‘সরকারি তালিকায় স্কুলের গ্রন্থাগারে মুখ্যমন্ত্রীর বই, বিতর্ক’ (২৪-৬) শীর্ষক সংবাদে প্রকাশ, রাজ্যের বিদ্যালয়গুলিতে মুখ্যমন্ত্রীর লেখা ১৯টি বই বাধ্যতামূলক ভাবে লাইব্রেরিতে রাখার নির্দেশ সম্প্রতি এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হিসাবে উঠে এসেছে। সরকারের এই নির্দেশ শুধুমাত্র শিক্ষাব্যবস্থার উপর একটি অযৌক্তিক চাপই নয়, বরং এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং শিক্ষার নিরপেক্ষতার উপর সরাসরি আঘাত। সরকারের এই পদক্ষেপ শিক্ষার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের একটি কৌশল হিসাবে দেখা যাচ্ছে। এর মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শে প্রভাবিত করার চেষ্টা স্পষ্ট। শিক্ষার নিরপেক্ষতা যেখানে শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত্তি, সেখানে এই ধরনের সিদ্ধান্ত সেই ভিত্তিকে দুর্বল করে।
এই সিদ্ধান্তে আর্থিক দিক থেকেও এক বিশাল অপচয় ধরা পড়ে। সরকারি তহবিল থেকে এই বই কেনার নির্দেশ জনগণের করের টাকার অপব্যবহার। যেখানে বিদ্যালয়গুলিতে পাঠ্যপুস্তকের অভাব বা পরিকাঠামোগত সমস্যার সমাধান করার কথা, সেখানে এই ধরনের আত্মপ্রচারের উদ্যোগ আর্থিক অপচয়ের পাশাপাশি শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়নের পথে বাধা। স্কুল লাইব্রেরির মূল লক্ষ্য, ছাত্রছাত্রীদের সামনে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে তারা বিভিন্ন মতাদর্শ, ইতিহাস, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই পড়ে নিজেদের চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করতে পারে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর বই বাধ্যতামূলক ভাবে রাখার সিদ্ধান্ত সেই পরিবেশকে সীমিত করে তুলবে। শিক্ষাবিদরা বার বার বলেছেন যে, শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনও একতরফা প্রচার ছাত্রছাত্রীদের স্বাধীন চিন্তাধারার উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষককুলের এক বৃহৎ অংশ। তাঁদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে এই ধরনের নির্দেশ শুধু ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না, বরং রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাও নষ্ট করবে। জনগণের করের টাকা শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়নে ব্যয় হওয়া উচিত, কোনও ব্যক্তি বা দলের প্রচারের জন্য নয়।
পিনাকী মুখোপাধ্যায়, কোন্নগর, হুগলি
বাংলার হেনস্থা
বাংলায় কথা বললেই ‘বাংলাদেশি’? বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষীদের সম্পর্কে এমনই সমীকরণ দাঁড় করিয়েছে বিজেপি। আর তারই ভিত্তিতে বিজেপিশাসিত গুজরাত, রাজস্থান, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, অসম ইত্যাদি রাজ্যে শয়ে শয়ে বাংলাভাষী এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গরিব মানুষকে কেবলমাত্র সন্দেহের বশে বাংলাদেশি তকমা দিয়ে হয় ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক করা হচ্ছে, নয়তো কাঁটাতার পার করে বাংলাদেশে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
অথচ, শুধু পশ্চিমবঙ্গের মানুষই নন, ত্রিপুরা, অসম, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি রাজ্যের একটা বড় অংশের মানুষ বাংলায় কথা বলেন। পশ্চিমবঙ্গ ভারতেরই একটি অঙ্গরাজ্য। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে চাকরি, ব্যবসা প্রভৃতি নানা কারণে যাতায়াত এবং বসবাসের অধিকার প্রত্যেক ভারতবাসীর রয়েছে। তাই বাংলায় কথা বললেই কাউকে বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় না। দাগিয়ে দিলে তা প্রমাণের কোনও প্রয়োজন নেই? কাউকে বাংলাদেশি সন্দেহ হলে তিনি ‘প্রকৃতই বাংলাদেশি’ কি না, তার বিচার তো আইনি পথেই করতে হবে। পুলিশ বা বিজেপি-আরএসএস’এর ‘গেস্টাপো বাহিনী’ তা করতে পারে কি? অথচ, তাদের ভাবখানা এমন, যেন সমস্ত পশ্চিমবঙ্গবাসীর সব পরিচয়পত্রই জাল। বাংলায় কথা বললেই গভীর রাতে হানা দিয়ে গ্রেফতার করে, টাকা, নথিপত্র, মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে কোনও বিচার ছাড়া বলপূর্বক সীমানা পার করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া কি ইচ্ছামতো আইন হাতে তুলে নেওয়া নয়? সংবিধানের নামে শপথ নিয়ে এই বেআইনি কাজটিই কি চলছে না?
বিজেপি তোতাপাখির মতো অনুপ্রবেশের তত্ত্ব আওড়ে চলেছে। বলছে, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীতে নাকি দেশ ছেয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হল, তা হলে কেন্দ্রীয় সরকার সীমান্তের একটা বিরাট অংশ খোলা রেখে দিয়েছে কেন? দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রের অধীন বিএসএফ-এর নজরদারি এড়িয়ে তা ঘটতে পারছে কী করে? কেন সরকার বিএসএফ-এর কাছে এর জবাবদিহি চাইছে না? কম-বেশি অনুপ্রবেশ গোটা বিশ্বের সমস্যা। যুদ্ধ, বন্যা, ভাঙন, উচ্ছেদ, বেকারত্ব ইত্যাদি নানা কারণে অপেক্ষাকৃত উন্নত অর্থনীতির দেশে অনুপ্রবেশ দীর্ঘ দিন ধরেই চলছে। গুজরাত থেকেও বহু সংখ্যক মানুষ যে আমেরিকাতে বেআইনি অনুপ্রবেশ করেছিলেন, সম্প্রতি আমেরিকা তাঁদের অমানবিক ভাবে ফেরত পাঠানোয় আজ কারও তা অজানা নয়।
বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষীদের উপর হেনস্থার ঘটনা অনেক দিন ধরেই ঘটছে। রাজ্যের তৃণমূল সরকারের অনেক আগেই তৎপর হওয়া প্রয়োজন ছিল। এখন যখন সমস্যা বেশ গুরুতর আকার নিয়েছে এবং বিধানসভা নির্বাচনও কাছাকাছি, তখন হঠাৎই তাদের তৎপরতা চোখে পড়ছে। রাজ্য সরকারের এত দিন নীরব থাকা এবং হঠাৎ তৎপর হওয়ার পিছনেও কি কাজ করছে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের হিসাব-নিকাশ? ভোট রাজনীতির ময়দানে যুযুধান দুই পক্ষের মাঝখানে পড়ে দিশাহারা রাজ্যের হাজার হাজার গরিব মানুষ, দিন গুজরান করতে প্রতিনিয়ত কাজ খুঁজতে পরিবার-পরিজন ছেড়ে ভিন রাজ্যে যেতেই হয় যাঁদের, তাঁরা কী ভয়ঙ্কর আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, তা কি অনুভব করতে পারেন ভোটের হিসাব কষা রাজ্যের এই নেতা-মন্ত্রীরা? এঁরা কি কোনও ভাবে মানুষের প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য?
শিলাই মণ্ডল, পশ্চিম মেদিনীপুর
শেষ অধ্যায়
প্রচেত গুপ্তের ‘এ বড় সুখের সময় নয়’ (রবিবাসরীয়, ১৫-৬) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। সত্যি কেউ জানে না, জীবনের শেষ অধ্যায়ে কার জন্য কী লেখা আছে। এ প্রজন্মের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতার কারণে আজ একান্নবর্তী পরিবারের বড় বাড়িগুলি ফাঁকা পড়ে থাকে। বছরের পর বছর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলি নোংরা ও আবর্জনায় ভর্তি। কারণটা ওই খণ্ড খণ্ড আত্মকেন্দ্রিক পরিবার গড়ে তোলার প্রবণতা। এমনটাই নাকি এখনকার দুনিয়া।
প্রায় বছর ১৫ আগে কর্মসূত্রে কলকাতার গড়িয়াহাট অঞ্চলে একটি বাড়িতে বিভাগীয় দফতরের কাজে যেতে হয়েছিল। পেল্লাই দোতলা বাড়ি। নীচতলে কেউ থাকেন না। দ্বিতীয় তলে একটি ঘরে বাড়ির মালিক ও তাঁর স্ত্রী থাকেন। ঘরের ভিতরে গিয়ে দেখলাম, অশীতিপর নির্বাক দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দু’টি পালঙ্কে শুয়ে আছেন। শুনলাম তাঁদের পুত্র-কন্যারা বিদেশে থাকেন। প্রথম প্রথম তাঁরা বছরে এক বার আসতেন, কিন্তু শেষ পাঁচ বছর আর কেউ আসেন না। তাঁদের দায়িত্ব বলতে নিয়মিত টাকাপয়সা পাঠানো। প্রায় চার দশক ধরে ওই বাড়িতে কর্মে নিযুক্ত দু’জন বিশ্বস্ত মানুষ ওই দু’জন মরণাপন্ন প্রবীণ মানুষের কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন।
আসলে বার্ধক্যের কবলে মানুষ যখন অক্ষম ও অসহায়, তখন প্রবন্ধকারের কথাটাই সঠিক যে, সময়টা সত্যি বড় অপমানের, আত্মমর্যাদা খোয়ানোর আর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকার। যে মানুষটির নির্দেশ বা পরামর্শে অফিসের সব কাজ সময়মতো নির্বিঘ্নে উতরে যেত, সেই মানুষটির কোনও কথাই আজ সংসারের গ্রাহ্য নয়। প্রবীণদের সঙ্গে দু’দণ্ড বসে কথা বলাও যেন এখন সময়ের অপচয়। অবহেলা ও অপমানের জীবন ভোগ করা যখন অনিবার্য হয়ে পড়ে, তখন পালানোর বা মুক্তির পথের ঠিকানা কেবল ‘পিস হেভেন’, যেখানে প্রবন্ধকার বর্ণিত ‘এ বড় সুখের সময় নয়’-এর পরিসমাপ্তি ঘটে।
স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)