অরিন্দম চক্রবর্তীর ‘ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন বারাণসীর বাঙালিরা’ (রবিবাসরীয়, ১৭-৩) প্রবন্ধটি বারাণসী প্রবাসের স্মৃতি উস্কে দিল। কর্মসূত্রে চার বছর বারাণসীতে কাটিয়ে ১৯৮২ সালের প্রথম দিকে বদলি হয়ে কলকাতায় আসি। পুরো সময়টাই কাটিয়েছিলাম বাঙালিটোলায়। বঙ্গের বাইরে, এমনকি বিদেশেও বাঙালিরা সমষ্টিগত ভাবে বসতি গড়েছেন, অনেকেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন, বাঙালিকে সফল জাতিগোষ্ঠী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাঙালিটোলার বাঙালিরা সমষ্টিগত ভাবে সেই প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারেননি বলেই আমার মনে হয়। তাঁরা না পেয়েছেন সামাজিক প্রতিষ্ঠা, না আর্থিক সাচ্ছল্য। ব্যতিক্রম কিছু আছে, তবে তা ব্যতিক্রমই। তুলনায় ইলাহাবাদ বা লখনউয়ের বাঙালিরা আর্থিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ভাবে অনেক সমৃদ্ধ।
দুটো বিষয় উল্লেখ না করলে বারাণসী সম্বন্ধে যে কোনও লেখাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সেটা হল বাঙালিটোলার বাড়িগুলির শক্ত কাঠের দরজার মধ্যে লাগানো বিখ্যাত তালা। খুব মজবুত আর মোটা চাবি, ‘কাশীর তালা’ বলে বিখ্যাত ছিল। দ্বিতীয়টি হল ওখানে বাঁদরের উৎপাত। প্রায় সব বাড়িতেই বড় উঠোন থাকত, যার মাথার উপরে খোলা আকাশ। সেই উঠোনে যখন তখন বাঁদরের নেমে আসা আটকানোর জন্য উঠোনের উপরের খোলা জায়গা লোহার জাল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হত।
২০২২ সালের শেষের দিকে বারাণসীতে গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম শহরটা একেবারে পাল্টে গেছে। রাস্তাঘাট অনেক চওড়া, বিশ্বনাথ মন্দির প্রাঙ্গণের নতুন রূপ চমকে দেওয়ার মতো। দশাশ্বমেধ ঘাটে আরতির সময় থিকথিকে ভিড়। বাঙালিটোলায় গিয়ে থ বনে গেলাম। অনেক বাড়িই হোটেলে পর্যবসিত হয়েছে। দক্ষিণ ভারতীয় ভাষায় সাইনবোর্ড। গলির মধ্যে প্রচুর দক্ষিণ ভারতীয় রেস্তরাঁ, ইডলি-ধোসার ছড়াছড়ি। দই-মালাই-রাবড়ির দোকানগুলো প্রায় উধাও। দক্ষিণের পর্যটকেরা তখনও আসতেন, কিন্তু এত আধিক্য ছিল না। বাঙালিটোলায় কিছু পুরনো মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম যে, বিশ্বনাথ মন্দিরের নতুন আদল দেওয়ার পর দক্ষিণের মানুষদের কাছে বারাণসীর আকর্ষণ বেড়েছে। দক্ষিণের কিছু হোটেল ব্যবসায়ী বাঙালিটোলার বাড়ির মালিকদের মোটা টাকা দিয়ে বাড়ি কিনে নিয়ে হোটেল বা খাবার দোকান করেছেন। গঙ্গার ধার আর মন্দিরের কাছে থাকার কারণে হোটেলের দর বেশ চড়া। হঠাৎ করে ওখানে গেলে দক্ষিণের কোনও শহরে এসে পড়েছি বলে ভুল হতে পারে। আর বাঙালিরা অনেক টাকা পেয়ে শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে নতুন বাসস্থান তৈরি করেছেন। আর তাই বারাণসীর বাঙালিটোলার দ্বিতীয় কলকাতার তকমা আজ অস্তমিত।
তড়িৎ দাস, কলকাতা-৬
শুধুই অতীত
অরিন্দম চক্রবর্তীর প্রবন্ধটি সুখপাঠ্য। বাঙালির সঙ্গে বারাণসীর সম্পর্ক বহু প্রাচীন কাল থেকেই। বিখ্যাত বাঙালি গোপীনাথ কবিরাজ, শ্যামাচরণ লাহিড়ী সবাই এই কাশীধামেই বাস করতেন। কাশীর বাঙালিটোলায় খ্যাতিমান বাঙালিদের অবস্থান ছিল। কিন্তু কালের গর্ভে সবই হারিয়ে যায়। সত্যজিৎ রায়ের জয় বাবা ফেলুনাথ চলচ্চিত্র কাশীর বনেদি বাঙালি পরিবারের চিত্র সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছে। কিন্তু এখন তা অতীত, টিমটিম করে কিছু প্রবাসী বাঙালি ধরে রেখেছেন কাশীতে বাঙালি সংস্কৃতি।
সর্বানী গুপ্ত, বড়জোড়া, বাঁকুড়া
নাস্তিকের দাবি
‘শ্রীচৈতন্যের শহরে নাস্তিক সম্মেলন’ (১৮-৩) সংবাদ পড়লাম। এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল নবগঠিত নাস্তিক মঞ্চের উদ্যোগে। সেই সূত্রে ‘স্থানমাহাত্ম্য’ (২১-৩) সম্পাদকীয় স্তম্ভে ওই সম্মেলনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে যে আলোচনা করা হয়েছে, তার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ সহমত। ‘আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের দাবিকে অস্বীকার করি’ ব্যানার নিয়ে মিছিল সত্যিই অভূতপূর্ব ঘটনা। নাস্তিক সম্মেলনের আয়োজকদের দাবি, ভারতে ২০২২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ভারতে প্রায় ২০ কোটি মানুষ ঘোষিত ভাবে ঈশ্বরে অবিশ্বাসী। অঘোষিত নাস্তিকদের সংখ্যার সঙ্গে সেই সংখ্যাটা যুক্ত করলে যথেষ্ট বড় একটি সংখ্যাই হয়। নড়বড়ে বিশ্বাস নিয়ে অনেকেই ঈশ্বর বিশ্বাসীদের দলে ভিড় জমিয়ে সামাজিক যোগাযোগ অটুট রাখতে সচেষ্ট থাকেন। মৃত আত্মার প্রতি পিণ্ডদান, কিংবা বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধে পিতা-মাতার স্বর্গপ্রাপ্তি কী ভাবে নিশ্চিত হয়, সে ধাঁধার সমাধান এঁরা করে উঠতে পারেন না। বিতর্ক এড়াতে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলতে সাহস পান না। এ দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই বুঝতে পারেন না, তাঁরা বছর বছর সরস্বতী পুজোয় ভক্তি ভরে অঞ্জলি দিয়ে যাওয়ার পরেও, বিশ্বের প্রথম ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ভারতের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও কেন স্থান করে নিতে পারে না।
এত দিন পর্যন্ত ধর্ম সম্মেলন, বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক সম্মেলন, শ্রমিক সম্মেলন, কৃষক সম্মেলন, ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠনের সম্মেলন ইত্যাদির সঙ্গে সমাজ পরিচিত ছিল। সেই গতানুগতিকতার পথ ছেড়ে কিছু প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী মানুষ একটি সম্মেলন করে নিজেদের দাবিগুলোকে সমাজের কাছে তুলে ধরবেন, এটা অনেকের কাছেই চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা। খোলা মনে বিচার করলে দেখা যায়, নাস্তিক দাবিগুলোর সঙ্গে সমাজের বৃহদংশের মানুষের বিশেষ কোনও বিরোধ থাকার সম্ভাবনা নেই, বরং সাযুজ্য রয়েছে। আর যদি কেউ নাস্তিকদের এই উদ্যোগকে ‘ধর্মের প্রতি আঘাত’ হিসাবে দেখতে চান, তাঁকে বলব, ধর্মবিশ্বাসীদের একাংশ ধর্মের দোহাই দিয়ে হৃদয়হীন আচরণ করেছেন, তার নজির অসংখ্য। সম্প্রতি গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে নমাজ পড়তে যাওয়া বিদেশি পড়ুয়াদের উপর এক দল পরধর্ম-বিদ্বেষী যুবক যে ভাবে হামলা চালাল, তা অমানবিক। নিজেরা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হলেও, প্রত্যেক মানুষকে তাঁর ব্যক্তিগত পরিসরে যে কোনও ধর্ম আচরণ করার স্বাধীনতাই চায় নাস্তিক মঞ্চ। যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক, মানবতাবাদী মানুষেরা যখন সামাজিক পরিসরে একত্রিত হয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছে সাধারণ মানুষের মৌলিক দাবিগুলি উত্থাপন করেন, তখন সেটা নিঃসন্দেহে একটি বলিষ্ঠ সামাজিক পদক্ষেপ।
ভারতের নাস্তিক্যবাদের ইতিহাস প্রাচীন। বেদের যুগেও চার্বাকেরা লাগাতার ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে গেছেন। এই বিশ্বের যা কিছু ঘটে চলেছে তার সমস্তটাই নেপথ্যে থেকে ঈশ্বর নিয়ন্ত্রণ করেন, মানুষ নিমিত্তমাত্র— এই দাবির সামনে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী মানুষেরা প্রশ্ন তুলবেন, প্রমাণ চাইবেন, প্রয়োজনে সামাজিক সুস্থতা বজায় রেখে তর্ক করবেন। বিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ শতবার্ষিকী হলে কমিউনিস্ট নেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় ও মুহাম্মদ ইসমাইলের সঙ্গে অধ্যাপক বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী ও অন্য বক্তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্নে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আমি সেই সভায় উপস্থিত ছিলাম।
আসলে, খুব ছোট বয়সেই ঈশ্বর বিশ্বাসের বীজ আমাদের মনের মধ্যে গ্রথিত করে দেওয়া হয়। পরিণত বয়সে যার জটাজাল ছিন্ন করে নিজেকে বার করে আনা অত্যন্ত কঠিন। যাঁরা নিজেদের যুক্তিবাদী চর্চা বা আন্দোলনের সঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে যুক্ত রাখতে পেরেছেন, তাঁরা সংস্কারের জাল ছিঁড়তে পেরেছেন। এই মানুষেরা যখন দেখেন, তথাকথিত নিম্ন জাতের মেধাবী যুবক রোহিত ভেমুলা ‘জাতের নামে বজ্জাতি’-র শিকার হয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন, কিংবা মসজিদ ভেঙে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়, বা বছর বছর পুজো-অনুদান বৃদ্ধি পায়, তখন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রশ্ন তোলেন। এটা সব সচেতন নাগরিকের কর্তব্য।
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy