টাকার দামের পতন কার্যত অব্যাহত, ইহা সমস্যার একটি প্রকাশমাত্র। কেন টাকার দাম পড়িতেছে, সেই কারণ সন্ধান করিলে একটি স্পষ্ট উত্তর মিলিবে— ভারতীয় অর্থব্যবস্থার উপর বিশ্বমঞ্চে ভরসা কমিতেছে। সাম্প্রতিক অতীতে ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কও বিপুল পরিমাণ ডলার ঘরে তুলিয়াছে, অর্থাৎ টাকার ভবিষ্যতের উপর দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কেরও বিশেষ আস্থা নাই। আস্থা হারাইবার কারণ প্রকট— অর্থব্যবস্থার সর্বাঙ্গে গতিভঙ্গের ঘুণ ধরিয়াছে। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনের সূচক নিম্নমুখী, বিদ্যুতের চাহিদা নাই। অক্টোবর মাসে পাইকারি মূল্যসূচকের নিরিখে মূল্যবৃদ্ধির হার কার্যত শূন্যে ঠেকিয়াছে। শিল্পক্ষেত্রে গতিভঙ্গের সকল লক্ষণ স্পষ্ট। অন্য দিকে, খুচরা পণ্যের মূল্যসূচকের নিরিখে মূল্যবৃদ্ধির হার গত ১৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সহনসীমার ঊর্ধ্বে। আপাত-জটিল ধাঁধা— যেখানে পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার ৪০ মাসের তলানিতে, সেখানে খুচরা পণ্যে এমন মূল্যবৃদ্ধি হইতেছে কী ভাবে? উত্তর আছে হিসাবের পদ্ধতিতে। পাইকারি মূল্যসূচকে খাদ্যপণ্যের গুরুত্ব ১৫ শতাংশ; খুচরা মূল্যসূচকে সেই গুরুত্ব ৪৫ শতাংশের বেশি। শুধুমাত্র খাদ্যপণ্যের পাইকারি মূল্যসূচকে মূল্যবৃদ্ধির হার সেপ্টেম্বরে ছিল ৫.৯৮ শতাংশ, অক্টোবরে তাহা বাড়িয়া হইয়াছে ৭.৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ, শিল্পক্ষেত্র ধুঁকিতেছে, কিন্তু বাজারে খাদ্যপণ্য অগ্নিমূল্য। সাধারণ মানুষ দুই অস্ত্রেই ঘায়েল হইতেছেন। তাহার উপর টাকার দামের নিম্নগতি অব্যাহত থাকিলে পেট্রোপণ্য-সহ আরও অনেক কিছুরই দাম বাড়িবে, তাহার আঁচ আসিয়া লাগিবে সাধারণ মানুষের গায়ে। নরেন্দ্র মোদীরা ভারতীয় অর্থব্যবস্থাকে যে চক্রব্যূহে আনিয়া ফেলিয়াছেন, তাহা হইতে বাহির হইবার পথ তাঁহারা জানেন বলিয়া বিশ্বাস হয় না। আরও আশঙ্কার, নিস্তার পাইবার যে আদৌ প্রয়োজন আছে, সে কথাটি স্বীকার করিতেও তাঁহাদের বাধে। এমন অর্থব্যবস্থার উপর ভরসা করিবে, সেই সাহস কাহার?
দেশের অর্থব্যবস্থার যখন নাভিশ্বাস উঠিতেছে, প্রধানমন্ত্রী তখন ব্রিকস-এর সম্মেলনে শুনাইয়া আসিয়াছেন, ২০২৪ সালের মধ্যেই ভারত পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থব্যবস্থা হইয়া উঠিতে বদ্ধপরিকর। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সৌজন্য প্রবল, কাজেই মোদীর কথায় কেহ ফিকফিক করিয়া হাসেন নাই। কথাটি অবশ্য হাসিবারই মতো। নরেন্দ্র মোদী জানুন বা না-ই জানুন, তাঁহার দেশের খবর গোটা দুনিয়া রাখে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার হইতে মুডিজ়-এর ন্যায় রেটিং সংস্থা, সকলেই ভারতের বৃদ্ধির হারের পূর্বাভাস ছাঁটিতেছে। জানাইতেছে, ভরসা নাই— আরও বড় বিপদ আসন্ন। এই অর্থবর্ষে আর্থিক বৃদ্ধির হার ছয় শতাংশের গণ্ডি অতিক্রম করিতে পারিবে কি না, সেই প্রশ্নেরই যেখানে উত্তর নাই, সেখানে সাড়ে চার বৎসরের মধ্যে পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছাইয়া যাইবার ‘আত্মবিশ্বাস’ প্রধানমন্ত্রীকে শুধু হাস্যাস্পদ করিতেছে। এবং, আরও একটি বার্তা দিতেছে— তিনি, তাঁহারা, নিজেদের কাজ সম্বন্ধে যথেষ্ট দায়িত্বশীল নহেন। তাঁহারা জানেন না যে কী বলিতেছেন। অর্থব্যবস্থার কর্ণধারদের সম্বন্ধে এ-হেন কথা হাওয়ায় ভাসিলে তাহা ভারতের পক্ষে ইতিবাচক হইতে পারে না। ব্রিকস-এর মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী বৈদেশিক বাণিজ্যে আরও জোর দেওয়ার কথা বলিয়াছেন। তিনি কি ভুলিয়া গিয়াছেন যে ব্যাঙ্কক-এর মঞ্চে দাঁড়াইয়া আরসিইপি চুক্তি হইতে ভারতের সরিয়া আসিবার কথা ঘোষণা করিবার পর এখনও পনেরো দিন কাটে নাই? এবং, মুখ্যত যে দেশের ভয়ে ভারত পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিল, সেই চিন ব্রিকস-এর জোটে সগৌরব উপস্থিত? ভারতবাসী জানে, ভাবিয়া কথা বলিবার সুঅভ্যাসটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাই। বিশ্ববাসীকে এই কথাটি না বুঝাইলেও চলিত। মুখ বন্ধ রাখিবার ভাল দিক হইল, মুখ খুলিলেই ধরা পড়িয়া যাওয়ার ভয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy