Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

অ-স্বীকার

নাম ব্যক্তির পরিচয়-সূচক। নাম উচ্চারণ ব্যক্তিকে স্বীকৃতি দেয়।

ছবি এএফপি।

ছবি এএফপি।

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

সে  কুখ্যাতি চাহিয়াছে, কিন্তু আপনারা আমাকে কখনও তাহার নাম উচ্চারণ করিতে শুনিবেন না। সে সন্ত্রাসী, মারাত্মক অপরাধী, জঙ্গি, সে অনেক কিছু চাহিয়াছে, কিন্তু আমি যখন তাহাকে লইয়া কথা বলিব, সে থাকিবে নামহীন। নিউজ়িল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে পৈশাচিক সন্ত্রাসের কারিগর সম্পর্কে কথাগুলি বলিয়াছেন প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডের্ন। এই অনন্য দেশনেত্রী যে বোধের প্রেরণায় কথাটি বলিয়াছেন, তাহা বাস্তবিকই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। কেবল এই একটি বিশেষ ঘটনার প্রসঙ্গে মূল্যবান নহে, এই ধরনের, বস্তুত অনেক ধরনের অন্যায়ের প্রসঙ্গেই গুরুত্বপূর্ণ। গত কয়েক দিনে এই নেত্রীর বিভিন্ন মন্তব্য ও আচরণ গোটা দুনিয়ার সামনে এক বিরল আদর্শকে তুলিয়া ধরিয়াছে, অগণিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ভাবিয়াছেন, আজও এমন হয়! অতলান্ত নৈরাশ্যের মধ্যেও গ্রহবাসীর মনে আশা জাগিয়াছে— তবে এখনও সব ভরসা ফুরাইয়া যায় নাই, কিছু অবশিষ্ট আছে! প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তিও সেই ধারার অনুসারী।

নাম ব্যক্তির পরিচয়-সূচক। নাম উচ্চারণ ব্যক্তিকে স্বীকৃতি দেয়। রাজা-বাদশাহরা দরবারে প্রবেশের আগে তাঁহাদের বহু-উপাধি-খচিত দীর্ঘনামাবলি উচ্চৈঃস্বরে ধ্বনিত হইত, তাহার বিলক্ষণ কারণ ছিল— ওই নামকীর্তনেই সমবেত সভাসদ ও প্রজারা বারংবার টের পাইতেন, ইহা আগমন নহে, আবির্ভাব। সাধারণ্যেও ব্যক্তিকে নাম ধরিয়া ডাকিবার মধ্যে তাঁহার অস্তিত্ব, উপস্থিতি এবং ব্যক্তিত্বকে স্বীকৃতি দিবার একটি রীতি সুপ্রতিষ্ঠিত। নাম না বলিয়া ডাকিবার মধ্যে অনেক সময়েই অবজ্ঞা ফুটিয়া উঠে, ইহা সমাজবিধির পরিচিত অঙ্গ। সুতরাং, সন্ত্রাসী ঘাতকের নাম উচ্চারণ না করিবার মধ্য দিয়া তাহার প্রতি তীব্র মানবিক অস্বীকৃতি ঘোষণার প্রকল্পটি তাৎপর্যপূর্ণ। এই অস্বীকৃতিতে সেই গণ-হত্যাকারীর কিছু যায় আসে কি না, তাহা লইয়া মাথা ঘামাইবার প্রয়োজন নাই। কিন্তু ইহার গুরুত্ব সমাজের কাছে, সমাজ-মানসিকতার কাছে। নাগরিক যদি এই অ-স্বীকারের মূল্য অনুধাবন করিতে পারেন, তাহা যথাযথ সামাজিক মূল্যবোধের প্রসারে সাহায্য করিবে। সামাজিক মানুষ বুঝিবে এবং বলিবে— অপরাধীর কোনও স্বীকৃতি নাই। জনস্মৃতিতে সে অস্তিত্বহীন, মৃত।

ঘাতক, অপরাধী, অন্যায়কারীকে জনপরিসরে অ-স্বীকার করিবার এই পথটি প্রচলিত পথ নহে। কিন্তু তাহার প্রাসঙ্গিকতা লইয়া ভাবিবার কারণ আছে। বিশেষত বর্তমান পৃথিবীতে, যখন তাৎক্ষণিক বিপুল প্রচারের সুযোগ অভূতপূর্ব ভাবে বাড়িয়া গিয়াছে এবং বিবিধ অন্যায়, অপরাধ, সন্ত্রাসের কারিগররা সেই সুযোগ পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করিতেছে। দুনিয়ায় ও দেশে, বাহিরে ও ঘরে বিদ্বেষ এবং হিংস্রতার প্রচার কোন আকার ধারণ করিতে পারে, তাহা আজ আর কোনও সজাগ নাগরিককে বলিয়া দিবার প্রয়োজন নাই। সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিসরে, নির্বাচনী প্রচার হইতে শুরু করিয়া দৈনন্দিন আলাপে, সমস্ত ক্ষেত্রেই এই অশুভ শক্তিদের অ-স্বীকার করিবার প্রয়োজন আছে। তাহা নিছক নাম উল্লেখ করিবার বা না-করিবার প্রশ্ন নহে, তাহা বিদ্বেষ, হিংস্রতা এবং সন্ত্রাসের মানসিকতাকে প্রবল প্রত্যয়ে নাকচ করিবার প্রশ্ন। তাহার মুখের উপর সাফ সাফ এই কথা বলিয়া দিবার প্রশ্ন যে, তুমি মানুষ নামের যোগ্য নও। তাহাই প্রকৃত অ-স্বীকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE