Advertisement
০৬ মে ২০২৪
WB Panchayat Election 2023

সম্পাদপ সমীপেষু: শান্তির আশা

পঞ্চায়েতে যে দলই জয়লাভ করুক, তাঁদের অবস্থার কোনও হেরফের হবে না, কিন্তু দলের জন্য বলি দিলেন নিজের জীবন। ভারতে সাধারণ মানুষের এটাই ভাগ্যের পরিহাস।

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৩ ০৪:৫৫
Share: Save:

শেষ হয়েছে আমাদের রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটের লজ্জার মনোনয়ন জমা। কাল ভোট। ভারতের অন্য যে কোনও প্রদেশে ভোট আসে, ভোট যায়, সরকার বদলায় কিংবা একই থাকে। কিন্তু গোটাটাই হয় নির্বিঘ্নে। হত্যা তো দূরের কথা, ব্যাপক বোমাবাজি, লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহার, কিছুই করতে হয় না। অথচ, এ রাজ্যে শুধু মনোনয়নেই ৮-৯ জন মানুষের প্রাণ চলে গেল (ভাঙড়-চোপড়ায় সংঘর্ষ, হত ৩, ১৬-৬)। ভাঙড়, ক্যানিং, কুলতলি, দেগঙ্গা, বসিরহাট, মুর্শিদাবাদের রানিনগর, ডোমকল, উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া, বীরভূমের নানুর, সাঁইথিয়া ইত্যাদি প্রায় সারা রাজ্য জুড়ে চলেছে হিংসার ঘটনা।

যাঁরা মারা গেলেন, তাঁরা সবাই কিন্তু আর্থিক দিক দিয়ে নিম্ন সারিতে থাকা মানুষ। পঞ্চায়েতে যে দলই জয়লাভ করুক, তাঁদের অবস্থার কোনও হেরফের হবে না, কিন্তু দলের জন্য বলি দিলেন নিজের জীবন। ভারতে সাধারণ মানুষের এটাই ভাগ্যের পরিহাস। তাঁদের আবেগপ্রবণতার সুযোগ নিচ্ছে সুযোগসন্ধানী, নীতিহীন রাজনৈতিক দলগুলো। সাধারণ কর্মীদের খেপিয়ে দিয়ে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেওয়ার জন্য এদের জবাবদিহি করা উচিত।

এতগুলো মৃত্যুর দায়ভার রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনও এড়াতে পারে না। টিভিতে যা দেখা গেল তা চরম অরাজকতা ছাড়া আর কিছু নয়। যথেচ্ছ বোমাবৃষ্টি, গাড়ি ভাঙচুর, ইটবৃষ্টি, পথ অবরোধ, গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, এমনকি পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর— কিছুই বাদ যায়নি। হয় প্রশাসনের অপদার্থতা অথবা ইচ্ছাকৃত ভাবে হাত গুটিয়ে রেখে প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা করেনি। যার ফলে আদালতকে হস্তক্ষেপ করে প্রথমে স্পর্শকাতর জেলাগুলোতে, তার পরে রাজ্যের সমস্ত জেলাতেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিতে হল। বলা যায়, প্রশাসনকে শক্ত-হাতে কাজ করতে না দিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য প্রশাসন কেন্দ্রীয় বাহিনীকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এল। আমরা রাজ্যের সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষ কোনও কাজিয়ার মধ্যে না গিয়ে শুধু দেখতে চাই একটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, যেখানে সমস্ত ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন।

সুরজিত কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি

বঞ্চনার রাজনীতি

কেন্দ্রের বঞ্চনার কথা শত মুখে প্রচার করে রাজ্য সরকার, অথচ পানীয় জল, নিকাশি বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে কেন্দ্রের বরাদ্দ টাকা ব্যবহার করতে রাজ্য বার বার ব্যর্থ হচ্ছে— এই বক্তব্য ‘স্বাস্থ্যের জট’ সম্পাদকীয়তে (১২-৬) রেখে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, অভাব কি আসলে জমির, না কি উদ্যোগের? অভাব জমির বা উদ্যোগের নয়, অভাব সদিচ্ছার, যার মূলে রয়েছে রাজনীতি। যে রাজনীতি পাশে থাকার বার্তা দিয়ে জনগণকে শাসক দলের প্রতি অনুগত করতে চায়। কেন্দ্রের এমন অনেক প্রকল্প আছে, যা রূপায়ণ করার জন্য বিশেষ কোনও উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল না। তবুও সেগুলি শুরু হয়নি, বা কার্যকর করতে অনেক গড়িমসি করা হয়েছে। কারণ, কেন্দ্রের প্রকল্প কেন্দ্রের নামে চালু করলে যদি রাজ্যের বিরোধী দলের প্রতি ভোটাররা অনুগত হয়ে পড়েন?

এই বিষয়ে প্রথমেই আসে, ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পের কথা। এই প্রকল্প চালু করলে রাজ্যের প্রায় ১ কোটি ১২ লক্ষ দরিদ্র মানুষ চিকিৎসার জন্য রাজ্যের এবং রাজ্যের বাইরে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আর্থিক সুবিধা পেতেন। যেখানে প্রকল্পে রাজ্যকে ৪০% আর্থ বরাদ্দ করতে হচ্ছে, সেখানে কার্ডে কেন শুধু ‘আয়ুষ্মান ভারত’-এর লোগো থাকবে, এই প্রশ্ন তুলে পশ্চিমবঙ্গ-সহ আরও দু’-তিনটি রাজ্য এই প্রকল্প চালু করেনি। সম্প্রতি কেন্দ্রের তরফে ‘আয়ুষ্মান ভারত’-এর লোগোর পাশাপাশি রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রকল্পের লোগোও রাখার অনুমতি দেওয়ায় রাজ্যের ‘স্বাস্থ্যসাথী’র ৪০ লক্ষ যোগ করেছে। তাতে প্রায় দেড় কোটি দরিদ্র মানুষ এই প্রকল্পের সুবিধাভোগী হয়েছেন। এতে রাজ্যের শাসক দলের রাজনৈতিক জয় হলেও, রাজ্যের জনগণের কোনও লাভ হয়নি, বরং কয়েক বছর প্রকল্পের সুবিধা থেকে তাঁরা বঞ্চিত হলেন। তা ছাড়া রাজ্যকেও এই দেড় কোটি মানুষের জন্য ‘স্বাস্থ্যসাথী’র সম্পূর্ণ খরচ বহন করতে হল, যেখানে রাজ্যের আর্থিক অবস্থা খারাপ। রাজ্যের উন্নয়নে, কর্মী নিয়োগে অর্থ ব্যয়ে রাশ টানতে হয়।

গ্রামের এমন বহু স্কুল আছে যেখানে বিগত পাঁচ বছরের বেশি সময় এক বা একাধিক বিষয়ের শিক্ষকই নেই, শিক্ষকের অভাবে কয়েকটি স্কুলে বিজ্ঞান, বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি বন্ধ রাখতে হচ্ছে, বা পড়ুয়ারা সেখানে ভর্তি হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে এই রাজনীতি রাজ্যের জন্য কতটা শুভ? একই কারণে, কেন্দ্রের নতুন স্বাস্থ্যনীতি অনুসারে ১৫,০০০ নাগরিক পিছু একটি ‘সু-স্বাস্থ্য কেন্দ্র’ তৈরির বরাদ্দ অর্থ খরচে সদিচ্ছার অভাব দেখা যাচ্ছে। অথচ, কলকাতার এক-একটি ওয়র্ডে জনসংখ্যার তুলনায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা নগণ্য, তার পরিষেবার মানও ভরসাযোগ্য নয়। একই কারণে ২০১৯ সালে চালু হওয়া কেন্দ্রের ‘কিসান সম্মান নিধি’ প্রকল্পও রাজ্য গ্রহণ করেনি। ২০২১-এর নির্বাচনের পর রাজ্য এই প্রকল্প গ্রহণে অনুমতি দিয়েছে। ফলে, প্রায় ৪০ লক্ষ কৃষক বর্তমানে কেন্দ্রের প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছে। এই বিলম্বের কারণও সেই রাজনীতি।

রাজ্যের শাসক দলের এই রাজনীতির অনেক সমর্থক থাকতে পারেন। কিন্তু এই রাজনীতি রাজ্যের জনগণের কোন উপকারে আসছে?

অসিতকুমার রায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি

ক্ষত মোছে না

সমস্ত পৃথিবী মাতৃভাষায় শিক্ষাদানকে সুনিশ্চিত করতে যখন সরব, তখন কলকাতার লরেটো কলেজ, অ্যাডমিশনের শর্তে বাংলা ও হিন্দি মাধ্যমকে ব্রাত্য করে শুধুমাত্র ইংরেজি মাধ্যমদের নিতে চাইছে! নেটপাড়া সরব আত্মগ্লানিতে। বলছে “এ তোমার পাপ! এ আমার পাপ!” চাপাচাপিতে বাধ্য হয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার করা হয়েছে। সারকথাটি হল, কলেজ কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন। স্পষ্ট করেছেন নিজেদের এলিট অবস্থানকে। এই প্রবণতা মারাত্মক।

এই প্রবণতা কি ছিল না? ছিল বটে। সমস্ত বৃত্তে। চাকরি থেকে ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনে। স্কুলগুলি এখন বাচ্চার মা-বাবাকে বাড়িতেও ‘বাংলা বলা চলবে না’ ফতোয়া দেয়! বাংলা মাধ্যমকে এ ভাবে নস্যাৎ না করলেও কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে ইংরেজি মাধ্যমকে গুরুত্ব দেওয়ার একাধিক উদাহরণ আগেও এসেছে। ক্লাস লেকচার শুধুমাত্র ইংরেজিতে হয় বা লাইব্রেরিতে ইংরেজি ছাড়া বই নেই— এটা কোনও যুক্তি হতে পারে না। এই বিজ্ঞপ্তি কোথাও যেন আমাদের জাত্যভিমানকে আঘাত করে। আমার দেশ বললে, সবার আগে যে নামগুলো আসবে— রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখ বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করেছেন। নামী কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিক্যাল কলেজগুলিতে গ্রাম থেকে আসা দরিদ্র বাংলা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রী মেধার ভিত্তিতে সুযোগ পায়। মেধাকে কখনও মাধ্যম দিয়ে ‘রিপ্লেস’ করা যায় না। হতেই পারে, কেউ ইংরেজি জানে না, কিন্তু ভূগোল জানতে চায়। তাকে উচ্চশিক্ষার অধিকার থেকে আমরা বঞ্চিত করতে পারি না।

এই প্রবণতা অবশ্য রাতারাতি তৈরি হয়নি। আমরা যে জমানায় বড় হয়েছি, তার আগের বা পরের প্রজন্ম বিদ্যালয় স্তরে ইংরেজি শিখতে পারেনি। আর এ জমানায় একের পর এক বাংলা মাধ্যম স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। সরকারি শিক্ষার হাল যত খারাপ হবে, প্রাইভেটের মুনাফা তত বাড়বে। আজকাল পকেটে লক্ষাধিক টাকা নিয়ে যেতে হয় বাচ্চার নার্সারি অ্যাডমিশনের জন্য! একে তো গবেষণার অর্থ নেই, তার মধ্যে ব্যবসায়িক এবং স্টেটাস-এর খাতিরে মনের ভাব প্রকাশক মাতৃভাষার প্রতি তাচ্ছিল্য! আর নেওয়া যাচ্ছে না। প্রত্যাহার করে নিলেই কি ক্ষত মোছা যায়?

পায়েল বসু, কলকাতা-৮৪

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE