Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
বাংলা ভাষা

ভাষাকে বাঁচাতে হলে উপভাষাকেও বাঁচাতে হবে

আমাদের আঞ্চলিক কথ্যভাষায় জড়িয়ে রয়েছে আমাদের সংস্কৃতি, আঞ্চলিক ও সমাজ ইতিহাসের অনেক মূল্যবান উপাদান। সংস্কৃতিকে বাঁচাতে তাই অতীতকে খোঁজা প্রয়োজন। প্রয়োজন আঞ্চলিক কথ্যভাষার বিবর্তনকে বোঝা। লিখছেন ভবসিন্ধু রায়কাল ২১ ফেব্রুয়ারি। একটি ভাষা কী ভাবে একটি জাতির আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ এই দিনটি। দিনটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়

 গ্রামীণ আড্ডাতে আজও বেঁচে রয়েছে কথ্যভাষার কিছু রূপ। নিজস্ব চিত্র

গ্রামীণ আড্ডাতে আজও বেঁচে রয়েছে কথ্যভাষার কিছু রূপ। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:১২
Share: Save:

কাল ২১ ফেব্রুয়ারি। একটি ভাষা কী ভাবে একটি জাতির আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ এই দিনটি। দিনটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। এ দিনটিতে বিশেষ করে, বাংলা ভাষা কতটা বিপন্ন তা নিয়ে আমরা শঙ্কিত হয়ে পড়ি। কিন্তু বাংলাভাষা বলতে আমরা ঠিক কী বুঝি? বাংলা ভাষার কিন্তু একটি মাত্র রূপ নেই। এই ভাষায় ‘রাঢ়ী’, ‘বঙ্গালী’, ‘বরেন্দ্রী’, ‘কামরূপী’, ‘ঝাড়খণ্ডী’—মোট পাঁচটি উপভাষা চিহ্নিত হয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হল, একটি নির্দিষ্ট উপভাষা ব্যবহারকারী অঞ্চল হিসেবে যে স্থানকে চিহ্নিত করা হয়েছিল, সেখানকার সবাই কি একই ভাষায় কথা বলে? তৎকালীন অবিভক্ত বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, হাওড়া, হুগলির মতো বিস্তীর্ণ এলাকাকে রাঢ়ী উপভাষার ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এখন রাঢ়ী উপভাষার স্থানিক বৈশিষ্ট্য ও তার শ্রেণিবিভাগ করতে তৎপর হয়েছেন ভাষাবিদেরা। এই উপবিভাগগুলিরও নির্দিষ্ট আঞ্চলিক বৈচিত্র রয়েছে। প্রচলিত একটি প্রবাদে আছে, ‘কোশ (ক্রোশ) অন্তে পানি এবং চারকোশ অন্তে বাণী পরিবর্তিত হয়’। সেই নিয়ম মেনেই হয়তো রাঢ়ী উপভাষা বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া নানা স্থানে স্বতন্ত্র রূপ পেয়েছে।

অঞ্চলভেদে কেন ভাষা বদলে যায়, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। ভাষাবিদেরা মনে করেন, ভাষার উচ্চারণের সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং ভূপ্রকৃতির নির্দিষ্ট যোগসূত্র রয়েছে। এরা মানুষের বাকযন্ত্রের ব্যবহারকে প্রভাবিত করে। তাই বর্ধমানের নানা প্রান্তে গড়ে ওঠে পৃথক ভাষা রীতি। বীরভূম বা বাঁকুড়াতে, বর্ধমানে ব্যবহৃত হওয়া শব্দের রূপ বদলে যায়। ধরা যাক, ‘কুমড়ো’র কথা। ‘কুমড়ো’ বর্ধমানে ‘ডিংলি’, বাঁকুড়ায় ‘ডিংলা’, বীরভূমে ‘ডিংলে’ নামে পরিচিত। আবার গড়গড়িয়ে’ শব্দটি বর্ধমানে ‘গদগদিয়ে’, বাঁকুড়ায় ‘গদগদাই’ হয়ে গিয়েছে।

রাঢ় অঞ্চলের এমন কয়েকটি শব্দ রয়েছে, যা একান্ত ভাবেই তাদের নিজস্ব সম্পদ। যেমন, ছোট পুকুরকে আউশগ্রাম, মঙ্গলকোট, কাঁকসায় ‘গড়ে’ বলা হয়। এই শব্দটিকে পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ায় যথাক্রমে, ‘গোড়্যা’, এবং ‘গড়’ বলে।

রাঢ় বাংলার লোকভাষার মধ্যে রয়েছে নৃতাত্ত্বিক, লোকতাত্ত্বিক এবং সমাজতাত্ত্বিক উত্তরাধিকারের ছাপ। এখানে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সাঁওতাল, কোল, মুন্ডা, শবর ইত্যাদি জনজাতির বাস। তাই এখানকার কথ্যভাষা বিপুল পরিমাণ অস্ট্রিক শব্দে সমৃদ্ধ। গ্রামীণ বর্ধমানে তাই, ‘কুকড়া’ (মুরগি), ‘চেলা’ (শিষ্য), ‘বেজায়’ (অতিরিক্ত), ‘পিলে’ (প্লীহা), ‘গজাল’ বা ‘জলুই’ (পেরেক) ইত্যাদি শব্দের অবারিত ব্যবহার। পশ্চিমবঙ্গের অন্য যে সব এলাকায় রাঢ়ী উপভাষা প্রচলিত রয়েছে, সেখানে এত বিপুল অনার্য উৎসজাত শব্দের ব্যবহার

সুলভ নয়।

বাক্যের গঠনগত দিক থেকেও বর্ধমানের লোকভাষার কিছু স্বতন্ত্রতা রয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান জেলার কথনরীতিতে ক্রিয়াপদের বিশেষ ব্যবহার লক্ষ করা যায়, যা বাঁকুড়া, পুরুলিয়া বা বীরভূমের থেকে পৃথক। বর্ধমানের বিভিন্ন গ্রামে আমরা দেখি কেউ কাউকে খেতে বলার সময় ‘বাবা ভাত খেগে যা’ বলে থাকেন। এই ‘খেগে যা’ শব্দটি প্রকৃতপক্ষে ‘খেতে যাও’ শব্দকে বোঝায়। এই ক্রিয়াপদটির বর্ধমানের কথ্যভাষার নিজস্ব সম্পদ।

ক্রিয়াপদের মতোই ঐতিহ্য সূত্রে বর্ধমানের লোকভাষার মধ্যে প্রবেশ করেছে এমন আঞ্চলিক শব্দ যা দীর্ঘদিন ধরে মান্যভাষার প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অথচ এই এলাকার বাইরে এই শব্দগুলি নিছকই অর্থহীন ধ্বনিসমষ্টি। যেমন, ‘টিরটির’ শব্দটি। আজও গ্রামীণ বর্ধমানের বহু মানুষ তাঁর সন্তানকে আদর করে বলেন, ‘‘বাবা খোকন, অত টিরটির কোর না, তাইলে কুনো কাজই হবে না’’। এই শব্দটি এখানে ‘দীর্ঘকাল ধরে ছটফট করা’-র প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ভাবেই দীর্ঘকাল ধরে ‘পর্যায়ক্রমে’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ‘উলোপালি’, ‘অস্থির হওয়া’র প্রতিশব্দ হিসেবে ‘আকুলি বিকুলি’ শব্দটি ব্যবহার হয়ে আসছে।

কথ্যভাষার এই বৈচিত্রময় রূপ লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে বিভিন্ন লোকগানে এবং আঞ্চলিক সাহিত্যে। আউশগ্রামে বাঁধাগান নামে এক ধরনের লোকসঙ্গীত প্রচলিত। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘ও আমের মা ও আমের মা আজকে আমের অধদিবাস/ চৌকাটেতে নেকা আছে চোদ্দ বছর বচর বনবাস/ ও আম জটাধারী/ সঙ্গে সেতা সোন্দরী’। মান্য চলিতে যা দাঁড়ায়, ‘‘ও রামের মা ও রামের মা/ আজকে রামের অধিবাস/ চৌকাঠাতে লেখা আছে চোদ্দ বছর বনবাস/ ও রাম জটাধারী/ সঙ্গে সীতা সুন্দরী।’’ সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন লেখায় ফুটে উঠেছে বীরভূমের কথ্য ভাষারীতি।

নগরায়ণ, এক জেলার মানুষের অন্য জেলার বাস ইত্যাদির সুবাদে কথ্য ভাষার অনেক বৈশিষ্ট্যই আজ বিলুপ্তির পথে। সেই জায়গার কিছুটা ভরাট করছে চলিত ভাষা। বাকিটা ইংরেজি, হিন্দি। কিন্তু আমাদের আঞ্চলিক কথ্যভাষায় জড়িয়ে রয়েছে আমাদের সংস্কৃতি, আঞ্চলিক ও সমাজ ইতিহাসের অনেক মূল্যবান উপাদান। সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাই অতীতকে খোঁজা প্রয়োজন। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, রাঢ় বাংলার কথ্যভাষা এখনও গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে সে ভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না।

বর্ধমানের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE