‘ইতিহাসের রথের রশি’ (৬-৭) শীর্ষক গৌতম চক্রবর্তীর প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু সংযোজন করতে চেয়ে এই পত্র। প্রবন্ধে লেখক জানিয়েছেন, ১৯৭৮ সালে হাইনরিখ ভন স্টিটেনক্রন নামে এক জার্মান ইতিহাসবিদ হিসাব দিয়েছিলেন, সারা ওড়িশা জুড়ে প্রায় ৯৩১টি জগন্নাথ মন্দির আছে, কোথাও তাঁর নাম দধিবামন, কোথাও বা পতিতপাবন। পুরীর আদলে সব মন্দিরেই পুজো হয় এবং স্নানযাত্রা, রথযাত্রা পালন করা হয়।
ইতিহাস খুঁজলে পাওয়া যায়, ১৮০৪ সালে পুরীতে এসেছিলেন ইংরেজ উইলিয়াম ব্যাম্পটন। রথযাত্রায় অগণিত মানুষের অংশগ্রহণ, আবেগ-উচ্ছ্বাসের বহর, সব দেখে-শুনে ঘোষণা করেছিলেন, এর ‘পতন’ অবশ্যম্ভাবী। সেই ভবিষ্যদ্বাণী তো ফলেইনি, উল্টে রথযাত্রাকে ঘিরে গণ উন্মাদনা বেড়েই চলে বছর-বছর। সেই দৃশ্য ১৯ বছর পরে নিজেই দেখেছিলেন ওই ব্যাম্পটন সাহেব। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন— কেবল ওড়িয়ারা নয়, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালিরাও শ্রদ্ধাবনত চিত্তে জগন্নাথের পুজো করে, রথের সময় ভিড় করে। উইলিয়াম ব্যাম্পটনের মতোই হিন্দু ধর্মের মানুষের গণ উন্মাদনা মেনে নিতে পারেননি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামের যাজক ক্লডিয়াস বুকানন। ১৮০৬ সালে রথযাত্রার সময় তিনি পুরীতে এসেছিলেন। মানুষের ভিড় দেখে শঙ্কিত হয়ে কলকাতায় ফিরে বলেন— এ দেবতা তো রক্তের ভেট নেন। তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল কাউন্সিলের সদস্য জর্জ উডেনকে চিঠি লিখে আবেদন জানান, এমন উৎসব বন্ধ করে দেওয়ার জন্য, কারণ, ভিড়ের অভিঘাতে বা স্বেচ্ছায় রথের নীচে তীর্থযাত্রীরা মৃত্যুবরণ করে। ইংরেজ কবি রবার্ট সাউদি তাঁর ‘দ্য কার্স অব কেহামা’ শীর্ষক কবিতায় শ্লেষ আর ব্যঙ্গ মিশিয়ে বিষয়টিকে তুলে ধরেন। কবিতার বাংলা তর্জমা হয় এই রকম— রাস্তায় উন্মত্ত ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে/ আর ভগবানকে ডাকতে-ডাকতে/ তাদের আত্মনিবেদিত শরীরগুলো সেখানেই থাকে পড়ে/ তাঁর রথের রাস্তা প্রশস্ত করতে/ তার ডাকে তাঁকে জগন্নাথ বলে/ বিশাল রথটা গড়াতে গড়াতে চলে সবাইকে পিষতে পিষতে। অন্য দিকে, ভিড় নিয়ে বর্ণনা এ রূপ— মানুষ মরছে জগন্নাথের রথের তলায়। ভিড়ের ঠেলায়। কিংবা স্বেচ্ছায়।
রথযাত্রাকে ঘিরে উৎসাহে ভাটা পড়ে না। ধনী-দরিদ্র, আবালবৃদ্ধবনিতা, সকলকে টেনে আনেন জগন্নাথ রথযাত্রার কালে, আপন ঐশী আকর্ষ দিয়ে। কুম্ভের মতো নির্দিষ্ট সময়ান্তরে নয়। প্রতি বছর ঠিক তিথি মেনে। যুগ যুগ ধরে।
শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া
সকলের তরে
গৌতম চক্রবর্তী ‘ইতিহাসের রথের রশি’ প্রবন্ধে পুরীর স্থান মাহাত্ম্য এবং রথযাত্রা উৎসবের যে ইতিহাস ব্যক্ত করেছেন তা পড়ে আমি অভিভূত। কিন্তু এই প্রবন্ধে উনি লিখেছেন, ১২৩০ খ্রিস্টাব্দে রাজা তৃতীয় অনঙ্গ ভীম দেব ৩৬ নিয়োগের কৃতিত্বের অধিকারী, এর মাধ্যমে জাতপাত প্রথা থাকবে না— এ প্রসঙ্গে এবং হিন্দু রাজ্যের যে কেউ মন্দিরে ঢুকতে পারবেন এই তথ্যগুলি নিয়ে কিন্তু দ্বিমত পাওয়া যাচ্ছে। হয়তো কলিঙ্গরাজ পুরীর মন্দিরে যে নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের ঢুকতে দেওয়া হত না, সেটা জানতে পারেননি তখন। ওড়িশায় সে সময় অনেক জগন্নাথ মন্দির ছিল এবং আজও আছে। হয়তো তিনি এই সব মন্দিরের কথাই বলেছিলেন।
১৫১০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীচৈতন্যদেব নীলাচলে গিয়েও ওই প্রথা বন্ধ করতে পারেননি। কিন্তু তিনি রথের রশিতে হাত দেওয়ার অধিকার হরিজনদের দিয়েছিলেন। ১৫১২ খ্রিস্টাব্দে পুরীর জগন্নাথের রথ টানা হচ্ছিল, কিন্তু কিছুতেই রথ নড়ছিল না। পুরীর রাজা তখন খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন ভগবানের রোষের ভয়ে। এই দেখে শ্রীচৈতন্যদেব এগিয়ে আসেন এবং রাজাকে বলেন, “আপনি নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের রথের রশিতে হাত দিতে বলুন। রথ অবশ্যই চলবে। জগন্নাথদেব শ্রীবিষ্ণুর অন্যতম রূপ। সবার দেবতা উনি।” রাজার আদেশে সমস্ত নিম্নবর্গীয় হিন্দু এবং হরিজনকে রথের রশিতে হাত দিতে দেওয়া হয়েছিল। এর পর নাকি রথ চলতে শুরু করে।
আর একটা বিষয় সংযোজন করা প্রয়োজন, মহাত্মা গান্ধীকে কিন্তু মন্দিরে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়নি। তাঁর হরিজন সঙ্গীসাথিদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে তিনি নিজেই এই মন্দিরে ঢোকেননি।
কমল চৌধুরী, কলকাতা-১৪০
দুর্ভোগে মিল
গৌতম চক্রবর্তীর ‘ইতিহাসের রথের রশি’ প্রবন্ধ পড়ে কিছু অন্য ধরনের কথা মনে পড়ে গেল। দেখতে গেলে, রথযাত্রা ও মহরমের উদ্দেশ্য ভিন্ন, গন্তব্যও ভিন্ন; এমনকি শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী বেশির ভাগ মানুষের ধর্মও ভিন্ন। কিন্তু এত কিছু ভিন্নতার মাঝে সাদৃশ্যও আছে অনেক বিষয়ে।
প্রথমত, সোজা ও উল্টো দু’টি রথের শোভাযাত্রাই বার হয় বিকেলের দিকে। আর মহরমের শোভাযাত্রা এক দিন সকালে ও আর এক দিন বিকেলে বার হয়। তবে দু’টি ক্ষেত্রেই লোকসমাগম হতে শুরু করে শোভাযাত্রা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে। দ্বিতীয়ত, রথ হোক বা মহরম যে কোনও শোভাযাত্রা নিয়ে পথে বার হতে হলে পুলিশের অনুমতি একান্ত প্রয়োজন, বিশেষত শহরাঞ্চলে। সব ক্ষেত্রে কি শোভাযাত্রার উদ্যোক্তারা পুলিশের অনুমতি নেন? তৃতীয়ত, শহরের রাজপথে বা জাতীয় সড়কে রথ বা মহরমের শোভাযাত্রা বার হলে পথ তিন থেকে চার ঘণ্টার জন্যে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, যান চলাচল আংশিক ভাবে বা সম্পূর্ণ ভাবে বিপর্যস্ত হয়। সাধারণ মানুষকে দীর্ঘক্ষণ শোভাযাত্রার কারণে আটকে থাকতে হয়। দূরপাল্লার ট্রেন বা প্লেন ধরতে না পেরে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। শুধু একটি বা দু’টি পথই নয়, কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যে বহু পথ রথ ও মহরমের দিন শোভাযাত্রার কারণে কয়েক ঘণ্টা স্তব্ধ হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের কাছে এই দু’টি উৎসবের শোভাযাত্রাই একটা ত্রাসের কারণ।
একই যাত্রায় পৃথক ফলের কথা আমরা অনেকেই শুনেছি ও দেখেছি। কিন্তু দু’টি সম্পূর্ণ পৃথক যাত্রায় এমন একই ফল সচরাচর বড় একটা দেখা যায় না। তবে এ কথা ঠিক যে, শুধু রথ বা মহরমই নয়, আরও বেশ কয়েকটি ধর্মীয় উৎসবের কারণে কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের রাস্তাঘাট বছরের বিভিন্ন সময়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে; দুর্গাপুজো ও ইদ তার মধ্যে অন্যতম। আর এই বিষয়ে আমরা দেখে আসছি যে, প্রত্যেক উৎসবের উদ্যোক্তারাই সরবে জানিয়ে দেন যে, যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা ও জনজীবন স্বাভাবিক রাখা প্রশাসনের দায়িত্ব ও কর্তব্য, তা তাঁদের দায়িত্ব নয়। আর প্রশাসনও বরাবরই ভক্তিভরে এই সমস্ত ধর্মপ্রাণ মানুষকে ‘সেবা’ করে চলেছে।
ইন্দ্রনীল ঘোষ, লিলুয়া, হাওড়া
পরিকাঠামো চাই
শ্রাবণ মাসে প্রতি বছর পশ্চিমবঙ্গের বাবুঘাট এলাকায় বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা-সহ পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলি থেকে হাজার হাজার মানুষ আসেন গঙ্গাস্নান এবং রাজ্যের বিভিন্ন তীর্থস্থানে যাওয়ার উদ্দেশে। বাবুঘাট তাঁদের এই যাত্রার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এত সংখ্যক মানুষের চাহিদার উপযুক্ত পরিকাঠামো বাবুঘাটে নেই। এখানে শৌচালয়, পানীয় জলের সুব্যবস্থা, অস্থায়ী স্বাস্থ্য শিবির বা বিশ্রামের জায়গা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্ম ও স্নানাদির জন্য বিশেষ আবরণ না থাকায় নানা ধরনের দূষণ ঘটছে, মানুষের মর্যাদা লঙ্ঘিত হচ্ছে। সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ, এই সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানের জন্য যেন অবিলম্বে উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হয়। এই পত্রের মাধ্যমে বিষয়টিতে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে, এই আশা করছি।
স্বাগতম সাহা, কলকাতা-৬৭
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)