‘ঘুণ’ (২৬-৬) সম্পাদকীয়তে আলোচিত বিষয়বস্তুর সঙ্গে সহমত পোষণ করে দু’-এক কথা বলতে চাই। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে যে কোনও খুন, ধর্ষণ, হিংসা ও দুর্নীতির কথা উঠলেই শাসক দলের নেতা-কর্মীরা ভিন রাজ্যের উদাহরণ টেনে এ রাজ্যে তৃণমূল শাসনের উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে গলা ফাটান। অথচ যে বলিষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এক সময় বিরোধী আসনে থাকাকালীন বামফ্রন্ট আমলে ভোটের আগে ও পরে সন্ত্রাস, ছাপ্পা ভোট, বুথ দখল, রিগিং, সর্বোপরি বাম অপশাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্ৰাম করেছেন, সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে বিধানসভা ও লোকসভা কাঁপিয়ে দিয়েছেন, সেই তিনিই আজ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, পুলিশমন্ত্রীও বটে। অথচ, তিনিও রাজ্যে পালাবদলের পর তাঁর পূর্বসূরিদের পথেই হাঁটলেন। যে কোনও রাজ্যে উন্নয়নের আগে দরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। তার একমাত্র প্রয়োগকারী হল পুলিশ-প্রশাসন। পুলিশ-প্রশাসন যদি উত্তরাধিকার সূত্রে দলদাসে পরিণত হয়, তা হলে যে কোনও হিংসায় প্রাণহানি আটকানো সম্ভব নয়। সামান্য একটি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচন, যার জয়-পরাজয়ে শাসকের বিন্দুমাত্র সম্মান ও রাজনৈতিক গুরুত্ব কমে যায় না, সেই আসনে জয়ী হওয়ার তাণ্ডবে এক ফুলের মতো শিশুর প্রাণ চলে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগের ঘটনা। সম্পাদকীয়ের শেষে যথার্থই বলা হয়েছে, যাঁরা এই অমানবিক ঘটনা ঘটালেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি তোলা দরকার ছিল সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে, দলদাসত্ব ভুলে।
কিন্তু রাজ্যের গোটা সমাজব্যবস্থায় ঘুণ ধরেছে, এ কথা আমি মনে করি না। কারণ, এই সমাজই এক দিন কংগ্রেসের অপশাসন ছুড়ে ফেলেছিল, বাম শাসনের ঔদ্ধত্য সমূলে উৎপাটিত করেছিল। যে রাজ্যে শিল্পের আকাল, স্থায়ী কর্মসংস্থান ক্রমহ্রাসমান, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা বিধ্বস্ত, স্বাস্থ্যে দুর্নীতি, রাস্তায় জোড়া-তাপ্পি, সেখানে হরেক রকম জনমুখী প্রকল্প কত দিন সরকারকে সুরক্ষা দেবে— সে প্রশ্ন তোলাই যায়। তাই ঔদ্ধত্য, অপশাসন এই আমলেও অব্যাহত থাকলে এই ভোটাররাই বর্তমান শাসক দলকেও নিশ্চিহ্ন করবে বলে মনে করি।
হারান চন্দ্র মণ্ডল, ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
অস্থায়ী দাপট
‘ঘুণ’ সম্পাদকীয় নিয়ে কিছু কথা। কর্মসূত্রে প্রশাসনে থাকার সুবাদে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে প্রায় চোদ্দোটি সাধারণ নির্বাচনের কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। যে কোনও নির্বাচন প্রক্রিয়া ভারতীয় নির্বাচন কমিশন বা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে হয়। কিন্তু যে কোনও নির্বাচনের (পুরসভা, পঞ্চায়েত-সহ) মূল কান্ডারি হল জেলা, মহকুমা ও ব্লক প্রশাসন। সংবিধানের ৭৩ এবং ৭৪তম সংশোধনীর বলে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে অবশ্যই প্রশাসনিক সহায়তায় সমস্ত ধরনের উন্নয়নমূলক প্রকল্প রূপায়িত হওয়া শুরু হয়। এবং তাদের মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটি সমধুর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। কিন্তু প্রশাসনিক আধিকারিকরা নির্বাচনের সময় বিধিবদ্ধ ভাবে নির্বাচনের কাজকর্ম করার ফলে রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। তখনই ভুল বোঝাবুঝির শুরু এবং তা অনেক সময়ই হিংসাশ্রয়ী রূপ নেয়। নির্বাচন-পরবর্তী বিভিন্ন ধরনের লাগামছাড়া হিংসাশ্রয়ী ঘটনা কড়া হাতে দমন না করতে পারার অন্যতম কারণটি হল— নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরে প্রশাসনিক শৈথিল্য।
অপর একটি আইনশৃঙ্খলা-পরিপন্থী কাজ হল বিজয় মিছিলের দাপট। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বিজয় মিছিলগুলির হিংসাত্মক কার্যকলাপ প্রতিহত করার কোনও প্রশাসনিক সদিচ্ছা আদৌ থাকে বলে মনে হয় না। এ বার নদিয়ার একটি উপনির্বাচনের পর এক বালিকার বোমার আঘাতে মৃত্যু আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি সূচিত করে। একটা সময় ছিল যখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে বিজয় মিছিলের পথ ঠিক হত। এখন সে সব বিস্মৃতপ্রায়। আর এক দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা হল— যে কোনও খুনখারাপির ঘটনাকে বিচ্ছিন্নতার রূপ দেওয়া। আসলে গোড়াতেই গলদ! বিভিন্ন আইনসভাতে আইন পাশ হচ্ছে, কিন্তু প্রশাসনিক স্তরে সেগুলির প্রয়োগ করতে গেলেই আধিকারিকদের রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সর্বশেষে বলি, পর পর দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার দম্ভ চিরস্থায়ী হয় না, অন্তত ইতিহাস তারই সাক্ষ্য দেয়।
সুবীর ভদ্র, কলকাতা-১৫১
মোহগ্রস্ত
সতর্ক হওয়াই শ্রেয়। এখন প্রতিটি জনপদে দোকান, আর সেখানে হরেক রকম আর্থিক ঠোঙায় বিক্রি হচ্ছে জনহিতকর লজেন্স। অথচ, জরুরিভিত্তিক রাষ্ট্রিক ও সামাজিক কর্তব্যগুলো পড়ে রয়েছে পিছনে। উন্নয়নই প্রধান লক্ষ্য, এই চিৎকার সামনে রেখে সিন্ডিকেটের কাঠ-লোহা-সিমেন্ট জোগাড় চলছে। তাতে যদি স্বাভাবিক জলাশয়, পয়ঃপ্রণালী বুজে যায় যাক, শুধুই কাঠামো বানিয়ে লোক দেখানোই যথেষ্ট।
মিউনিসিপ্যাল অফিস বেআইনি কাজকে আইনে পরিণত করতে দরজা খুলেই বসে আছে। এবং সংশ্লিষ্ট ‘প্রোমোটিং’ নামক মাথা ঘামানো মধ্যস্বত্বভোগী মনুষ্যের হাত থেকে নতুন সৌধ নির্মাণের জন্য মোটা অনুপ্রেরণা দেওয়া-নেওয়ার চক্র অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। এই ভাবেই প্রতি দিন আমাদের বাঁচার কাঠামোটি ভেঙে পড়ছে চোখের সামনে। কে দেখবে? আমরা কাকে বলব?
এই মুহূর্তে যাঁরা শুধু ‘ধর্মেও আছে জিরাফেও আছে’, তাঁদের সংখ্যা কমাতে হবে। মাঝে মাঝে মনে হয়, একটা প্রজন্মের ছোট বড় সব ধাপ্পাবাজকে এক সঙ্গে কারাগারে পাঠালে বোধ হয় আগামী দিনের মানুষ আবার খাঁটি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তা তো হয় না। শুদ্ধ অশুদ্ধ এমন ভাবে মিশে আছে আমাদের দৈনন্দিন চলাচলের মধ্যে যে, কে নির্মোহ কে মোহগ্রস্ত, এই সূক্ষ্ম বিচারে— কে জানে— শেষ পর্যন্ত হয়তো বিচারকেরাও বিচারাধীন হয়ে পড়তে পারেন।
অনুপম মুখোপাধ্যায়, সালকিয়া, হাওড়া
ইলিশে বাঙালি
ইলিশ বাঙালির এক অবিচ্ছেদ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। শুধু মাছ নয়, ইলিশ যেন বাঙালির আবেগ, উৎসব, ও স্বাদের সঙ্গে মিশে থাকা এক অনুভবের নাম। পদ্মার ইলিশ, গঙ্গার ইলিশ, কিংবা সাগরের ইলিশ— সব ধরনেই বাঙালি-পাতে তার কদর চরমে। বর্ষা নামলেই বাঙালির ঘরে ঘরে যেন ইলিশ উৎসব শুরু হয়। নববিবাহিত কন্যার শ্বশুরবাড়িতে ‘ইলিশ পাঠানো’ অনেক পরিবারেরই এক পুরনো রীতি। এমনকি দুর্গাপুজো-সহ বিভিন্ন উৎসব, বাঙালির ঘরোয়া অনুষ্ঠানের ভোজও ইলিশের উপস্থিতি ছাড়া যেন পূর্ণতা পায় না।
বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে সর্ষে-ইলিশের সঙ্গে গরম ভাত, নয়তো গরম খিচুড়ির সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা আর প্রিয়জনের সঙ্গ— এ চিত্র বাঙালির কল্পনায় চিরন্তন হয়ে আছে। ইলিশ মাছের স্বাদ ও গন্ধ বাঙালির হৃদয়ে গেঁথে আছে। সর্ষে ইলিশ, দই ইলিশ, ভাপা ইলিশ, ইলিশ পোলাও, ইলিশ পাতুরির মতো নানা পদের রান্নার যেন স্বর্গীয় স্বাদ। কাঁটা বেশি হলেও ইলিশ খাওয়ার আনন্দ তাতে এতটুকুও কম পড়ে না। কাঁটার মাঝেই লুকিয়ে থাকে ইলিশের আসল স্বাদ।
তবে বর্তমানে অতিরিক্ত সংখ্যায় মাছ ধরা ও দূষণের কারণে ইলিশের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তাই ইলিশ বাঁচাতে সরকার নানা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা করছে। যেমন— জাটকা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ, প্রজনন কালে মাছ ধরা বন্ধ ইত্যাদি। আমাদের সকলেরই উচিত এ সব নিয়ম মেনে চলা ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে সচেতন হওয়া, যাতে ভবিষ্যতেও আমরা আমাদের প্রিয় ইলিশের স্বাদ উপভোগ করতে পারি।
সুশান্ত রায় চৌধুরী, কলকাতা-৭৮
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)