মুম্বইয়ের পুড়িয়া যাওয়া রেস্তরাঁয় তদন্ত শেষ হইলে জানা যাইবে, আগুন কেন লাগিয়াছিল। দক্ষিণ কলিকাতার বেসরকারি হাসপাতাল, বড়বাজারের বাণিজ্যিক বহুতল, পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্ট অথবা সার্কুলার রোডের হোটেল, সর্বত্রই যেমন কিছু নির্দিষ্ট কারণ খুঁজিয়া পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু, কলিকাতার তিলজলা এলাকার বস্তি হইতে মুম্বইয়ের লোয়ার প্যারেল-এর জমজমাট উচ্চবিত্ত বিপণি— একটি কারণ সর্বত্রই সমান সত্য: আগুন লাগিবার প্রাথমিক কারণ দুর্নীতি। কোনও বাণিজ্যিক কেন্দ্র চালাইবার জন্য যে অগ্নিবিধি মান্য করিবার কথা, অনুমান করা চলে, ভারতের কোনও প্রান্তেই তাহার অংশমাত্রও কেহ মানে না। সেই তুমুল অবহেলা প্রশাসনের নজর এড়াইয়া চলিতে পারে না। মুম্বইয়ের ঘটনায় ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক জন আধিকারিক সাসপেন্ড বা বদলি হইয়াছেন। বহু ক্ষেত্রেই এই প্রতীকী শাস্তির ব্যবস্থাটুকুও করা হয় না। বে-আইনি নির্মাণ হইতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অভাব, আপৎকালীন নিষ্ক্রমণের পথের নামে নির্মম ঠাট্টা হইতে জমিয়া থাকা দাহ্য পদার্থের পাহাড়, কিছুই ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকরা দেখিতে পান না। হয়তো কাঞ্চনমূল্যে তাঁহারা দৃষ্টিশক্তি বেচিয়া দেন। আর, এই দুর্নীতির ফাঁক গলিয়াই কখনও জন্মদিনের অনুষ্ঠান পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে, কখনও নিরাময়ের প্রত্যাশায় হাসপাতালে আসা রোগী বেঘোরে মারা পড়েন।
এক একটি দুর্ঘটনার পর প্রশাসনিক তৎপরতা আরম্ভ হয়, যাহার মেয়াদ— অতি উদার হিসাবেও— বড় জোর কয়েক সপ্তাহ। তাহার পর সবই পূর্ববৎ চলিতে থাকে। দুর্নীতি বস্তুটি এমনই ‘স্বাভাবিক’ হইয়া উঠিয়াছে যে আধিকারিকরা সম্ভবত ভাবিয়াও দেখেন না যে তাঁহাদের অসৎ লোভ কতখানি মারাত্মক হইতে পারে। ব্যবসায়ীরাও খানিক লাভের আশায় ঝুঁকি লইতে থাকেন। এই আচরণ হয়তো মানুষের স্বভাবগত। কোন কাজে ঝুঁকি কত, তাহার নিখুঁত হিসাব করিবার ক্ষমতা মানুষের মনের, বা মগজের, নাই। মানুষ বড় জোর অনুমান করিতে পারে। এবং, সেই অনুমানের ভিত্তি মূলত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। যেহেতু প্রতি দিন আগুন লাগে না, এবং বেশির ভাগ মানুষেরই অগ্নিকাণ্ডের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নাই, ফলে অগ্নিবিধি অগ্রাহ্য করার ঝুঁকিকে মানুষ প্রকৃত মাপের তুলনায় ঢের ছোট করিয়া দেখে। সেই ক্ষতির সম্ভাবনার তুলনায় লাভের অঙ্কটি বড় হইয়া দাঁড়ায়।
উপভোক্তাদের মনও সেই পথেই চলে। কোনও রেস্তরাঁয় যাইবার পূর্বে কেহ কি সেই পরিসরের অগ্নি-নিরাপত্তার খোঁজ নেওয়ার কথা ভাবেন? তর্কের খাতিরে ধরিয়া লওয়া যায়, উপভোক্তারা বাণিজ্যিক পরিসরের অগ্নি-নিরাপত্তার নিশ্চয়তাকে স্বতঃসিদ্ধ বলিয়া মানেন। কেহ অভিজ্ঞতা হইতে শিক্ষা লইলে এই অলীক নিশ্চয়তায় কেন ভুগিবেন, তাহা বোঝা অবশ্য অসম্ভব। কিন্তু, কোনও রেস্তরাঁ যদি সম্পূর্ণ বিধি মানিয়া অগ্নি-নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে, এবং উপভোক্তার নিকট সেই খরচ বাবদ একটি নির্দিষ্ট টাকা দাবি করে, ক্রেতারা কি দিতে সম্মত হইবেন? সত্য ইহাই যে, ক্রেতারাও আগুনের বিপদ সম্বন্ধে উদাসীন। তাঁহারাও ধরিয়াই লন, এই বিপদ তাঁহাদের হইবে না। বারুদের স্তূপে বসিয়াও যে কতখানি নিশ্চিন্ত থাকা যায়, ভারতের প্রতিটি প্রান্ত রোজ সেই আশ্চর্য অভিজ্ঞতার সাক্ষী হইতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy