনা যথেষ্ট।

রাজ্য সরকার কেন বেসরকারি হাসপাতালের রাশ টানিতে পারিতেছে না, সেই প্রশ্নও উঠিবে। স্বাস্থ্য ভবন বহু পূর্বেই জানাইয়াছিল, অগ্রিমের জন্য সঙ্কটজনক রোগীর চিকিৎসায় বিলম্ব করা চলিবে না। পরিবার টাকা দিতে অপারগ হইলে রোগীকে স্থিতিশীল করিয়া ছাড়িতে হইবে। সঙ্কটাপন্ন রোগীকে ফেরানো চলিবে না। কিন্তু সংবাদে প্রকাশ, তাহার পরেও বেসরকারি হাসপাতালগুলি অত্যুচ্চ অঙ্কের টাকা অগ্রিম দাবি করিতেছে, এবং দিতে অক্ষম হইলে ‘শয্যা নেই’ বলিয়া রোগী ফিরাইতেছে। সরকারি বিধি উপেক্ষা করিবার এই ঝোঁকটি রোগজীবাণুর ন্যায় ছড়াইয়াছে। চিকিৎসার প্রদেয় টাকা রোগী না মিটাইলে হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হইবে, তাহা অনস্বীকার্য। কিন্তু হাসপাতালের দ্বারে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ক্ষত অসহনীয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE