তিস্তা-করলা-কালজানি-জলঢাকা স্নেহাশ্রিতা হিমালয় দুহিতা জলপাইগুড়ি একশো পঞ্চাশ বছরে পদাপর্ণ করেছে।
জল, জলাভূমি, জঙ্গল। এই তিনেই জলপাইগুড়ির অমঙ্গল।
‘কাটা-মারী-গুড়ি' নাম যুক্ত জনপদের দেশ হিসেবে জলপাইগুড়ি সবিশেষ পরিচিত। আসলে জলপাইগুড়ি জেলার সিংগভাগ জনপদের নামই কাটা- মারী-গুড়ি দিয়ে শেষ হয়। আবার অনেকে বলেন যে জলপাইগুড়ি হল তিন ‘ঈশ্বরের দেশ’—জল্পেশ্বর, জটিলেশ্বর, জটেশ্বর। স্থানিক বাসীদের অনক্ষর অংশ এই ভূখণ্ডকে ‘মহাকালের দেশ’ বলে জানেন। সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘গণনায়ক’ গল্পে এই মহাকালের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখিত হয়েছে। তবে স্থানীয় তন্ত্র সাহিত্যে এই অঞ্চলকে ‘রত্নপীঠ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। মহাকাব্য ও পুরাণে সামগ্রিক ভাবে এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডকে ‘কিরাত দেশ’ বলে চিহ্ণিত করা হয়েছে। সম্ভবত এই সময়ই এই অঞ্চল ‘পাণ্ডব বর্জিত’ দেশ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিল। অর্থাৎ পাণ্ডবরা অন্যত্র গেলেও এ অঞ্চলে আসেনি।
তিস্তা-করলা-কালজানি-জলঢাকা স্নেহাশ্রিতা হিমালয় দুহিতা জলপাইগুড়ি একশো পঞ্চাশ বছরে পদাপর্ণ করেছে। এই জনপদের ইতিহাস স্মরণ শুধু স্মৃতি তর্পণ নয়, এই স্মরণের মাধ্যমে নিজেদেরও জানার একটা সুযোগ পাওয়া যায়। অর্থাৎ শিকড়ের দিকে ফিরে তাকানো যায়। আমি এবং আমার মতো অনেকেরই জলপাইগুড়ি পিতৃভূমি নয়, মাতৃভূমি নয়, জন্মভূমিও নয় কিন্তু আশ্রয়ভূমি। জলপাইগুড়ি আমার মতো বাস্তুত্যাগী আশ্রয়চ্যুত অনেকেরই আশ্রয়দাত্রী। এই জন্যই সে আমাদের প্রিয়তমা জনপদ। মাতৃভূমি জন্ম দিয়েছিল কিন্তু আশ্রয় দেয়নি, মানুষ করেনি। তাই জলপাইগুড়ি আমাদের অনেকের কাছে মাতৃ-পিতৃ-জন্মভূমির চেয়েও প্রিয়তর। আমরা অনেকেই তার সন্তান নই, কিন্তু সে আমাদের সন্তানবৎ লালন-পালন করে আসছে। এই ‘নতুন মায়ের’ ঋণ শোধ করতে আমরা সর্বদাই তৎপর। কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, হিংস্রপ্রাণী অধ্যুষিত এই জনপদকে স্বর্ণ সম্ভাবনা পূর্ণ করে তুলে দেন ভাগ্যান্বেষীরা। ভাগ্যান্বেষীরা না এলে এই জনপদের চেহারা আজ কী হত বলা মুশকিল। ইতিহাসবিদ রেবতীমোহন লাহিড়ী এই প্রসঙ্গে লিখেছেন ‘নব ইহুদীদের আগমন না ঘটিলে জলপাইগুড়ির উন্নতি এত ব্যাপক ও ত্বরান্বিত হইত না। এই নব জনস্রোত জিলার ভার না হইয়া সব দিক দিয়াই এই জেলাকে ভারী করিয়া তুলিয়াছে।’’
এই নব ইহুদি ও ভাগ্যান্বেষীদের আত্ম প্রতিষ্ঠার কাহিনি সত্যই চমকপ্রদ। এই ভাবে এক সময়ের ‘পাণ্ডববর্জিত’ দেশকে ‘সবুজ উপনিবেশের রাজধানী’তে রূপান্তরিত করেছিল মূলত এই ভাগ্যান্বেষীরা ও অভিবাসীরা। এই ভাগ্যান্বেষীদের চেষ্টাতেই সফল বাঙালি শিল্প উদ্যোগের (চা-শিল্প) বিকাশ ঘটেছিল, বঙ্গদেশের এই প্রান্তীয় অঞ্চলে উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত। যদিও সে গৌরব এখন অস্তমিত প্রায়।
জেলার ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, ইতিহাস, জনবিন্যাস, ভাষা ও ধর্মীয় বিভিন্নতা বিশ্লেষণ করলে জেলাটিকে ভারতবর্ষের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলে মনে হবে। পাহাড়, বনভূমি, চা-বাগান, সমতলভূমি আর দুরন্ত তিস্তার সমবায়ে গঠিত জলপাইগুড়ি জেলার বৈশিষ্ট্য অনন্যসাধারণ। জেলা হিসাবে জলপাইগুড়ির যাত্রা ১৮৬৯ সালে শুরু হলেও এই জনপদের ইতিহাস কিন্তু সুপ্রাচীন। অবশ্য এর স্বপক্ষে ‘পাথুরে প্রমাণ’ কতটা, তা বলার সময় এখনও আসেনি।
তবে প্রবাদ, স্মৃতি ও জনশ্রুতিতে একটি খণ্ড চিত্র পাওয়া যায়। প্রবাদের কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। প্রবাদ থেকে পুরাণে অবতরণ করলে এই জনপদের একটি কাহিনি জানতে পারি স্কন্দ পুরাণের রাজা জল্প বা জল্পেশ্বরের মাধ্যমে। এর পরের সময়ের এই জনপদের ধারাবাহিক ইতিহাসটি ধূসর।
তবে এই হিমালয় অঞ্চলে তিব্বতীদের আগমন ঘটে। এই তিব্বতীরাই হিমালয় থেকে সমতলে নেমে এসেছিলেন বলে অনুমান করা হয়। তিব্বতীরা পরে ভুটিয়া বা ভোটানি নামে পরিচিতি পেয়েছিল। এই তিব্বতী- ভোটিয়াদের পদচিহ্ণ রয়েছে ময়নাগুড়ি ও সন্নিহিত জনপদে। তখন হিমালয় থেকে চামরচি হয়ে ময়নাগুড়ির মধ্যে দিয়ে রংপুরের সমতল অঞ্চলে তিব্বতীরা ব্যবসা করতে আসতেন শীতকালে। অরুণভূষণ মজুমদার এসব কথা জানিয়েছেন।
তবে চতুর্দশ শতাব্দীতে পরাক্রমশালী খ্যান বা খেন বংশের আবির্ভাবের ফলে এই জনপদের ইতিহাস আবার মূলস্রোতে ফিরে আসে। খ্যান বংশের পতনের পরে কোচ রাজবংশ তথা কোচ সাম্রাজ্যের উত্থান সমগ্র উত্তর পূর্ব ভারত সহ উত্তরবঙ্গের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। কোচ রাজবংশের শাখা হিসাবে রায়কত বংশের উদ্ভব ঘটে এই জনপদে। তখন জনপদটির নাম হয় বৈকুন্ঠপুর। অবশ্য বৈকুন্ঠপুরের পূর্বে কী নাম ছিল, তা এখনও জানা যায়নি। জলপাইগুড়ি নামটি কবে থেকে প্রচলিত হয়েছিল, তাও স্পষ্ট নয়।
আসলে পঞ্চম বেদ রূপে সম্মানিত বা অভিহিত ইতিহাস বিদ্যা কেন যে এখানে চর্চা হয় নি তার কারণও অস্পষ্ট। এর ফলে ইতিহাস এখানে অনেক সময়েই কাহিনীতে রূপান্তরিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু আমাদের জানা দরকার যে কাহিনি ইতিহাস নয়, ইতিহাসের অপরিহার্য উপাদান মাত্র। কাহিনিগুলোর অধিকাংশই আবার অনুমান নির্ভর। অনুমান সত্যের কাছাকাছি উপনীত হওয়ার অন্যতম পথ ঠিকই, কিন্তু অনুমানের চৌকাঠ পেরিয়ে এসে, সত্যানুসন্ধান করাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব। তীব্র বাস্তব সত্য হচ্ছে একশো বছরের পদার্পণের পর্বে বিদ্যা- বিত্ত-চিত্তে এই ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর ও হিংস্রপ্রাণীর জনপদ জলপাইগুড়ি হয়ে উঠেছিল এক স্বর্ণ ভূখণ্ড।
(মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy