Advertisement
E-Paper

শক্তিমান রাষ্ট্রকে সামলাতে পারলে হয়

স  রকার যে দিন ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করল তার পরের দিন সকাল। এক সহকর্মীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। নোট বাতিলের সামাজিক ক্ষতির তুলনায় এর সামাজিক লাভ সামান্যই, এ কথা মেনে নিয়েও তাঁর মন্তব্য, ‘তবে যা-ই বলো, এ রকম একটা নীতি নিতে কিন্তু বুকের পাটা লাগে।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০

স  রকার যে দিন ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করল তার পরের দিন সকাল। এক সহকর্মীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। নোট বাতিলের সামাজিক ক্ষতির তুলনায় এর সামাজিক লাভ সামান্যই, এ কথা মেনে নিয়েও তাঁর মন্তব্য, ‘তবে যা-ই বলো, এ রকম একটা নীতি নিতে কিন্তু বুকের পাটা লাগে, ভারতের আর কোনও নেতার সাহস হত না!’ এ কথাটা কিন্তু তাঁর একার নয়। কালো টাকার নিয়ন্ত্রণে নোট বাতিলের তেমন কোনও প্রভাব পড়বে না, বরং তার থেকে অনেক বেশি নঞর্থক প্রভাব পড়বে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায়— বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ এই সাবধানবাণী শোনানোর পরেও ফেসবুক, টুইটার, হোয়টস্যাপে নোট বাতিলের নীতির প্রতি স্মার্ট নাগরিকদের জোরালো সমর্থন ভেসে বেড়াচ্ছে।

এই সমর্থন তিনি পাবেন, এর একটা হিসেব প্রধানমন্ত্রীর ছিল। নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে এক ধরনের ঝুঁকি থাকলেও, তা বেহিসেবি নয়। হয়তো সে হিসেব ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের, দুর্নীতি বন্ধের নয়, তবু তাকে কোনও ভাবেই খামখেয়াল বলা চলে না। সেই রাজনৈতিক হিসেব এখানে আলোচ্য নয়। অর্থনীতিবিদরা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন, কেন নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশি, সেই আলোচনারও পুনরাবৃত্তি করছি না। বুঝতে চাইছি এই নীতির চাহিদার দিকটা, অর্থাৎ নিজেদের অসুবিধা, অর্থনীতিবিদদের সাবধানবাণী, এ সব উপেক্ষা করে এক শ্রেণির লোক কেন সমর্থন করছেন নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত।

লাভক্ষতির হিসেবের ঊর্ধ্বে নোট বাতিলের মধ্যে একটা বীরত্ব দেখতে চাইছে জনগণের একাংশ। এই মানসিকতা কিন্তু খুব বিরল নয়, এই কারণেই লোকে যুদ্ধ চায়, পুলিশ এনকাউন্টারে অপরাধীর মৃত্যু চায়। নোট বাতিল নীতির যে জুয়া, তা আসলে এই গণ-মানসিকতার ভরসাতেই নেওয়া! খুব অভিনব নয় কঠোর রাষ্ট্রের এই প্রকল্প। প্রায় চার দশক আগেই শঙ্খ ঘোষ পরম বিস্ময়ে লক্ষ করেছিলেন বাক্‌স্বাধীনতার থেকে কেমন জরুরি হয়ে উঠছে ঠিক সময়ে রেলগাড়ি চলা! মধ্যবিত্ত যাপন থেকে উঠে আসা এই উটপাখিসুলভ নিশ্চিন্ততা স্লোগান হয়ে আড়াআড়ি ঝুলে পড়ছিল রাস্তার মাথায়: কঠিন পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। সেই স্লোগানকেই, এক অনবদ্য শ্লেষে, কবিতায় উলটে নিয়েছিলেন শঙ্খবাবু: কথা তবু থেকে যায় কথার মনেই/ কঠোর বিকল্পের পরিশ্রম নেই।

সময় পালটে গেছে, শাসকও। তবু রাষ্ট্রীয় কঠোরতার এই প্রকল্প বার বার প্রত্যাবর্তন করে। সক্রিয় রাষ্ট্রের প্রতি এই মোহ বিভিন্ন দাবিকে সামনে রেখে ফিরে ফিরে আসে। কখনও তা এনকাউন্টার, কখনও যুদ্ধ, কখনও আবার দুর্নীতি আর কালো টাকা। সক্রিয় রাষ্ট্রের এই দাবি কিন্তু মূলত আসে মধ্যবিত্তদের কাছ থেকে, আর তাঁরাই সোশাল মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে সক্রিয়। তাই সক্রিয় রাষ্ট্রের দাবি অনেক জোরালো হয়ে শোনা যায়।

ঈশপের গল্প

ব্যাঙেরা এক বার দেবরাজ জিউস-এর দ্বারস্থ হয়েছিল রাজা চেয়ে। জিউস দিলেন একটা বিরাট কাঠের গুঁড়িকে রাজা করে। তার চেহারা বড়, কিন্তু জলে পড়ে থাকে, নড়ে না চড়ে না। এ রকম রাজার কোনও মর্যাদা নেই। ব্যাঙেরা আবার গেল জিউস-এর কাছে, আরও সক্রিয় রাজার আর্জি নিয়ে। এ বার দেবরাজ পাঠালেন এক সারসকে। দেখে ব্যাঙেরা খুব খুশি। বেশ একটা রাজকীয় ভাব আছে নতুন রাজার মধ্যে। এক বুড়ো ব্যাং এগিয়ে গেল অভ্যর্থনা করতে। কিন্তু নতুন রাজা এই বেয়াদবি বরদাস্ত করলেন না, কপাত করে মুখে পুরে দিলেন। সকলে চমৎকৃত এই ভেবে যে, বেশ এক জন জবরদস্ত রাজা পাওয়া গেছে। ক্রমশ বোঝা গেল, নতুন রাজা একটু বেশিই কঠোর— প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ চরম শাস্তি পেতে থাকে। ব্যাঙেদের মনে হল এর থেকে কাঠের গুঁড়িই ভাল ছিল। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে মধ্যবিত্তের সমর্থনের একটা কারণ হয়তো এটাই যে, এই সিদ্ধান্তে কার্ড ব্যবহারে অভ্যস্ত মধ্যবিত্তের সমস্যা কম। কিন্তু অন্য দিকে কর ফাঁকি বন্ধ হলে মধ্যবিত্তদের লাভও তত বেশি নয়। কারণ তাঁরা করের টাকায় তৈরি সামাজিক দ্রব্য ব্যবহার করেন কম। তাঁরা ছেলেমেয়েকে বেসরকারি স্কুলে পাঠান, অসুখ করলে নার্সিংহোমে যান। নোট বাতিলের নীতি কালো টাকা বন্ধে কতটা অকার্যকর, সেই হিসেব দিয়ে মধ্যবিত্তের এই সমর্থনকে তাই টলানো যাবে না। কারণ সে দেখেছে এই নীতি আসলে শক্তিশালী রাষ্ট্রের বার্তা বহন করে। শক্তিশালী রাষ্ট্র মানে কি? যে রাষ্ট্র তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারে, চাপের মুখে পিছু হটে না, যার সঙ্গে কোনও ভাবে সমঝোতা করা যায় না। মনে রাখবেন, রাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে সমঝোতা করেন খুব গরিব বা খুব বড়লোকরা, যদিও দু’ভাবে। খুব বড়লোকরা সমঝোতা করেন আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে (ঘুষ, রাজনৈতিক অনুদান বা অন্য কোনও পদ্ধতিতে) আর গরিবরা সমঝোতা করেন রাজনৈতিক ভাবে, ভোট দিয়ে বা দলীয় সভাসমিতিতে গিয়ে। কিন্তু সমঝোতা করার এই দুটি পদ্ধতিই মধ্যবিত্তের কাছে বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। কারণ, এক দিকে তার কাছে বড়লোকের মতো অর্থ নেই, অন্য দিকে তার সময়ের সু্যোগ-মূল্য (যা তার মজুরির হার দিয়ে নির্ধারিত হয়) গরিবের চেয়ে বেশি। তাই মধ্যবিত্ত সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়াতে চায়, যার সঙ্গে সমঝোতা করা যায় না।

সরকারও এই বাস্তবতা জানে। নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরে উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অনেক নতুন নতুন সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নীতিগত ভাবে দু’দিকে যেতে পারত। এক, কালো টাকার মালিকদের শাস্তি দিতে গিয়ে যেন সৎ মানুষদের অসুবিধে না হয়। দুই, সৎ মানুষদের সুবিধে করতে গিয়ে যেন কালো টাকার মালিকরা ছাড় না পান। বিচারের রায়েও কিন্তু এই দু’রকম ভুল হওয়ারই সম্ভাবনা থাকে: নির্দোষকে শাস্তি দেওয়া এবং দোষীকে মুক্তি দেওয়া। যে কোনও সভ্য দেশের বিচারব্যবস্থার সাধারণ নীতি হল— যে কোনও ভুলই খারাপ, কিন্তু প্রথম ভুলটি দ্বিতীয় ভুলের থেকে অনেক বেশি মারাত্মক। ৯ নভেম্বরের পরবর্তী সিদ্ধান্তগুলি পর্যালোচনা করলে দেখবেন, তার মূল ঝোঁকটি এর ঠিক উলটো— যাবতীয় উদ্যোগ ওই কালো টাকার মালিকদের অসুবিধে ঘটানোর জন্য, সাধারণ মানুষের সমস্যা সেখানে ধর্তব্য নয়।

ডেবিট, ক্রেডিট কার্ড, ই-ওয়ালেট শোভিত মধ্যবিত্তরাও অল্পসল্প কষ্ট করছেন বইকী। দু’তিন ঘন্টা ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়াচ্ছেন বা পাড়ার মুদির দোকানে না গিয়ে এক কিলোমিটার দূরের শপিং মলে যাচ্ছেন। ভয় হয় তাঁরা বোধহয় এই কষ্টটাকেই সমাধানের লক্ষণ বলে ভাবতে শুরু করেছেন। উচ্ছে, কুইনাইন স্বাস্থের পক্ষে জরুরি, এটা শুনতে শুনতে এই বিশ্বাস জন্মে যেতে পারে— যা তেতো তা-ই স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। কঠোর রাষ্ট্রের সঙ্গে মধ্যবিত্তের এই মধুচন্দ্রিমা কতটা দীর্ঘ হবে তার উপর নোট বাতিলের নীতির রাজনৈতিক সাফল্য নির্ভরশীল। যদি এই নগদ সমস্যা রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতি করে তখন কিন্তু নোট বাতিলের সমস্যা আর দশ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ব্যাঙ্কে আসা আদিবাসীর বা নোটের অভাবে কলেজ ফি দিতে না পেরে আত্মহত্যা করা তরুণের সমস্যা থাকবে না। তখন তা আমার আপনার লাইন দিয়েও চাল না পাওয়ার সমস্যায় নেমে আসতে হতে পারে।

শেষ করি ঈশপের একটা গল্প দিয়ে। ব্যাঙেরা এক বার দেবরাজ জিউস-এর দ্বারস্থ হয়েছিল রাজা চেয়ে। জিউস দিলেন একটা বিরাট কাঠের গুঁড়িকে রাজা করে। তার চেহারা বড়, কিন্তু জলে পড়ে থাকে, নড়ে না চড়ে না। এ রকম রাজার কোনও মর্যাদা নেই। ব্যাঙেরা আবার গেল জিউস-এর কাছে, আরও সক্রিয় রাজার আর্জি নিয়ে। এ বার দেবরাজ পাঠালেন এক সারসকে। দেখে ব্যাঙেরা খুব খুশি। বেশ একটা রাজকীয় ভাব আছে নতুন রাজার মধ্যে। এক বুড়ো ব্যাং এগিয়ে গেল অভ্যর্থনা করতে। কিন্তু নতুন রাজা এই বেয়াদবি বরদাস্ত করলেন না, কপাত করে মুখে পুরে দিলেন। সকলে চমৎকৃত এই ভেবে যে, বেশ এক জন জবরদস্ত রাজা পাওয়া গেছে। ক্রমশ বোঝা গেল, নতুন রাজা একটু বেশিই কঠোর— প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ চরম শাস্তি পেতে থাকে। ব্যাঙেদের মনে হল এর থেকে কাঠের গুঁড়িই ভাল ছিল। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy