Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু

সে দিন একটি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রের স্টিলের টিফিন বাক্সের উপর একটি ছেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ায় তার কচি আঙুল প্রায় দু’ফাঁক হয়ে যায়। স্কুল কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে তার বাড়িতে খবর পাঠায়। বাড়ির লোক এসে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত প্রাথমিক চিকিৎসাও হয়নি!

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০

নিরাপত্তা কই স্কুলে

আমার আট বছরের ছেলে প্রতি দিন ৬-৭ কিলো ওজনের ব্যাগ নিয়ে তিন তলায় ওঠে! এটা স্বাস্থ্যের পক্ষে যতটা ক্ষতিকারক, ততটাই বিপজ্জনক। স্কুল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলাম, যদি ওদের এক তলায় ক্লাস করান, ভাল হয়। উনি অনুরোধ রাখেননি। নবম-দশম শ্রেণির ছেলেমেয়েদের চোখের সামনে রাখা নাকি বেশি জরুরি!

সে দিন একটি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রের স্টিলের টিফিন বাক্সের উপর একটি ছেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ায় তার কচি আঙুল প্রায় দু’ফাঁক হয়ে যায়। স্কুল কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে তার বাড়িতে খবর পাঠায়। বাড়ির লোক এসে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত প্রাথমিক চিকিৎসাও হয়নি! কেবল আঙুলে একটি রুমাল জড়িয়ে রাখা হয়! অনেক বেসরকারি স্কুল যে কোনও অজুহাতে টাকা নিতে যত আগ্রহী, ততটাই অনাগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের সুযোগসুবিধা ও নিরাপত্তার দিকে নজর দিতে।

পড়ুয়াদের অহেতুক মানসিক চাপ, অপমান ও শারীরিক নিগ্রহও করা হয়, এমনকী অপমানে অনেক কিশোরকিশোরী আত্মঘাতী হয়েছে, বেসরকারি স্কুলে এ ঘটনাও বিরল নয়। অনেক বড় স্কুলেও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না-পাওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সামান্য পারিশ্রমিকে নিয়োগ করা হয়। যাঁরা পড়ানোর ব্যাপারে যতটা অদক্ষ, ততটাই অদক্ষ ছেলেমেয়েদের সামলাতে। প্রদ্যুম্নের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বেসরকারি স্কুলের নিরাপত্তার বহর। মাত্র কিছু দিন পূর্বে আমার এক পরিচিতের মেয়ের স্কুলে, স্কুল চলাকালীন ষষ্ঠ শ্রেণির একটি মেয়ে চার তলা থেকে ঝাঁপ দেয়। নীচে এক জন শিক্ষক তাঁকে লুফে নেয়। মেয়েটির কিছু হয় না। কিন্তু শিক্ষক মাথায়, হাতে গুরুতর আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি। মেয়েটি নিজের ক্লাসের জানলা দিয়ে বেরিয়ে অপর একটি ক্লাসের চার তলা ছাদে পৌঁছয় ও ঝাঁপ দেয়। কারও চোখেই পড়েনি। পুলিশে খবর দিলে নিজেরাই প্রশ্নের মুখে পড়বে বলে মেয়েটিকে অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়া হয়। মেয়েটি নাকি ‘ব্লু হোয়েল’ গেমের শিকার!

কৌশিক সরকার

শিক্ষক, রঘুনাথপুর, পুরুলিয়া

শাস্তিযোগ্য নয়?

মনে আছে দেবযানী বা রমিতাকে? সাধারণ ঘরের সাধারণ মেয়ে দেবযানী, যাকে বাবার ঋণ শোধ করতে হয়েছিল নিজের জীবন দিয়ে। এক জন বাপের বয়সি লোভী মানুষকে বিয়ে করে দৈনন্দিন ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছিল। খুন করতে হয়েছিল লম্পট স্বামীকে, নিজের সন্তান সুপর্ণাকে বাঁচাতে। জীবনভর নিজে আড়ালে থেকে মেয়েকে মানুষ এবং যোগ্য করে তুলেছিল। হ্যাঁ, আমি ‘উত্তর ফাল্গুনী’ সিনেমার দেবযানী চরিত্রের কথা বলছি।

শিক্ষিত রমিতা উচ্চবিত্ত বাপের কন্যা। বিবাহসূত্রে মধ্যবিত্ত সংস্কারাবদ্ধ স্বামী ও সংসার পেয়েছিল। সুখী হতে ও সুখী করতে চেয়েছিল। কিন্তু একটি শ্লীলতাহানির ঘটনা তাঁর দাম্পত্যকে ভাঙনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রথাগত ভাবে রমিতার শাশুড়ি গুরুদেব ডেকে বাড়ি ও বউমাকে শুদ্ধ করেন। সমস্যা এখানে নয়, অন্যত্র। স্বামী সঙ্গে থাকলেও এক জন নির্ভীক মেয়ের প্রতিবাদে রমিতা শ্লীলতাহানি থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু ঘটনার পরোক্ষ অভিঘাতে রোজকার জীবনচর্যায় ধর্ষিত হতে থাকে স্বামী ও পরিজনের দ্বারা। হ্যাঁ, আমি সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘দহন’-এর রমিতার কথাই বলছি।

দেবযানী এবং রমিতার স্বামীর মতোই পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী কেন্দ্রীয় সরকার ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’কে শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয় বলেই স্বীকৃতি দিল। দিল্লি হাইকোর্টের একটি মামলায় কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে হলফনামা দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হল, ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় বিবাহ একটি পবিত্র সামাজিক বন্ধন। ধর্ষণের নামে তাকে কোনও মতেই কালিমালিপ্ত করা যাবে না।

এই বিধানের ফলে বহু প্রভাবশালী পুরুষ বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে স্ত্রীর উপর বৈধ ধর্ষণ চালাতেই থাকবে। কী ভয়ানক দিনের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা একুশ শতকের ভারতীয় মেয়েরা! আধুনিক বিশ্ব যেখানে মেয়েদের ‘ইচ্ছে অনিচ্ছে’কে স্বীকৃতি দিচ্ছে, আমরা সেখানে উল্টো অভিমুখে চলেছি। জনাকয়েক ভদ্র-শিক্ষিত পুরুষের বাইরে যে বিশাল জোর খাটানো ‘পুরুষসমাজ’ রয়েছে, তাদের ক্ষমতার আস্ফালন, জবরদস্তির অধিকার আরও বাড়তেই থাকবে।

দুটো জায়গা অবশ্য বরাদ্দ আছে ভারতীয় মেয়েদের জন্য— রান্নাঘর আর আঁতুড়ঘর। আর একমাত্র জপিত মন্ত্র হরিনাম সংকীর্তন। ভারতবর্ষের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে তুলসীমঞ্চ, বইখাতা জুটুক না জুটুক। যেমন জুটেছে ঝাঁটা আর শৌচালয়। সাচ্চা হিন্দুয়ানির ঠেলায় না হয় আমরা মানবতাবোধ বিসর্জন দিয়ে পরিণত হব বোধ-বুদ্ধি-মননহীন পুরুষ কিংবা মেয়েমানুষে।

শিক্ষিত মধ্যবিত্তের অন্দরেই যেখানে মেলে না ইচ্ছের স্বাধীনতা, সেখানে নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র নিরক্ষর পরিবারের চৌকাঠ ডিঙনোর স্পর্ধা কেমন ভাবে সম্ভব! দাম্পত্য জীবনে স্বামীর হাতে নির্যাতিত ও ধর্ষিত হওয়াই একমাত্র ভবিতব্য গরিব খেটেখাওয়া শ্রমজীবী মেয়েদের। তাদের কান্না কেউ শুনতেও পায় না, তারাও ক্রমে ক্রমে জীবনে টিকে থাকার লড়াইয়ে সব ভুলে যেতে থাকে। কিন্তু শিক্ষায় ও বিত্তে যারা কিছুটা উপরে রয়েছে, পেয়েছে মর্যাদাবোধের শিক্ষা, তারাও প্রাক‌্-বৈবাহিক জীবনের অর্জিত ভাবনাগুলোকে অলীক কল্পনাপ্রসূত বলেই মনে করতে থাকে দাম্পত্য জীবনে এসে। ক’জন পুরুষ স্বামী থেকে প্রেমিকে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে! বরং স্ত্রীর চেয়ে শিক্ষায়-চাকরিতে-যোগ্যতায় বা রূপে কমতি থাকলে অবাধ্য স্ত্রীকে জব্দ করার জন্য পুরুষের একচ্ছত্র শাসন সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছে তার শোওয়ার ঘর। এখন তার সেই বীরত্বে রাষ্ট্রীয় সিলমোহর পড়ে গেল।

এক বউদি তাঁর বহুগামী স্বামীর সঙ্গে সহবাসে ঘৃণা জানিয়েছিলেন বলে বেদম প্রহারে শয্যাশায়ী ছিলেন দীর্ঘ দিন; এক দিদি, অন্য নারীতে আসক্ত স্বামীকে মেনে নিলেও সহবাসে অনিচ্ছা জানানোয় পুত্র-সহ নির্যাতিত হয়েছেন বহু দিন; এক প্রতিবেশী পিরিয়ড-এর কারণে স্বামী-সংসর্গে অরাজি হওয়ায় চড় খেয়ে বেকায়দায় পড়ে মাথা ফাটিয়েছিলেন; এক বন্ধু তাঁর শিক্ষিত স্বামীর সঙ্গে ভালবাসাহীন সহবাসে বাধ্য হয়েছেন দিনের পর দিন; এমন অজস্র উদাহরণ মধ্যবিত্তের ঘরে-সংসারে।

এঁরা সকলেই আমাদের ঘরের মেয়ে। এই অসৎ স্বামীদের প্রতি শাসনের পথ খোলা রাখতেই পারত দেশের শাসক, অনিচ্ছাকৃত ধর্ষণের দায়ে কিছুটা হলেও ভীত-সংকুচিত থাকতে পারত তারা, অন্যের মতকে সম্মান জানানোর শিক্ষা অর্জন করতে চাইত। সে পথ বন্ধ করে দেওয়া হল। শিক্ষা-স্বনির্ভরতা-স্বাতন্ত্র্য-মর্যাদাবোধ-আত্মবিশ্বাস-ব্যক্তিসত্তা সব কিছু শোওয়ার ঘরের দরজার বাইরে ফেলে রেখে নারী তার জীবনযৌবন সার্থক করে তুলবে স্বামী-সংসর্গে।

এই অবমাননার হাত থেকে মুক্তির একমাত্র পথ— নিরন্তর নিরবচ্ছিন্ন লড়াই। এ লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা মেয়েদেরই নিতে হবে। নইলে বৈবাহিক ধর্ষণের বৈধতার মতো মেয়েদের চিন্তার স্বাধীনতা, ব্যক্তিপরিসর, শিক্ষার অধিকার, ভালবাসার অধিকার, স্বনির্ভরতা, আত্মমর্যাদাবোধ সবই একে একে অপগত হবে সরকারের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার করাল গ্রাসে।

নন্দিতা পাল

কৃষ্ণনগর সেন্ট্রাল, নদিয়া

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ই-মেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়

ভ্রম সংশোধন

‘গোর্খাল্যান্ড চাইছেন ভাইচুং, দল হতবাক’ (১৫-৯, পৃ ১) শীর্ষক খবরে
গৌতম দেবকে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী লেখা হয়েছে। তিনি পর্যটনমন্ত্রী।
অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।

Letters to the Editor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy