E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: অসহায় বটবৃক্ষ

আধুনিক জীবনযাত্রায় রোগ-যন্ত্রণা থেকে একাকিত্ব ও ঠাঁইনাড়া হওয়ার অনিশ্চয়তায় দুলতে থাকে অসহায় প্রবীণদের নিয়তি। জীবনের এই সাঁঝবেলায় এঁদের প্রতি সার্বিক অনাদরের চিত্রটি প্রতিনিয়ত বেআব্রু হচ্ছে।

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৫ ০৭:০৯

প্রচেত গুপ্তের ‘এ বড় সুখের সময় নয়’ (রবিবাসরীয়, ১৫-৬) প্রবন্ধ প্রসঙ্গে একটি অভিজ্ঞতা জানাতে চাই। বছর কয়েক আগের ঘটনা। ব্যক্তিগত কাজে স্থানীয় বিডিও অফিসে রয়েছি। দেখি জনাকয়েক ছেলের সঙ্গে অশীতিপর এক বৃদ্ধা আসছেন ওই অফিসে। একটাই আবেদন, তিনি মরতে চান। রুলটানা একফালি সাদা কাগজে কেউ লিখে দিয়েছে তাঁর মরণের আর্তি। শেষে নিজের টিপসই। প্রথমে এড়িয়ে গেলেন অনেকেই। কিন্তু নাছোড়বান্দা বৃদ্ধার জবানিতে উঠে এল যে, তিনি নিঃসন্তান। স্বামীর অবর্তমানে তাঁকে ভিটেছাড়া করেছে গুণধর দেওর-জা’রা। হাতে কয়েকশো টাকা ধরিয়ে সাদা কাগজে টিপছাপে সই নিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে বসতবাড়ি থেকে। শুরুর দিকে পাড়াপড়শিরা দু’বেলা খেতে দিলেও বর্তমানে তিনি অশক্ত, মাথার উপরে ছাদটুকু হারিয়ে আক্ষরিক অর্থেই সহায়হীন। অবশেষে স্বয়ং বিডিও মধ্যস্থতা করায় সদর শহরের একটি সরকারি আশ্রয়ে তিনি জায়গা পান।

আধুনিক জীবনযাত্রায় রোগ-যন্ত্রণা থেকে একাকিত্ব ও ঠাঁইনাড়া হওয়ার অনিশ্চয়তায় দুলতে থাকে অসহায় প্রবীণদের নিয়তি। জীবনের এই সাঁঝবেলায় এঁদের প্রতি সার্বিক অনাদরের চিত্রটি প্রতিনিয়ত বেআব্রু হচ্ছে। বছর চারেক আগে এই সত্যটিই উঠে এসেছিল ইন্দোরে, যখন শহর পরিচ্ছন্ন রাখার অজুহাতে ফুটপাতবাসী প্রবীণদের গাড়িতে তুলে বাইরে পাঠানো হচ্ছিল সরকারি উদ্যোগে (রাস্তায় ফেলা হল গৃহহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের!, ৩১-১-২১)।

ফি বছর প্রবীণ নাগরিকদের সঞ্চয়ে সুদের হার কমিয়ে দেওয়া, প্রাপ্য সুবিধা আদায় অথবা আধার সংযুক্তির নামে অযথা অপেক্ষা ও হয়রানি, রেল সফরে সিনিয়র সিটিজ়েনের ভর্তুকি বন্ধ, গণপরিসরে পৃথক শৌচালয় না থাকা, জীবিত থেকেও সরকারি নথিতে মৃতব্যক্তির তকমা পেয়ে পুনরায় ‘বেঁচে আছি’র প্রমাণ দাখিলের ঝক্কি, শেষ জীবনে আবাস যোজনার টাকা পেতে পার্টি তহবিলে অনিচ্ছার ‘প্রণামী’ প্রদান... অবহেলার এমনতর নানা করুণ কাহিনি মাঝেমধ্যেই উঠে আসে সংবাদপত্রের পাতায়। সাংসারিক জীবনে কতটা হৃদয়হীন হলে গঙ্গাসাগরে সংক্রান্তির পুণ্যস্নান শেষে বৃদ্ধ পিতামাতাকে একলা ফেলে চলে যাওয়া যায়, ভাবলে শিউরে উঠি। এ ছাড়াও আছে, সুস্থতার পরেও পরিজন কর্তৃক ব্রাত্য হয়ে হাসপাতাল বা পাভলভের চৌখুপিতে দিন কাটানোর যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা।

এক কালে বটবৃক্ষের মতো যাঁরা আগলে ছিলেন আমাদের, যাঁদের স্নেহে আমাদের চলার পথটি মসৃণ হয়েছে, প্রতি দিনের আত্মত্যাগে যাঁরা নির্মাণ করেছেন সম্পর্কের ভিত, আজ জীবন সায়াহ্নে তাঁদের প্রতি পরিবার ও রাষ্ট্র উভয়েরই অধিক যত্নবান হওয়ার দরকার আছে বইকি।

সুপ্রতিম প্রামাণিক, আমোদপুর, বীরভূম

কিসে বেশি সুখ

বয়স্ক মানুষদের একা থাকা নিয়ে প্রচেত গুপ্তের ‘এ বড় সুখের সময় নয়’ প্রবন্ধটি খুবই প্রাসঙ্গিক। মা-বাবা সব সময়ই চান, সন্তানরা সুখে থাকুক। অনেক পরিবারে মা-বাবারা আর্থিক প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে রেখে শুধুমাত্র ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া এবং তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর দিতে গিয়ে জীবনে অনেক আত্মত্যাগ করতে বাধ্য হন। সন্তান উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করলে প্রত্যেক মা-বাবা স্বভাবতই অত্যন্ত খুশি হন। কিন্তু এর পর অধিকাংশ অণু পরিবারের একটি বা দু’টি সন্তান যখন অন্য রাজ্যে বা দেশে পছন্দমতো চাকরির সন্ধানে পাড়ি দেয়, সেই মুহূর্তে মা-বাবারা আনন্দ ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও পরবর্তী সময়ে এক অব্যক্ত যন্ত্রণার সম্মুখীন হন, যার নাম নিঃসঙ্গতা। সন্তান কাছে না থাকায় অনেকেই মনকে প্রশ্ন করেন, তাঁরা কি এই শূন্যদৃষ্টি নিয়ে একাকিত্বের জীবনই চেয়েছিলেন!

তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সন্তানেরা দূরে থাকলেও কর্তব্য না ভুলে পিতামাতার শরীর ও অন্যান্য প্রতিটি বিষয়েই খোঁজখবর নেয় এবং নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী প্রয়োজনমতো অর্থ পাঠাতেও কার্পণ্য করে না। তবে এমন অনেক ছেলেমেয়েদেরও দেখেছি এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, শুধুমাত্র মা-বাবার কাছে থাকার জন্যই ভিনরাজ্য বা দেশে অনেক লোভনীয় এবং উঁচু বেতনের চাকরি উপেক্ষা করে অপেক্ষাকৃত কম উপার্জনের চাকরিতে রয়ে গিয়েছে নিজেদের বাড়িতে। শিশুবেলা থেকে অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে মানুষ করা মা-বাবা তাদের কাছে অর্থের চেয়েও বেশি মূল্যবান— এই মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে। নিজেদের কেরিয়ার গড়ার জন্য ভিনরাজ্য বা দেশে পাড়ি দেওয়া, না কি কেরিয়ার উপেক্ষা করে শুধুমাত্র মা-বাবাকে কাছে পাওয়ার জন্যই অপেক্ষাকৃত কম রোজগারেও বাড়িতে থেকে যাওয়া— এই দুইয়ের কোনটা ঠিক, এ নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। তবে বার্ধক্যে উপনীত হওয়া মানুষই সঠিক বলতে পারবেন, জীবনে কোনটা তাঁর কাছে প্রকৃত সুখের সময়।

অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি

উল্টো ছবি

প্রচেত গুপ্তের ‘এ বড় সুখের সময় নয়’ পড়লাম। বর্তমান সমাজে কিছু প্রবীণ মানুষ যে অসীম দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন, তার দিকে সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ। তবে আমার দেখা বাঙালি সমাজে আমি উল্টো ছবিটাই প্রতিনিয়ত দেখে চলেছি। সেখানে সন্তানদের জীবন কখনও কখনও দুর্বিষহ হয়ে উঠছে তাদের অভিভাবকদের খামখেয়ালিপনায়। দু’টি সত্যি ঘটনা উল্লেখ করছি।

এক দম্পতির বিয়ের আগে থেকেই ছেলেটির মা ছিলেন অসুস্থ। সেরিব্রাল অ্যাটাক হওয়ায় তাঁর এক দিকের হাত-পা ভালমতো কাজ করত না। কোনও রকমে নিজের কাজটুকু করতে পারতেন। এই সময় অসুস্থ শাশুড়িকে ফেলে তাঁরা নিজেরা কোথাও সে ভাবে বেড়াতে যেতে পারেননি। দম্পতির দুই সন্তান হয়ে যাওয়ার বছর দুয়েক পর শাশুড়ির মৃত্যু হয়। এর পরে শ্বশুরমশাইকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা প্রথম দু’-এক জায়গায় ঘুরতে গেলেন। কিন্তু তার পর শ্বশুরমশাই বলতে লাগলেন, তোমরা ঘুরে এসো, আমি বাড়িতে ভালই থাকতে পারব। বাবাকে কিছুতেই রাজি করাতে না পেরে ছেলে আত্মীয়দের কাউকে রাতে বাবার সঙ্গে শোয়ার ব্যবস্থা করে বেড়ানোর প্রোগ্রাম করলেন। কিন্তু গাড়িতে উঠে স্টেশন যাওয়ার আগেই খবর পেলেন তাঁর বাবার অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা। তাড়াতাড়ি ফিরে এসে ডাক্তার ডেকে দেখা গেল, অতিরিক্ত টেনশনে তাঁর এমন অবস্থা হয়েছে। এই ঘটনা এক বার নয়, বার বার ঘটেছে।। ফলে অফিস থেকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর এলটিসি পেলেও তাঁরা আর বেড়ানোর চেষ্টা করেননি। বাবা প্রায় সাড়ে নিরানব্বই বছর বয়সে গত হন। তাঁর মৃত্যুর সময় ছেলে সত্তরোর্ধ্ব এবং বৌমা ষাটোর্ধ্ব, ফলে তাঁদের ঘুরে বেড়ানোর ক্ষমতা সেই ভাবে ছিল না।

এ বার আসি আর এক দম্পতির কথায়। ছেলে মায়ের একটি সন্তান এবং অল্প বয়সে বাবা গত হওয়ায়, মা-অন্ত প্রাণ। ছেলের বিয়ের পর যে সংসারের উপর মায়ের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল, সেখানে হঠাৎ এক জন কন্যার বয়সি মেয়ে এসে অধিকার নেবেন, সেটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। ফলে অশান্তি সৃষ্টি হল। পুত্রবধূ চাকরি করতেন, তা সত্ত্বেও বাড়িতে রান্নার লোক শাশুড়ি কিছুতেই রাখতে দেবেন না। তাঁদের একটি কন্যাসন্তান হয়। এর কিছু দিন পরেই ছেলেটির মা’র ক্যানসার ধরা পড়ে। তাঁকে মুম্বই নিয়ে গিয়ে যথাযথ চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করা হয়। এ সব সত্ত্বেও মায়ের ছেলের বাজার করা পছন্দ হত না, বৌমার রান্না পছন্দ হত না— নানা বিষয় নিয়ে নিত্য অশান্তি। নাতনি হওয়ার পর পরই তাঁর ক্যানসার ধরা পড়ায় নাতনিকেও তিনি কখনও কাছে টেনে নেননি। এমন ঘটনাও ঘটেছে— জ্বরতপ্ত নাতনিকে নিয়ে পুত্রবধূ বসে আছেন ঘরে, শাশুড়ি তাঁর নিজের মতো রান্না করে খেয়ে নিয়েছেন। সুতরাং, শুধুমাত্র প্রবীণদের কাছেই সময়টা দুঃখের নয়, বিপরীত ছবিটিও অনেক ক্ষেত্রে সত্যি।

মিতালী বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-১৩৬

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Senior citizen family Indian Government West Bengal government

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy