মল্লারিকা সিংহ রায়ের ‘কমরেড, বিচ্যুতি হচ্ছে’ (১৮-১০) শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়লাম। প্রবন্ধকার লিখেছেন, “সত্তরের বিপ্লবীদের বোধ হয় কিছুটা দুর্ভাগ্য যে, তাঁদের সময়ে হাস্যরসের আবেদনে সাড়া দেওয়ার মনন নিয়ে নেতৃত্ব ভাবিত ছিলেন না।” শুধু কি তা-ই? বিপ্লবী নেতা তথা বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তরও বেমালুম এড়িয়ে যেতেন। প্রবন্ধকার সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় মূর্তি ভাঙার রাজনীতি বিষয়ে বুদ্ধিজীবী সরোজ দত্তের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন। সুমন্তবাবুর বই নিশির ডাক: স্মৃতি নিয়ে ছেলেখেলা থেকে তারই দু’-চার লাইন উদ্ধৃত করা যাক— “দেখুন আপনার এই মূর্তিভাঙার ডাকের ফলে অনেক অনাচার ঘটেছে। আপনি কি মানবেন বিদ্যাসাগরের প্রতিমূর্তি চূর্ণ করা, রবীন্দ্রনাথকে গালিগালাজ করা, সমর সেনের ফ্রন্টিয়ার-এর বিরুদ্ধে দিনের পর দিন আপনার বিষোদ্গার— এ সব নকশাল আন্দোলনের অনেক ক্ষতি করেছে? অনেক সমর্থককে বিরোধী শিবিরে ঠেলে দিয়েছে? ইস্কুল-কলেজ লাইব্রেরি-ল্যাবরেটরি তছনছ করা কি উচিত ছিল?” এর পরেই লেখকের মন্তব্য: “সরোজদা হনহন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর থেকে বার হয়ে গেলেন।”
কমিউনিস্ট বিপ্লবী সাহিত্যেও ‘এক ধরনের উচ্চ-রোলের আইডিয়ালিজ়ম’ লক্ষ করা যেত। এই মন্তব্যটি করেছিলেন কমিউনিস্ট লেখক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিপ্লবীদের চরিত্রসমূহ আধা-রোম্যান্টিক, আধা-নস্টালজিক ভাবনা থেকে গড়ে তোলা হত। পার্টিনেতার বীর, বিপ্লবী ব্যক্তি-ইমেজ গড়ে তোলার ভাবনাটা পুরোদস্তুর ছিল। গল্পের প্রধান দু’টি চরিত্রের গড়ন কেমন ছিল? কমিউনিস্ট লেখক দীপেন্দ্রনাথের মতে, মনে হত “যেন দূর থেকে ওই সব নায়ক-নায়িকাকে সমাদর করছি। কাছে ঘেঁষতে, ভিতরে ঢুকতে ভয় পাই।”
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?’ কবিতা আওড়ানো থেকে শুরু করে সে দিন সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করার স্লোগান— এ সবই কমবেশি বামপন্থী বিপ্লবীর মননের বিচ্যুতি বলে মনে হয়।
শিবাশিস দত্ত, কলকাতা-৮৪
লাল কালি
কুট্টির কার্টুন সম্বলিত মল্লারিকা সিংহ রায়ের প্রবন্ধে বামপন্থী সাহিত্যে হাস্যরস আহ্বানের অনীহা চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে পন্থা নির্বিশেষে যে কোনও স্বৈরাচারী শাসকই কমেডি বা হাস্যরসকে বেশ ভয়ের চোখে দেখেন, কারণ প্রায়ই সমাজের অসঙ্গতিগুলো কমেডি প্রাঞ্জল ভাবে তুলে ধরে। দেশে দেশে এখন তাই বিখ্যাত কমেডিয়ানদের সেন্সর করা হয়, তাঁদের অনুষ্ঠান বাতিল হয়, অনেক সময় তাঁদের পালিয়েও বেড়াতে হয়।
দার্শনিক স্লাভয় জিজ়েক কৌতুককে সমাজ বিশ্লেষণের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে দেখেন। সাবেক কমিউনিস্ট আমলের পটভূমিতে জিজ়েকের সংগ্রহের একটি হাস্যরস এই রকম: এক যুবককে কাজ করতে সুদূর সাইবেরিয়ায় পাঠানো হচ্ছে। বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম চিঠি, কিন্তু প্রশাসনের লোকজন সব চিঠিই পড়ে দেখবেন। সেই যুবক ও তাঁর বন্ধুরা মাথা খাটিয়ে একটা উপায় বার করল। ঠিক হল, চিঠি যদি নীল কালিতে লেখা হয়, বুঝে নিতে হবে চিঠির সব কথা সত্যি, আর যদি লাল কালিতে লেখা হয়, বুঝতে হবে সব কথা মিথ্যে। মাসখানেক পর সাইবেরিয়া থেকে বন্ধুদের কাছে চিঠি এল নীল কালিতে: “এখানে কাজের পরিবেশ খুবই ভাল। বাসস্থান উন্নত মানের, ঠান্ডায় একেবারে কষ্ট হয় না। দোকান-বাজারে পর্যাপ্ত সামগ্রী, খাবারের কোনও অভাব নেই। সবই ভাল, তবে একটাই অসুবিধা— লাল রঙের কালি এখানে পাওয়া যায় না।”
হাস্যরস বাক্স্বাধীনতার সেই লাল রঙের কালি, আমরা কেমন আছি ঠিক ভাবে জানতে ও জানাতে যাকে ভীষণ ভাবে দরকার।
দেবপ্রিয় সেন, কলকাতা-৯৫
অন্ধকার প্রান্ত
ঈশা দাশগুপ্তর ‘মদনপুরার দিকে নয়’ (১৬-১০) প্রবন্ধটি সমগ্র দেশ জুড়ে চলা ধর্মীয় বিদ্বেষ ও বিভাজনের যেন ছোট্ট এক টুকরো কোলাজ। এটি কেবল নমুনামাত্র, যা ইঙ্গিত করে দেশ জুড়ে ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আজ আমাদের কোথায় নিয়ে চলেছে? গান্ধী, নেহরু বা আম্বেডকর কি এই ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন? ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে একটি দলের সরকারের অনুপ্রেরণা ও মদতে এই উচ্ছন্নে যাওয়ার রাজনীতি আর কত দিন এ ভাবে চলতে পারে? সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে অনেক মহাপুরুষ রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে টেনে আনার বিরোধী ছিলেন। প্রকৃত উন্নয়ন কখনও আসতে পারে না, যখন সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প এ ভাবে দেশকে ছেয়ে ফেলে। মদনপুরা বারাণসীর বাঙালি টোলার গা-ঘেঁষে থাকা একটি অঞ্চল, যাতে বসবাসকারী বেশির ভাগ বুনকর বা তাঁতি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক। ২০১৯ সালে ইউনিয়ন মিনিস্ট্রি অব টেক্সটাইলস-এর সমীক্ষা মতে, বারাণসী শহরে আছে এক লক্ষের বেশি বুনকর এবং আশি হাজারের বেশি তাঁত। কিন্তু দক্ষ এই বুনকরদের সংখ্যা দিন দিন কমছে। হ্যান্ডলুম উঠে গিয়ে পাওয়ারলুমের আধিপত্য একটি কারণ। যাঁরা এক সময় বস্ত্র উৎপাদনে এক গৌরবের অবস্থানে ছিলেন, আজ কেন তাঁদের এই হাল? মদনপুরা ছেড়ে বুনকরদের ছেলেমেয়ে চলে যায় অন্যত্র। মদনপুরায় ব্যবহৃত বিদ্যুৎ থেকে তুলে নেওয়া হয় ভর্তুকি। এক নিঃসীম অন্ধকারে মদনপুরার তলিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয় মাত্র।
দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
স্বচ্ছতা চাই
ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন-কে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্ক কেবল একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া নয়, এটি এক গভীর রাজনৈতিক প্রক্রিয়াও বটে। এসআইআর-এর উদ্দেশ্য ও নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত লক্ষ্য হল ভোটার তালিকা থেকে প্রয়াত, স্থানান্তরিত প্রভৃতি নামগুলি সরিয়ে একে নির্ভুল ও স্বচ্ছ করে তোলা। কমিশনের মতে, একটি নির্ভুল, স্বচ্ছ ভোটার তালিকা নির্বাচনের পূর্বশর্ত। কিন্তু এসআইআর-এর প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। তাদের মূল আশঙ্কা— প্রকৃত ভোটার বাদ পড়ার সম্ভাবনা, এবং রাজনৈতিক অভিসন্ধি। তাদের দাবি, এই প্রক্রিয়ার নামে প্রকৃত ও যোগ্য ভোটারদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে, বিশেষত অভিবাসী শ্রমিক, অস্থায়ী ঠিকানার বাসিন্দা বা ভাষাগত সংখ্যালঘুদের মতো প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষদের। প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে না পারলে তাঁরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবেন, যা সরাসরি গণতান্ত্রিক অধিকারের লঙ্ঘন। ক্ষমতাসীন দল তাদের অনুকূলে নির্বাচনী ফলাফল আনতে এই প্রক্রিয়াকে কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। বড় সংখ্যক মানুষ যদি নিজেদের ভোটাধিকার হারান, তবে তা জনঅস্থিরতা ও অবিশ্বাসের জন্ম দিতে পারে।
ভারতের নির্বাচন কমিশন বহু সংবেদনশীল দায়িত্ব সফল ভাবে পালন করেছে, যা একটি স্বাধীন দফতরের সক্ষমতার দৃষ্টান্ত। সুতরাং, এই ক্ষেত্রেও তাদের একটি ভারসাম্যপূর্ণ পথের সন্ধান করতে হবে। প্রত্যেকটি নাম বাদ বা যুক্ত করার পক্ষে যুক্তি প্রকাশ করতে হবে, আপত্তি নিষ্পত্তির সহজ ব্যবস্থা রাখতে হবে, এবং ভোটার নিবন্ধনে আধার, ভোটার আইডি, রেশন কার্ডের মতো নথিকে বৈধ প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। যাঁদের কাছে নথি নেই, তাঁদের জন্য বিকল্প প্রমাণ পেশ করার সুযোগ দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন, সরকার, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের মধ্যে সহযোগিতা অপরিহার্য— যাতে ভোটার তালিকা পরিমার্জনের নামে কোনও ধরনের পক্ষপাত না হয়। কারণ, গণতন্ত্র টিকে থাকে বিশ্বাস, স্বচ্ছতা ও নাগরিক অধিকারের মর্যাদার উপর।
অলোক কুমার মুখোপাধ্যায়, সোদপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)