‘বাঙালির মন জিততে হলে’ (৯-১০) শীর্ষক প্রবন্ধে প্রেমাংশু চৌধুরী আসন্ন রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের জন্য বঙ্গে মুখ্যত তাদের দলীয় সংগঠন বিস্তারের যে পরিকল্পনার কথা বলেছেন, তা রাজ্য রাজনীতির ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক। প্রবন্ধকারের প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করেও এই কথা বলা যেতে পারে, বঙ্গ রাজনীতিতে বিজেপির সাফল্য বা বিধানসভা দখল কিন্তু রাজ্য ও বাংলাভাষীদের জন্য আগামী দিনে খুব একটা সুখকর না-ও হতে পারে। কারণ সামগ্রিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সমস্ত রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে জয়লাভের জন্য পরিকল্পনা করে, কিন্তু বিজেপির সমস্ত পরিকল্পনা সব সময়ই সুদূরপ্রসারী। যেমন ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ চালু করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার, এর আসল উদ্দেশ্য কিন্তু নিজেদের ক্ষমতা কায়েম রেখে দেশ থেকে সমস্ত আঞ্চলিক দলকে উৎখাত করার এক দীর্ঘ পরিকল্পনা, যা রাজ্য রাজনীতির পক্ষে এবং সাধারণ মানুষের পক্ষেও খুবই ভয়ঙ্কর। তেমনই এখনও তাঁরা দাবি না করলেও, তাঁদের বিভিন্ন কার্যকলাপে এবং নেতা-নেত্রীদের বক্তব্যে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, তাঁদের মূল লক্ষ্য, ‘এক দেশ, এক ধর্ম’। এর ব্যাপকতাও এত বিশাল যে, শুধুমাত্র হিন্দু ধর্ম নয়, হিন্দুত্বের বিভাজন ঘটিয়ে সারা ভারতে উত্তর ভারতের ধর্মীয় সংস্কৃতি ও আচার-আচরণ কায়েম করা। যার মূল উদ্দেশ্য, সমস্ত পুজো ও ধর্মীয় আচরণেই আমিষ বর্জন করা, যা কিন্তু বাঙালির সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিরোধী।
অপর দিকে, ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ ও বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে, প্রতিটি শাসক দলের যে ভাবে ধর্মের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলা উচিত, সেই কাজটুকু করতে রাজ্যের বর্তমান শাসক দল ব্যর্থই বলা যেতে পারে। তবে চিত্তরঞ্জন পার্কে যতই প্রধানমন্ত্রী দুর্গাপুজো দেখতে যান, তাঁর পক্ষে কখনওই সম্ভব নয় বাঙালি সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আচারের সঙ্গে একাত্ম হওয়া। কারণ বাঙালির কাছে দুর্গাপুজো বিভাজনের নয়, বরং সকলকে একসূত্রে গাঁথার। বিজেপির বঙ্গের নেতা-নেত্রীরাও দলের শীর্ষ নেতৃত্বের পরিকল্পনায় চলেন, ফলে বাংলাভাষীদের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণের প্রত্যক্ষ বিরোধী নন, বাঙালি মননে তা যথেষ্ট বিরূপ প্রভাব ফেলে। একই কথা প্রযোজ্য, পুজোয় অনুদান দিয়ে রাজ্য শাসক দলের বাঙালিকে কাছে টানার প্রচেষ্টা বিষয়ে, যা গরিব প্রান্তিক মানুষের মনে কোনও প্রভাব ফেলে না।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
কৌশলের লড়াই
প্রেমাংশু চৌধুরীর লেখা ‘বাঙালির মন জিততে হলে’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। এত দিন বিজেপি নানা ভাবে নির্বাচনে জেতার চেষ্টা করলেও বিগত বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনগুলোতে আশানুরূপ ফল লাভে ব্যর্থ হয়েছে। সাংগঠনিক দুর্বলতা এর অন্যতম প্রধান কারণ।
বেশ বোঝা যাচ্ছে, বুথ স্তরের সংগঠন গড়ে ভোট যুদ্ধে তৃণমূলকে পরাস্ত করা বিজেপির পক্ষে অনেকটাই কঠিন। সম্ভবত তাই, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ধর্মীয় মেরুকরণের তাস ব্যবহারের উপরেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভোট বৈতরণি পার হওয়ার চিন্তা-ভাবনা করে চলেছে। এতে যে ফল খুব একটা খারাপ কিছু হয়েছে, তা কিন্তু নয়, বরং বুথ স্তরের সংগঠন গড়ায় দক্ষ বামেদের পিছনে ফেলে অনেকটাই এগিয়ে যাওয়া বিজেপির পক্ষে সম্ভব হয়েছে। আর ভোটযুদ্ধে বামেরা যত পিছিয়ে পড়েছে, ততই এগিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়েছে বিজেপির। মানুষের মনে ধর্মীয় আবেগের আগুন তীব্র হলে বামপন্থী দলগুলো যে কোণঠাসা হয়ে পড়ে, এই সত্য এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ধর্মীয় আবেগের কাছে মতাদর্শগত লড়াই দুর্বল হয়ে, জনগণের ভরসার জায়গাটা কমে আসে। হয়তো এই কারণেই ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির উত্থানের পথ সহজ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বামেরা ক্ষমতায় থাকাকালীন লোকসভায় ও বিধানসভা নির্বাচনে খাতা খোলার তেমন সুযোগ না পেলেও, বিজেপি এখন বাম শক্তিকে পিছনে ফেলে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। এই এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করতে ধর্মীয় মেরুকরণের একটা প্রভাব যে রয়েছে, তা অস্বীকার করা যায় কি? সম্ভবত এটাই প্রধানমন্ত্রীর নজরে এসেছে। তাই তিনি এতটুকু সময় নষ্ট না করে, এ বছর দুর্গাপুজোয় দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে সশরীরে উপস্থিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালিদের মন জয়ে সচেষ্ট হয়েছেন। যদিও এই জনমন জয়ের দৌড়ে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুজো অনুদান বৃদ্ধি, বিদ্যুতের বিলে ছাড় ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা অনেকটা বাড়িয়ে কয়েক শত যোজন এগিয়ে থাকতে চেয়েছেন। বাঙালির সাংস্কৃতিক উৎসব দুর্গাপুজোকে কেন্দ্রে রেখে তৃণমূল ও বিজেপি যে ভাবে বাঙালির মন জয় করতে চেয়েছে, তা এক কথায় নজিরবিহীন। তবে কে কতটা সফল হল, তা জানতে ভোটের ফলাফল ঘোষণা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকা ছাড়া উপায় নেই।
এখন ভোটাররা কোন কোন বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে ভোট দেবেন, সেটা রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্ব নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান অনুযায়ী নির্ধারণ করে দিতে সচেষ্ট হচ্ছেন। ফলে এক দিকে তৃণমূল দল যেমন বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের যে রকম হেনস্থা হয়েছে, সেই তথ্য তুলে ধরে বিজেপির গায়ে ‘বাঙালি বিদ্বেষী’ তকমা সেঁটে দিয়ে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চাইছে, বিজেপি দলও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের কথা তুলে ভোটারদের সমর্থন নিজপক্ষে টানতে চাইছে। এমন দাবিও উঠেছে, ঠিক ভাবে এনআরসি হলে নাকি প্রায় এক কোটি অনুপ্রবেশকারীর নাম সরাসরি ভোটার তালিকা থেকে বাদ চলে যাবে। আর তাতে তৃণমূল দল অনেকটাই হীনবল হয়ে নির্বাচনী দৌড়ে পিছিয়ে পড়বে। অনুমাননির্ভর এই সব তথ্যের বাস্তব ভিত্তি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতরে গবেষণার অন্ত নেই। তবে চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় অনুপ্রবেশকারীদের নাম ঢুকে থাকুক, তা কোনও রাজনৈতিক দল না চাইলেও বিজেপি এখন এই বিষয়টিকেই নির্বাচনী প্রচারের বর্শা-মুখে বসিয়েছে। ফলে এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে কোন দলের আস্তিনের তলায় লুকোনো কৌশল যে বড় হয়ে উঠবে, আগে থেকে কে বলতে পারে?
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
উপযুক্ত কি?
প্রেমাংশু চৌধুরীর উত্তর-সম্পাদকীয় ‘বাঙালির মন জিততে হলে’ বিষয়ে কিছু কথা। বিরোধী দলের সংগঠন এই রাজ্যে কতখানি দুর্বল অথবা সবল, তার থেকেও বড় জিজ্ঞাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সাধারণ মানুষের স্বার্থে এরা কতখানি উপযোগী হয়ে উঠবে।
আমিষ খাদ্যের বিরুদ্ধে জেহাদ, পেশি শক্তির উন্মাদনা— এ সবে কাজের কাজ কিছু হয় না। এ ছাড়া, কথায় কথায় মুনি-ঋষি, মহাপুরুষ, দেবদেবী টেনে এনে নিজেদের অযোগ্যতা কিংবা দোষ ঢাকা দেওয়ার প্রয়াস বড়ই অপ্রীতিকর। প্রয়োজন সঙ্কীর্ণতাবিহীন রাজনীতি, যা মানুষের প্রকৃত কল্যাণ সাধনে সমর্থ।
বাবুলাল দাস, ইছাপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
সেই তিমিরে
‘বাঙালির মন জিততে হলে’ প্রবন্ধটি প্রসঙ্গে বলি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যতই দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের পুজোয় যান, সমস্ত বাঙালির মন তিনি জয় করতে পারবেন, এই ভাবনাটাই কষ্টকল্পনা। কারণ, বিজেপির শীর্ষ নেতারা বাংলার অগ্রগতির জন্য অমূল্য সময় ব্যয় করতে প্রস্তুতই নন।
লেখক মনে করিয়েছেন, তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষকে পুঁজি করা জরুরি। কিন্তু সেই পুঁজি একত্র করতে গেলে চাই নিজস্ব ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা। সেটা কি হচ্ছে? না বিষয়টা ঠিক উল্টো?
অরুণ গুপ্ত, কলকাতা-৮৪
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)