Advertisement
E-Paper

ভাষা চাপিয়ে দেওয়া যায় না

অনেক রাজ্যেই এই ভাষাগত সংখ্যালঘুরা বেশ সংহত বহুলতা নিয়ে বাস করেন, তাই তাঁদের ভাষা যাতে প্রশাসন ও শিক্ষায় অবহেলিত না হয়, রাষ্ট্রের তা দেখার কথা।

পবিত্র সরকার

শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৭ ১৩:৪১

এখন আমাদের কি কোনও ভাষানীতি আছে? কেন্দ্রের? রাজ্যের? না কি আমরা নানা অবস্থার মুখোমুখি হয়ে নানা প্ররোচনায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছি একের পর এক, এবং তারই ফলে নানা ভোগান্তি?

এটা ঠিক যে, ভারতীয় সংবিধান সেই ১৯৫০ সালে ৩৪২ থেকে ৩৫৩ ধারার মধ্যে একটা মোটামুটি ভাষানীতি তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার দুটি ত্রুটি ছিল। প্রথমত, তা কেবল সমৃদ্ধ সাহিত্য-সম্পন্ন, লিখিত প্রাদেশিক ভাষাগুলিকে স্বীকার করেছিল, প্রথমে ১৪টিকে নিয়ে। তা যে অসম্পূর্ণ ছিল তা বোঝাই যায়— ১৯৬৭ থেকেই সংবিধান সংশোধন করে একে একে নতুন ভাষা যোগ করা শুরু হল, প্রথমে সিন্ধিকে দিয়ে, এখন তো ২৩টি ভাষা দাঁড়িয়েছে। শ্রীপট্টি রামালুর আত্মদানের পর যখন মাদ্রাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে অন্ধ্রপ্রদেশ গঠিত হয়, এবং তার প্রেরণায় ১৯৫৬ সালে অন্যান্য ভাষাভিত্তিক রাজ্যগুলি পুনর্গঠিত হয়, তখন দ্বিতীয় ত্রুটিটি প্রকট হয়ে ওঠে। তা হল, যে ভাষাগুলি এক রাজ্যে প্রধান ও প্রশাসনিক ভাষা, কিন্তু অন্য রাজ্যে সংখ্যালঘু— সেগুলি সম্বন্ধে নীতি কী হবে, সে বিষয়ে খুব স্পষ্ট নির্দেশ সংবিধানে ছিল না। অসমে বাংলা ভাষা, পশ্চিমবঙ্গে সাঁওতালি ও নেপালি, ওডিশায় সাঁওতালি, ঝাড়খণ্ড ও বিহারে বাংলা ও উর্দু, অন্ধ্রপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশে উর্দু, গুজরাতে মরাঠি, কর্নাটকে তেলুগু, কেরলে তামিল ইত্যাদি তার দৃষ্টান্ত।

অনেক রাজ্যেই এই ভাষাগত সংখ্যালঘুরা বেশ সংহত বহুলতা নিয়ে বাস করেন, তাই তাঁদের ভাষা যাতে প্রশাসন ও শিক্ষায় অবহেলিত না হয়, রাষ্ট্রের তা দেখার কথা। সে সম্বন্ধে বিভ্রান্তির ফলে রাজ্যগুলিকে পরে ভুগতে হয়েছে, এবং শিক্ষা প্রশাসন ইত্যাদিতে নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সে সিদ্ধান্ত সব সময় সমাজবিজ্ঞান বা ভাষাবিজ্ঞান মেনে হয়নি, তাতে প্রাদেশিক ও ভোটনির্ভর রাজনীতির, সংখ্যাগুরুর সংকীর্ণতার চাপ যথেষ্ট ছিল, এবং তাই নিয়ে নানা অশান্তির উদ্ভব হয়েছে।

যে সব ভাষা-সংখ্যালঘু গোষ্ঠী খুব বড় নয়, আর কোনও একটি জায়গায় সংহত ভাবে অবস্থান করেন না, তাঁদের ভাষার উপযুক্ত ব্যবহার এবং মর্যাদা নিয়ে সমস্যা আছে, কিন্তু তা এ নিবন্ধে আলোচ্য নয়।

মনে রাখতে হবে, কে কী ভাষা মুখে বলছেন তার উপর পরিকল্পনাকারীদের নজর তত নেই (যদিও ইদানীং হিন্দি নিয়ে রাষ্ট্রনেতাদের একটু বেশি উৎসাহ দেখা যাচ্ছে মনে হয়— তবু তাতে অন্যের মুখের ভাষা উৎখাত করে হিন্দি বসানো হবে আপাতদৃষ্টিতে এমন মনে হচ্ছে না), নজর আছে প্রশাসনিক আর শিক্ষার ভাষার উপর।

প্রাশাসনিক আর শিক্ষার ভাষা সব সময় এক হবে, এই উপনিবেশ-স্মৃতিচিহ্নিত দেশে তা হতে পারে না। ভারত সরকার ১৯৬২-তে শিক্ষার যে ত্রিভাষা-সূত্র সুপারিশ করেছেন, তা অনেক দিন ভূতদশা প্রাপ্ত হয়েছে। ইংরেজি আর প্রাদেশিক ভাষার পাশাপাশি দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে একটি উত্তর ভারতের ভাষা শেখানো হবে স্কুলে, আর উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলিতে একটি দক্ষিণ ভারতীয় ভাষা— এই উদার জাতীয় সংহতি-সূচক দৃষ্টিভঙ্গি উত্তর ভারতেই প্রথম বর্জিত হয়, যখন স্কুলগুলিতে নানা অসুবিধার অজুহাতে দক্ষিণ ভারতীয় ভাষার বদলে সংস্কৃতকে সিলেবাসে ঢোকানো শুরু হয়। দক্ষিণ ভারত বরং চেষ্টা করেছে তা কিছু দিন জিইয়ে রাখতে, কেন্দ্রীয় ভারতীয় ভাষা সংস্থান (মহীশূরের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গোয়েজেস)-এর আয়োজনে। তিরিশ বছর আগে আমি দেখে এসেছিলাম, তিরুঅনন্তপুরমে চার হাজার ছাত্রছাত্রীর ‘সেভেন হিলস স্কুল’-এ বাংলা ভাষা পড়ানো হচ্ছে। এখন তার কী দশা হয়েছে, জানি না।

তার পরে, আগেকার সরকারের আমলে প্রয়াত ভাদারাজু কৃষ্ণমূর্তির নেতৃত্বে, আর একটি জাতীয় ভাষানীতি প্রণয়নের চেষ্টা শুরু হয়েছিল। কিন্তু অন্যতম সদস্য হিসেবে মর্মে মর্মে জানি, তা বেশি দূর এগোতে পারেনি। এই কাজের নতুন দায়িত্ব যাদের দেওয়া যেত, সেই কেন্দ্রীয় ভারতীয় ভাষা সংস্থান বা সিআইআইএল দীর্ঘ দিন রাষ্ট্রীয় অবহেলা আর অধ্যক্ষহীনতার রোগে ভুগছে। ফলে আমাদের কোনও কেন্দ্রীয় ভাষানীতি— যা কিনা ভাষাগত সংখ্যালঘুদের ভাষার স্বার্থ দেখবে— তা এখন আছে কি না সন্দেহ। এই সমস্যাগুলিকে হয়তো কেন্দ্র এই বলে ছেড়ে রাখে— এগুলো রাজ্যের নিজস্ব সমস্যা, রাজ্যই তা সমাধান করুক। এবং দূর থেকে মজা দেখে। কখনও বা ঘোলা জলে মাছ ধরবার সুযোগ নেয়।

তা হলে যে সব রাজ্যে সংহত, অঞ্চলবদ্ধ, বৃহৎ (এটি এক বিতর্কিত বিশেষণ) ভাষাগত সংখ্যালঘু আছেন, তাঁদের সম্বন্ধে রাজ্যের ভাষানীতি কী হওয়া উচিত? মনে রাখতে হবে যে, এই সব ভাষার কোনও কোনওটি অন্য রাজ্যের প্রধান ও প্রশাসনিক ভাষা। তা না হলেও ক্ষতি নেই, কোনও ভাষা তা না-ও হতে পারে, যেমন সাঁওতালি। কিন্তু সাঁওতাল জনগোষ্ঠী কোনও কোনও অঞ্চলে যথেষ্ট সংহত ও একস্থানবদ্ধ হয়ে বাস করেন। ফলে আবেদনের ফলেই হোক, প্রতিবাদ আন্দোলন ও শহিদের আত্মদানের ফলেই হোক, বা রাষ্ট্রের সদাশয়তার ফলে হোক— এই নীতি গ্রহণ সংগত হয়েছিল যে, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশে দ্বিতীয় প্রশাসনিক ভাষা হবে নেপালি, অসমের বরাক উপত্যকায় বাংলা, বা উত্তরপ্রদেশে, বিহারে, অন্ধ্রে, ঝাড়খণ্ডে উর্দু। যদিও তা সব জায়গায় সমান কার্যকর হয়েছে কি না সন্দেহ। ঝাড়খণ্ডে যেমন বাংলা অন্যতম ‘সরকারি’ বা প্রশাসনিক ভাষা, কিন্তু কাজে বা শিক্ষায় তার কোনও উদ্যোগ সরকারের তরফে দেখা যায় না।

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে পাহাড়ে নেপালিদের উপর বাংলা ভাষা শিক্ষার দায় চাপানো থেকে পাহাড় অশান্ত হয়ে উঠেছে। বাঙালির ভাষাগত আবেগকে (যা ২১ ফ্রেব্রুয়ারি বা ১৯ মে-তে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে) ভিত্তি করে এই (ভোটব্যাকুল?) সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যে ভাবনাটার দরকার ছিল তা এই: সাঁওতালি বা নেপালি ভাষার মানুষেরা এখন ইংরেজি, সরকারি ভাষা হিন্দি, আর নেপালি/সাঁওতালি— এই তিনটি ভাষা স্কুলের প্রথম থেকেই শিখতে বাধ্য হন। শেষেরটা হয়তো প্রথম ভাষা হিসেবে, বা ইংরেজি মাধ্যমের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে। বাংলা যদি তাঁদের শিখতে হয়, তাঁরা তা ঠিক কখন শিখবেন? প্রাথমিক স্তরে আর একটা ভাষার দায় চাপানো উচিত হবে না, এটা শিক্ষণের যুক্তি। আর প্রশাসনিক যুক্তি হল, প্রাথমিক স্কুলগুলোতে অত বেশি শিক্ষকও সরকার হয়তো দিতে পারবে না। যদি বাংলা পড়া ‘ঐচ্ছিক’ হয়, তা হলে এমন হতেই পারে যে, একটিও ছাত্র হল না। সে ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার শিক্ষক (যদি অবিশ্বাস্য ভাবে সব জায়গায় শিক্ষক দেওয়া যায়) যদি নেপালি বা সাঁওতালি না জানেন, বসে বসে মাইনে গুনবেন। এ কথা বলছি এই কারণে যে, এখন রাজ্যে বহু প্রাথমিক স্কুল আছে, যাতে এক জন শিক্ষকের বেশি নেই। যদি এক জন শিক্ষক থাকেন, তাঁর ভাষা আর তাঁর ছাত্রদের ভাষা এক, এটাই তো কাম্য হবে।

ক্লাস সেভেন বা এইটে দু’বছরের জন্য অন্য ভাষা শেখানোর সুযোগ আছে। সেটা টেন পর্যন্ত টেনে দেওয়া যেতে পারে। সেটা কী হবে— সংস্কৃত, বাংলা, না অন্য কোনও ভাষা— তা ওই ওই সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির করা দরকার, নিজেরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে চাপিয়ে দেওয়া সংগত নয়। সব স্কুলে সব সুযোগ দেওয়াও যাবে না। মনে রাখতে হবে, স্কুলের ভাষা শিক্ষা মূলত ভাষাটা লিখতে ও পড়তে শেখা— তা মুখে মুখে শেখার ভাষা নয়। কাজেই চার পাশে শুনছেন বলেই ছাত্রছাত্রীরা স্কুলের একটা ভাষা (বর্ণমালা, বানান, জটিল বাক্যগঠন-সুদ্ধ) শিখে যাবেন— এই যুক্তি লেখার ভাষা শেখায় চালান করা যায় না। প্রয়োজন হলে অন্য একটা মুখের ভাষা অন্যভাষীরা নিজ উদ্যোগেই শিখে নেন। স্কুলের দরকার হয় না।

রাজ্যের অন্যত্রও, অন্যভাষীদের ক্ষেত্রে, সেই সব সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার পথটা খোলা রাখা উচিত। সংখ্যাগুরুর আবেগের সম্মান নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সংখ্যালঘুদের উপর তা একতরফা চাপিয়ে দেওয়া গণতান্ত্রিক উপায় নয়। অসমের দৃষ্টান্ত থেকে আমরা যেন সেটা ঠিকঠাক শিখতে পারি।

Language Language policy religion
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy