Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: মৃত্যু রহস্যময়

মৃত্যুর শোক সবার সমান নয়। কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে। জীবনবোধও এক-এক জনের এক-এক রকম।

শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২১ ০৮:০৯

মৃত্যুর কোনও স্বাধীনতা নেই (‘মৃত্যুশোকের ওপারে’ ২৮-১১)। শোকের ওপারে থাকে সুমহান শ্লোক, যা নির্গত হয় আদি কবির মুখ থেকে। শোক থেকে উত্তরিত হয়ে কবি শেলি লেখেন ‘অ্যাডোনিস’, টেনিসন লেখেন ‘ইন মেমোরিয়াম’, অতুলপ্রসাদ-নজরুলের যন্ত্রণা থেকে নির্ঝরিত হয় গীতিকবিতার মূর্ছনা। জীবনের বিস্তারিত রূপই তো মৃত্যু। সেই রূপ অভিজ্ঞতার আর উপলব্ধির। একের জন্য অন্যের দ্বারস্থ হওয়ার দরকার নেই। অভিজ্ঞতার মুখাপেক্ষী হলেই কষ্ট বাড়ে। কষ্ট করে নিস্পৃহ থাকার কথা বলে গিয়েছেন মহামানবরা। মর্তে এসেছি, মরতে এসেছি। ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে উঠি। কেউ চলে গেলে বলি, ‘আত্মা শান্তি পাক’। ধরেই নিই, পৃথিবীতে যত দিন শরীর ছিল বিশ্রামও ছিল না, শান্তিও ছিল না। যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় বাজি রেখেছিলেন পরিজন, স্বভূমি, এমনকি নিজেকেও। তিনি ভুল করেছিলেন? আসলে কিছুই তো কারও নয়। তিনি নিজেও তাঁর নন। এটাই প্রকৃত উপলব্ধি। সেই তিনি বকরূপী ধর্মকে জানাচ্ছেন, মানুষ চিরকাল থাকবে না জেনেও এমন আচরণ করে, যেন চিরকাল এখানে থাকতে এসেছে।

মৃত্যুর শোক সবার সমান নয়। কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে। জীবনবোধও এক-এক জনের এক-এক রকম। মানুষ স্বভাবত একা। শিশুরা বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলোয় মেতে থাকে। তরুণরা হুল্লোড়, আড্ডায় মশগুল। তার পর বিয়ে-প্রেম-সংসার-সমাজ, ধর্ম-সঙ্ঘ অন্যের কাছে নিজের অস্তিত্বের প্রকাশকে নানা ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া। এক সময়ে নিজের মধ্যে একটু একটু করে নিজেকে খুঁজতে থাকা। এ কালের ডরিস লেসিং আবার বলেছেন অন্য ভাবে। মৃত্যু আর ভয়, এই দুই-ই প্রধান। আমরা যা করি, সবই এই দুইয়ের তাড়নায়। আমাদের বেঁচে থাকা এই দুইয়ের থেকে দূরে থাকতে এক সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া। মৃত্যু চরম দুর্জ্ঞেয়, রহস্যময়। যুগে যুগে গবেষণার বিষয়।

রঘুনাথ প্রামাণিক, কালীনগর, হাওড়া

হৃদয়ের পথে

সুমিত চক্রবর্তীর প্রবন্ধ ‘মৃত্যুশোকের ওপারে’ মন-কেমনের দুয়ারে জোর নাড়া দিল। প্রবল এক মানসিক কষ্ট অনুভব করলাম। আবারও রবীন্দ্রপাঠে নিমগ্ন হতে বাধ্য করল অশান্ত মন। “এ জগতে অবিশ্রাম জীবনের প্রবাহ মৃত্যুকে হুহু করিয়া ভাসাইয়া লইয়া যায়, মৃত কোথাও টিঁকিয়া থাকিতে পারে না।...পৃথিবী মৃত্যুকেও কোলে করিয়া লয়, জীবনকেও কোলে করিয়া রাখে। পৃথিবীর কোলে উভয়েই ভাই-বোনের মত খেলা করে।...পৃথিবীতে যাহা আসে তাহাই যায়। এই প্রবাহেই জগতের স্বাস্থ্যরক্ষা হয়। কণামাত্রের যাতায়াত বন্ধ হইলে জগতের সামঞ্জস্য ভঙ্গ হয়। জীবন যেমন আসে জীবন তেমনি যায়। মৃত্যুও যেমন আসে মৃত্যুও তেমনি যায়। তাহাকে ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা কর কেন?...ছাড়িয়া দাও, তাহাকে যাইতে দাও; জীবনমৃত্যুর প্রবাহ রোধ করিয়ো না। হৃদয়ের দুই দ্বারই সমান খুলিয়া রাখো। প্রবেশের দ্বার দিয়া সকলে প্রবেশ করুক, প্রস্থানের দ্বার দিয়া সকলে প্রস্থান করিবে” (‘রুদ্ধ গৃহ’)।

মৃত্যুশোক রবীন্দ্র অনুভবে অনেক গভীর, বিস্তৃত। তাঁর মতো ভাবনায় জন্ম-মৃত্যুর আগমন-নির্গমন আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে অকল্পনীয়। আমরা সুখে অভিভূত হই। দুঃখে কেঁদে ভাসাই। প্রিয়জনের মৃত্যুশোক, বিচ্ছেদ-বেদনা, বিরহব্যথা বহন করে চিরকাল কেবলমাত্র তার একান্ত নিকটজন। “মৃতেরা এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনও।/ মৃতেরা কোথাও নেই; আছে?/কোনো কোনো অঘ্রাণের পথে পায়চারি-করা শান্ত মানুষের/ হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতেরা কোথাও নেই বলে মনে হয়;” (‘১৯৪৬-৪৭’, জীবনানন্দ দাশ)।...মৃত মানুষের স্মৃতির-ঝাঁপি খুলে তার সঙ্গলাভ একান্ত ব্যক্তিগত-যাপন। অতীত কিছু সুখস্মৃতি-সান্নিধ্য, যতই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হোক সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো আসা-যাওয়া করে। হারিয়ে যাওয়া মানুষের অস্তিত্ব তার ব্যবহৃত জিনিসপত্রের স্পর্শে অনুভূত হয়। হোক তা তুচ্ছাতিতুচ্ছ। যেমনটি উল্লেখ করেছেন প্রাবন্ধিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ়ের পুত্র তাঁর বাবা-মায়ের ব্যক্তিগত, ‘অদ্ভুত চারণ’কথা।...বাবাকে মনে পড়ে ছেলের স্নানের পর তোয়ালে দিয়ে পিঠ মোছার সময়ে, মাকে অলিভ অয়েল ব্যবহারের কালে...। এই একান্ত স্মৃতিচারণ সযত্নে রক্ষিত আছে আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবনে।...স্নানান্তে শীতের রোদে উঠোনে বা বারান্দায় বসে মা ভেজা চুল শুকোচ্ছেন, বৃদ্ধ বাবা আরামকেদারায় বসে কাগজ পড়ছেন বা লাঠি ঠুক ঠুক করে শীত-বিকেলে গায়ে শাল জড়িয়ে হাঁটছেন...।

আর যে সব অগণন প্রাণ আমাদের ছেড়ে চলে গেল অতিমারিকালে, তাদের মৃত্যুর জন্য কি মন প্রস্তুতি নিয়েছিল? তাদের চলে যাওয়া ছিল অকল্পনীয়। তাই শোকের তীব্রতায় ‘আমাদের চেতনার অন্তরঙ্গে কড়া নাড়ে প্রিয় মানুষের বিচ্ছেদ’। আমরা বিহ্বল হয়ে পড়ি। স্মৃতির সঙ্গে বসবাস শুরু হয় তখন। আত্মজনদের শোকজ্ঞাপনের পালা শেষে শুরু হয় নিভৃতে, একাকী শোক-যাপন। কিন্তু, তিষ্ঠোতে দেয় না কেউ। একে একে জমতে থাকে শোকবার্তা, শোকের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার অবিরাম প্রচেষ্টা চলে। চলতেই থাকে।

মনের ভিতরে চলে নিরন্তর লড়াই। কখন সময় হবে একটু একা থাকার? একা কাঁদার? একা একা তাহার সঙ্গে মনে মনে আলাপচারিতার? ‘কত কথা ছিল তারে বলিতে...’ হল না বলা। মনের সঙ্গে এই আসঙ্গলিপ্সা চলে নিরন্তর। তার পর সময় হয় নিজের সঙ্গে বসার।

নিঃস্ব করে দেওয়া অতিমারির কাছে এইটুকুই শিক্ষণীয় এখন। পুনরায় মৃত্যুরূপী কালান্তক যমের সম্মুখীন হওয়ার পূর্বে আবার ‘তীব্র ভাবে বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করে নিতে হবে নিজের ভিতর থেকেই’— উপসংহারে বলেছেন প্রবন্ধকার। এ-ও সম্ভবত মৃত্যুশোকের ওপারে এক হাহাকার।

ধ্রুবজ্যোতি বাগচি, কলকাতা-১২৫

শোকের সংবাদ

সম্প্রতি আমাদের পাশের পাড়ার একটি ছেলে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। অল্পবয়সি, মিতভাষী এবং লাজুক প্রকৃতির ছেলেটির সঙ্গে পরিচিতির সুবাদে কয়েক বার কথাও হয়েছে।

মৃত্যুর কিছু সময় আগে একটি ভিডিয়ো সে ফেসবুকে পোস্ট করে, যেখানে কালীপুজোর আলোময় রাস্তায় গাড়িটি ছুটে চলেছে এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে একটি সুরেলা কণ্ঠে গান বেজে চলেছে। মৃত্যুর খবরটি একটু ছড়িয়ে পড়তেই কিছু মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার পোস্টে। কেউ ‘আরআইপি’ লিখে কান্নার ইমোজি জুড়ে দিচ্ছেন, কেউ লিখছেন, ‘ভাই কোথায় চলে গেলি’, কেউ জুড়ছেন— যেখানেই থাক ভাল থাক। এখানেই বিরতি নয়, তার মৃত্যুর খবর পাওয়ামাত্র সেই রাতেই কিছু মানুষ সমাজমাধ্যম থেকে তার পুরনো ছবি ডাউনলোড করে নিয়ে সেই ছবি পোস্ট করে তার মা-বাবা ও পরিবার-পরিজনদের প্রতি সমবেদনা জানাতে তৎপর হয়ে উঠেছেন।

তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, এমন একটা সংবাদ হঠাৎই সব ওলটপালট করে দেয়, সব কিছুর ছন্দপতন ঘটায়। এই আকস্মিক, অনভিপ্রেত খবরগুলো পরিবার-পরিজনদের কাছে একটু সচেতন ভাবে, মার্জিত রূপে পৌঁছনো এক জন সচেতন নাগরিকের অন্যতম কর্তব্য। তার পরিবারে হয়তো এমন কোনও ব্যক্তি থাকেন, যিনি জটিল কোনও অসুখে ভুগছেন, বা এমন কোনও পরিস্থিতিতে আছেন, যখন সোজাসাপ্টা কোনও মর্মান্তিক খবর এতটাই আঘাত দেয়, যার ফলে তাঁদের জীবনযাত্রা আরও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

রাতারাতি এই ভাবে এখন সমাজমাধ্যমে অসতর্ক ভাবে পোস্ট করার হিড়িক শুরু হয়েছে। সমাজমাধ্যম আমাদের হাতে যে অবাধ স্বাধীনতার চাবিকাঠি দিয়েছে, তার প্রয়োগ নিতান্তই মূর্খের মতো হয়ে চলেছে। সমবেদনা জানানোর উৎসাহ দেখে মনে হয়, যে নিজের সন্তান, ভাই বা বোন হারাল, তার সমান বেদনা সত্যিই কি কেউ অনুভব করতে পারে!

অমিতাভ চক্রবর্তী, ইমেল মারফত

Death
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy