Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: গড্ডলিকা প্রবাহ

গভীর উদ্বেগের বিষয় হল, নতুন সঙ্কল্প, সম্ভাবনার মধ্যে দিয়ে জন্ম নেওয়া একটি রাজনৈতিক দলের অন্যান্য দলের মতো বিলাস স্রোতে ভেসে যাওয়া, লালসার পাঁকে আটকে যাওয়া।

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২৫ ০৬:২০
Share
Save

‘নিজকীর্তির পরিণাম’ (১১-২) সম্পাদকীয়টি রাজধানীতে আম আদমি পার্টির নির্বাচনে অপরিণামদর্শিতার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। এই পরাজয়ে এক অ-পূর্ব প্রতিষ্ঠা, আশ্চর্য বিস্তার ম্লান হয়ে গেল। টানা দু’বার রাজ্য প্রশাসনে থেকে ভোটে আপ দলের প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার সামনে পড়া ও পরাজয় আশ্চর্যের কিছু নয়। গভীর উদ্বেগের বিষয় হল, নতুন সঙ্কল্প, সম্ভাবনার মধ্যে দিয়ে জন্ম নেওয়া একটি রাজনৈতিক দলের অন্যান্য দলের মতো বিলাস স্রোতে ভেসে যাওয়া, লালসার পাঁকে আটকে যাওয়া। যা দেখেশুনে আরও এক বার দেশে অন্য কিছু দেখতে চাওয়ার আশা ভঙ্গ হয়। হয়তো এটাই সত্যি— যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ।

আপ দলটির উদ্ভব ও সেখানে অংশগ্রহণকারীদের প্রাথমিক ভাব, ভঙ্গিমা ছিল অপ্রথাগত। এ দেশে সাধারণত জাত, ধর্ম, কৌম, আঞ্চলিক স্বার্থ থেকে বা দল ভাঙার মধ্যে দিয়ে নতুন রাজনৈতিক দলের সূত্রপাত ঘটে। এবং সেখানে রাজনীতিতে সচরাচর সমাজ পরিবর্তন অপেক্ষা ব্যক্তিস্বার্থ, পারিবারিক শ্রীবৃদ্ধি প্রাধান্য পায়। বামপন্থীরা অবশ্যই এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এই পথের বিরোধিতা করে আপের নতুন পথ, মতের প্রাধান্য ঠিক হয়েছিল— ‘আম’ স্বার্থ। যাঁরা এমন বললেন, দল গড়লেন, তাঁরা নিজেরাও অনেকেই ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা ছেড়ে এলেন। বারো বছরের মধ্যে দু’টি রাজ্যের প্রশাসনে এবং অন্য কিছু রাজ্যে দলের সম্ভাবনা বিস্তার করলেন।

কিন্তু ন্যায়, নীতি, সাধারণ জীবনচর্যার, স্বার্থরক্ষার পূর্ব প্রতিশ্রুত ‘আম’ পথটি বিস্মৃত হল। দলীয় বিস্তার প্রাধান্য পেল। প্রচারের জন্য ঘুরপথে অর্থ সংগ্রহ হল। নানা প্রকল্পে জনমন জয়ে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি হয়ে উঠল মূল কাজ।‌ রামায়ণ পাঠ, হনুমান চালিসা, তীর্থ যাত্রা, ভজন, কীর্তনে নম্র মনোহরা হিন্দুত্ব বাছা হল উগ্র হিন্দুত্বের বিপরীতে।‌ সংখ্যালঘু বিপন্নতায় থাকল নীরবতা অবলম্বন।‌ আর পাঁচটি দলের সঙ্গে পার্থক্য ঘুচিয়ে দিতে আপ নিজেই তৎপর হয়ে উঠল।

মেট্রো রেলে সওয়ার হয়ে যে মুখ্যমন্ত্রী প্রথম শপথ নেন; সমর্থকের দেওয়া সাধারণ গাড়ি ছিল যাঁর বাহন; সেই তিনিই কোটি কোটি টাকা খরচ করালেন নিজের বাসভবনের সংস্কারে। এ দেশে প্রথাগত, পরিবারগত রাজনৈতিক ধারার বাইরে থেকে অরাজনৈতিক বিকল্প রাজনীতি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা বিশ্রী রকম অনৈতিকতায় তলিয়ে গেল। আপনি কর্মদোষে মজিলা ‘আপ’।

মানস দেব, কলকাতা-৩৬

ধরাশায়ী

এ বছর ফেব্রুয়ারির গোড়ায় সারা দেশের নজর ছিল রাজধানী দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের উপর। নির্বাচনে তিন প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল আপ, বিজেপি এবং কংগ্রেস। ৭০টি আসনে নির্বাচনী ফল— বিজেপি ৪৮, আপ ২২ এবং কংগ্রেস শূন্য। ২৭ বছর পর বিজেপির দিল্লি জয় নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। গান্ধীবাদী নেতা অণ্ণা হজারের ভাবশিষ্য কেজরীওয়াল দিল্লির বিধানসভায় ১০ বছরের বেশি সময় আসীন ছিলেন। দুর্নীতিবিরোধী স্লোগান ও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহণ, বিদ্যুৎ-সহ নানা ক্ষেত্রে সুবিধা দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল তাঁর দল। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে আবগারি শুল্ক নিয়ে নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে কেজরীওয়াল-সহ কয়েক জন মন্ত্রীর কারাবাস মানুষের বিশ্বাসে ফাটল ধরায়। তাঁর আবাসস্থলের সংস্কারে যে আড়ম্বর ফুটে ওটে, তা-ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিল না। তাঁর ঔদ্ধত্য কংগ্রেসকে উপেক্ষা করতে সাহস জোগায়, পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শামিল করে।

এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে কর মকুব, নগদে মহিলাদের অনুদান, বিদ্যুৎ, পরিবহণে সুবিধা, দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন এবং দূষণমুক্ত যমুনার জলের প্রতিশ্রুতিতে বিজেপির রাজধানী দখল সম্ভব হয়েছে। যদিও দিল্লির সাতটি লোকসভার আসন বিজেপির দখলে ছিল। এ বারের বিধানসভা নির্বাচনের ফলের চেহারা— বিজেপি ৪৫.৫৬ শতাংশ, আপ ৪৩.৫৭ শতাংশ এবং কংগ্রেস ৬.৩৪ শতাংশ। প্রার্থীদের স্বচ্ছতা, প্রতিশ্রুতি পূরণে সঠিক উদ্যোগ এবং প্রয়োজনে কৌশলগত জোটবাঁধা নির্বাচনী সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি। জোট হলে জয়ের ধারা যে অব্যাহত থাকত, তা ভোট প্রাপ্তির হিসেবে প্রমাণিত। বলা বাহুল্য, এই জয় বিজেপির আত্মবিশ্বাস যেমন বাড়িয়ে তুলবে, তেমনই বিরোধীদের শিক্ষা দেবে আগামী দিনে কী ভাবে এগোতে হবে।

সারনাথ হাজরা, হাওড়া

অন্তর্দ্বন্দ্ব

সম্পাদকীয় ‘নিজকীর্তির পরিণাম’ প্রসঙ্গে দু’-চার কথা। গণতন্ত্রে কোনও দলের নির্বাচনে হেরে ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়া অস্বাভাবিক নয়। সে কারণেই দেশে বিকল্প রাজনীতি এবং স্বচ্ছ প্রশাসন প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা আম আদমি পার্টির সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয় অপ্রত্যাশিত নয়। নিশ্চিত ভাবেই, বিজেপির বৃহৎ ও সমৃদ্ধ সংগঠন এবং কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও, কোনও দলের পক্ষেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সহজ ছিল না। অণ্ণার দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন থেকে আবির্ভূত ‘আপ’-এর নেতা অরবিন্দ কেজরীওয়াল দলের পোস্টার বয় হিসেবে আবির্ভূত হন। কিন্তু যখন তিনি এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়, তখন তাঁরা জনসাধারণের আদালতে নিজেদের পরিষ্কার প্রমাণ করতে পারেননি। নিঃসন্দেহে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আম আদমি পার্টি গঠনমূলক উদ্যোগ করেছিল, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এবং তার প্রতিনিধি এলজি-র সঙ্গে ক্রমাগত দ্বন্দ্বের কারণে দিল্লির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু বিজেপি দিল্লির নির্বাচন এত বড় পরিসরে লড়েছিল এবং এটিকে মর্যাদার প্রশ্ন করে তোলে, এই ফলাফল আসাই স্বাভাবিক ছিল।

৪৩ শতাংশ ভোট এবং ২২ জন বিধায়ক নিয়ে আপ অবশ্যই একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকবে। তবে, এই ফলাফলের পর দলটি নিজেকে সবচেয়ে কঠিন পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। অণ্ণা হজারের আন্দোলন থেকে উদ্ভূত এই দলের শক্তি ছিল বিকল্প রাজনীতির স্বপ্নকে ডানা মেলতে দেওয়া। এর সর্বোচ্চ নেতা অরবিন্দ কেজরীওয়াল সততা এবং সারল্যের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে, কেবল কেজরীওয়ালের বিশ্বাসযোগ্যতাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বিকল্প রাজনীতির দলের দাবিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। কেজরীওয়াল সব সময় দলের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। এখন কেবল দিল্লির ক্ষমতাই তাঁর হাত থেকে চলে যায়নি, তিনি নিজেও নির্বাচনে হেরে গেছেন। তাঁর বিরুদ্ধেও অনেক মামলা বিচারাধীন। এমন পরিস্থিতিতে দল ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দলটি এই আশঙ্কার মোকাবিলা কী ভাবে করে, তা দেখার বিষয়।

এই নির্বাচনে কংগ্রেসের খাতা না খোলা দলের জন্য হতাশাজনক। একই সঙ্গে তা ইন্ডিয়া জোটের জন্যও খুবই হতাশাজনক কারণ এর দুই দল— আপ এবং কংগ্রেস দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে কঠিন প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। প্রসঙ্গত, এত দিন ধরে বিরোধীদের পরাজিত করে এসেছে আপের বিনামূল্যের অস্ত্র। এ বার বিজেপি সেই একই হাতিয়ার সফল ভাবে ব্যবহার করল আপের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে বিজেপির মহিলাদের নগদ অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি ‘গেম চেঞ্জার’-এর ভূমিকা পালন করেছিল। একই সঙ্গে, বিজেপির শক্তিশালী সংগঠন এবং নির্বাচনী যন্ত্রপাতি পট পরিবর্তনে নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে। এই কারণেই দিল্লিতে পদ্ম ফুটেছে।

অভিজিৎ রায়, জামশেদপুর

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

AAP Political Party

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}