আঠারো বছর পর এই প্রথম আইপিএল-এ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু। কিন্তু তাদের ট্রফি জেতার আনন্দ নিমেষে বিষাদে পরিণত হয় দলের বিজয়োৎসবে চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের বাইরে পদপিষ্ট হয়ে ১১ জনের মৃত্যুর কারণে। এই মর্মান্তিক ঘটনায় দায় কার? এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে ইতিমধ্যেই। বেঙ্গালুরু পুলিশ প্রশাসন যেমন দায় এড়াতে পারে না, তেমনই অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্তরাও সমান ভাবেই দোষী। আইপিএল-কে ঘিরে প্রথম থেকেই মানুষের মধ্যে উন্মাদনা দেখা গিয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে যে ভাবে বিনোদন এবং ক্রিকেটের মেলবন্ধন ঘটেছে, তাতে এই প্রতিযোগিতার জন্মলগ্ন থেকেই মানুষ এই বিষয়ে উৎসাহী। প্রশ্ন হল, এমন বিজয়োৎসবে যে মানুষের ভিড় হতে পারে তা কি আন্দাজ করতে পারেনি প্রশাসন? আবেগপ্রবণ জনতাকে সঠিক ভাবে পরিকল্পনা মাফিক স্টেডিয়ামে ঢোকানোর ব্যবস্থা না করে, তাদের উপর লাঠিচার্জ করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষও দায় অস্বীকার করতে পারেন না। এই সম্মিলিত অব্যবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাই এই ঘটনা কোনও একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা নয়, সামগ্রিক ব্যর্থতার বলি হল এতগুলি প্রাণ।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, আইপিএল-এর বিজয় অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই ঘটনা সর্বপ্রথম। এই ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০১২ সালে প্রথম বার কলকাতা নাইট রাইডার্স-এর আইপিএল জয়কে। জয়ের পর তারা কলকাতায় ফিরে ইডেন গার্ডেনসে অনুষ্ঠান করলেও সেই অনুষ্ঠানকে কলকাতা পুরসভা এবং কলকাতা পুলিশ যৌথ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। ক্রিকেটকে ঘিরে বরাবরই কলকাতায় উন্মাদনা থাকে। সে দিনের অনুষ্ঠানেও একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তা সত্ত্বেও আবেগপ্রবণ জনতার ঢলকে দক্ষ হাতে সামলেছিলেন কলকাতার পুলিশ আধিকারিকরা।
শুধুমাত্র ক্রিকেটের ক্ষেত্রেই নয়, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পরে অন্য রাজ্য এমনকি বিদেশ থেকে কলকাতার পুজো দেখতে আসেন বহু মানুষ। ২০১৫ সাল। কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের পুজোতে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্গা’ আলোড়ন তোলে। কিন্তু সেই বছরেই দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়ে আহত হন বেশ কিছু মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে সেই প্যান্ডেল ও দেবী দর্শন বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রশাসনের তরফে। পরবর্তী বছরগুলিতেও পুজোর সময় শহরে কলকাতা পুলিশ, পুরসভা, দমকল, বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর— সকলে যৌথ ভাবেই মানুষকে সুরক্ষা দিয়ে আসছে, যাতে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানো যায়।
জনতার মধ্যে তাদের প্রিয় দলকে ঘিরে আবেগ থাকবে। কিন্তু সেই আনন্দ যেন বিষাদে পরিণত না হয় সেই বিষয়ে তাদের সচেতন থাকতে হবে। প্রশাসনিক দক্ষতার সঙ্গে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এমন অপ্রীতিকর ঘটনা থেকে বাঁচা সম্ভব।
শম্পা পাল, কলকাতা-২৪
জীবন বড়
‘প্রকৃত ক্ষত’ (৭-৬) শীর্ষক সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কথা। ৪ জুন সন্ধ্যায় বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে এ বারের আইপিএল জয়ী রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর (আরসিবি) বিজয়োৎসব উপলক্ষে ওই স্টেডিয়ামেরই বাইরে বিশাল জনসমুদ্রের চাপে পদপিষ্ট হয়ে মারা গেলেন ১১ জন ক্রিকেটপ্রেমী। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল ১৯৮০ সালের অগস্টে কলকাতার ইডেন গার্ডেনসে মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গলের খেলা উপলক্ষে মাঠে উপস্থিত ১৬ জন ফুটবলপ্রেমীর পদপিষ্ট হয়ে মারা যাওয়ার ভয়াবহ ঘটনা। ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে এই ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে আমরা কমবেশি পরিচিত। যেমন, চিন্নাস্বামীর ঘটনার আগেই এ বারের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী পিএসজি-র সমর্থকদের বিজয়োৎসব রীতিমতো তাণ্ডবে পরিণত হয়। প্যারিসে অন্তত দু’জনের মৃত্যু হয়, আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় বহু গাড়িতে। ভাঙচুর হয় দোকানপাটও। কিন্তু চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের বিভিন্ন গেটের সামনে ঘটে যাওয়া পদপিষ্টের ঘটনাবলির ক্ষেত্রে আরসিবি-র সমর্থকরা কোনও রকম ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না। তাঁরা শুধুমাত্র অতিরিক্ত আবেগের বশবর্তী হয়ে তাঁদের প্রিয় দলের জয়ের উৎসব পালন করতে ও প্রিয় নায়কদের দেখতে গিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, সেই বেলাগাম আবেগই অল্প সময়ের মধ্যেই প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।
ভারতে ধর্মীয় সমাবেশে, বিশেষত কুম্ভমেলায় পুণ্যার্থীদের পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা কম নয়। এই বছরেই জানুয়ারির শেষে প্রয়াগরাজে অনুষ্ঠিত মহাকুম্ভ মেলায় প্রচণ্ড ভিড়ের চাপে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন কমপক্ষে ৩০ জন (সরকারি মতে) পুণ্যার্থী। ওই দুর্ঘটনার জন্য উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সরকারের বিরুদ্ধে মহাকুম্ভে আগত পুণ্যার্থীদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ তুলেছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। এ বার বেঙ্গালুরুর ঘটনার জন্যও কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া এবং উপ-মুখ্যমন্ত্রী শিবকুমারের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে বিজেপি।
আমাদের প্রত্যেকেরই এই ধরনের দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষালাভ করতে হবে। এই খেলার সঙ্গে জড়িত এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলিকে মনে রাখতে হবে যে, নিছক জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বা লাভের আশায় নিজেদের কর্তব্যে বা দায়িত্বে যেন কোনও ভুল থেকে না যায়, যার পরিণতি নিদারুণ হতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কোনও দুর্ঘটনা, বেআইনি কাজ, দুর্নীতি ইত্যাদির জন্য কোনও রাজ্য সরকারই দায়ভার নিজের উপর নিতে অভ্যস্ত নয়। অবশ্য এরই মধ্যে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা, যিনি ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও পর্যটন মন্ত্রী হিসাবে গত ২২ এপ্রিল পহেলগামে জঙ্গিদের হাতে নিরীহ পর্যটকদের হত্যার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিলেন।
বেঙ্গালুরুর দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক কপিল দেব বলেছেন, উৎসবের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল জীবন। এই মোক্ষম কথাটি ক্রিকেটপ্রেমীরা যত বেশি মনে রাখেন, ততই মঙ্গল।
অমিত কুমার চৌধুরী, কলকাতা-৭৫
আবেগের বলি
‘১১ মৃত্যুতেও চলল ট্রফি জয়ের উৎসব’ (৫-৬) শীর্ষক মর্মান্তিক প্রতিবেদন সম্পর্কে দু’-চার কথা। অতীতের কোনও ঘটনা থেকে সরকার, সংগঠক, আমাদের মতো সাধারণ মানুষ— কেউই কোনও শিক্ষা নিতে পারেনি। সেই কারণেই তো উৎসব পরিণত হল শোকে, আর জয়োল্লাস স্বজনহারার হাহাকারে। চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে এ বারের আইপিএল ট্রফি জয়ী রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিজয় উৎসবে ভিড়ের চাপে পদপিষ্ট হয়ে নিবে গেল ১১টি তরতাজা প্রাণ। এ প্রসঙ্গে এ কথা বলতেই হবে, আমরা অনেক কিছুই ভালবাসি, ক্রিকেট খেলাও ভালবাসি, ক্রিকেটারদেরও ভালবাসি। কিন্তু জীবন বাজি রেখে সেই ভালবাসার প্রমাণ দিতে যাব কেন? আমরা এখনও বুঝতে চেষ্টা করছি না— জীবন আমার, তার রক্ষার দায়িত্বও সম্পূর্ণই আমার। আমাদের মনে রাখা দরকার, কারও ভক্ত হওয়া ভাল, কিন্তু অন্ধভক্ত হয়ে নিজের জীবনটাকেই মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া চরম মূর্খামি। এই মর্মান্তিক মৃত্যুমিছিলের পর যথারীতি চলেছিল দোষারোপের পালা, যা এর আগেও বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গিয়েছিল। বেঙ্গালুরুর ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হয়েছেন, কেউ হয়েছেন সাসপেন্ড। কাউকে অন্যত্র বদলিও করা হয়েছে। কিন্তু আসল প্রশ্ন হল— এমন ঘটনার পরে সর্বস্তরে সচেতনতার কি বৃদ্ধি হয়েছে? আমরা চাই, এমন শোকের পরিবেশ যেন আর সৃষ্টি না হয়।
আবেদন— এমন বেদনাদায়ক ঘটনা সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর ৪ জুন তারিখটিকে ‘ক্রিকেটপ্রেমী দিবস’ হিসেবে পালনের ব্যবস্থা করা হোক।
সত্যকিঙ্কর প্রতিহার, যমুনা, বাঁকুড়া
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)