E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: আর্থিক অন্তর্ভুক্তি

আজ থেকে বহু বছর পূর্বে এলা ভট্ট দেখিয়ে দিয়েছিলেন, ইচ্ছা থাকলে এবং সংবেদনশীল মন থাকলে মানুষের জন্য অনেক কিছুই করা সম্ভব। তিনি মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন।

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:৪২

মৌমিতা চক্রবর্তীর প্রবন্ধ ‘অদৃশ্য শ্রমিককে দৃশ্যমান করা’ (১২-১১) প্রসঙ্গে কিছু কথা। ঠিকই যে, এলা ভট্ট (ছবিতে) ১৯৭২ সালে আমদাবাদ শহরে ‘সেল্ফ এমপ্লয়েড উইমেন’স অ্যাসোসিয়েশন’ (সংক্ষেপে, সেবা) গঠন করেছিলেন, এবং এটি গঠিত হয়েছিল একটি শ্রমিক সংগঠন হিসাবে। এই সংগঠনের সদস্যরা ছিলেন আর্থিক দিক থেকে একেবারে নিচু স্তরের মহিলাকর্মী এবং স্ব-রোজগেরে। যেমন— পরিচারিকা, শ্রমিক, হকার, আনাজ বিক্রেতা এবং এই ধরনের পেশায় কর্মরত অসংখ্য মহিলা।

কিন্তু তিনি শুধুমাত্র শ্রমিক সংগঠন তৈরি করে এবং এক জন আইনজীবী হিসাবে সংগঠনের সদস্যদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেননি। এই মহিলাদের আর্থিক দুর্গতি নিরসন করতে ১৯৭৪ সালে আমদাবাদ শহরে তিনি সেবা সমবায় ব্যাঙ্ক গঠন করেন। তিনি লক্ষ করেন যে, সেবা-র সদস্যরা আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে মহাজন বা পাইকারদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে ঋণের সুদ দাঁড়াচ্ছে দৈনিক ১০ শতাংশ। যেমন কোনও আনাজ বিক্রেতা সকালবেলা পাইকারদের কাছ থেকে ১০০ টাকা ঋণ নিলে দিনের শেষে তাঁকে ১১০ টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করতে হচ্ছে। কোনও জামানত বা জামিন ছাড়াই সেবা সমবায় ব্যাঙ্ক ঋণ দেওয়ার কাজ শুরু করে এবং মাত্র সাত দিনের মধ্যে ঋণ মঞ্জুর করা হয়। এর পরিচালনার দায়িত্বে গরিব মহিলা সদস্যরাই রয়েছেন। গরিব মহিলাদের ঋণ দিয়ে তাঁদের আত্মনির্ভর হতে সহায়তা করে চলেছে এই সমবায় ব্যাঙ্ক। এটি আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে গরিব মানুষের আর্থিক প্রগতির অনন্য উদাহরণ।

বর্তমানে মুদ্রা যোজনা-সহ নানা ধরনের যোজনা গড়ে উঠেছে, যেখানে ব্যাঙ্ক থেকে জামিন ছাড়া সহজেই ক্ষুদ্র উদ্যোগীদের ঋণ দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ভুক্তভোগীমাত্রেই জানেন বিষয়টা অত সহজ নয়। ঋণ পেতে যথেষ্ট কাঠ-খড় পোড়াতে হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে সফল হওয়া যায় না। আসলে আধিকারিকদের মধ্যে সংবেদনশীলতার অভাব প্রকট। কিন্তু আজ থেকে বহু বছর পূর্বে এলা ভট্ট দেখিয়ে দিয়েছিলেন, ইচ্ছা থাকলে এবং সংবেদনশীল মন থাকলে মানুষের জন্য অনেক কিছুই করা সম্ভব। তিনি মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন।

তিনি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্রের নারী-শ্রমিকদের জন্য তাঁর কাজ সারা পৃথিবী দীর্ঘ দিন মনে রাখবে।

তপন কুমার ভট্টাচার্য, ওলাইচণ্ডীতলা, হুগলি

অসুরক্ষিত

মৌমিতা চক্রবর্তীর ‘অদৃশ্য শ্রমিককে দৃশ্যমান করা’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে অসংগঠিত শ্রমিক দিবস-এর স্বীকৃতি ও নেপথ্যে এলা ভট্টের ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। লড়াই শুরু হয়েছিল সত্তরের দশকে। এখন ২০২৫। মাঝের ৫৫ বছরে দুই দফায় শ্রমের চরিত্র বড় মাপে বদলেছে। প্রথম দফায় নব্বইয়ের দশকে উদারীকরণ-বেসরকারিকরণ-বিশ্বায়নের ফলে শ্রম আইন অনেক শিথিল হয়ে শ্রমিকের বিপক্ষে গিয়েছে। সত্তরের দশক থেকে শক্তিশালী সংগঠিত ক্ষেত্র নিজেদের সঙ্গে অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকারের জন্য লড়াই করছিল, যা নিজেই দুর্বল হতে লাগল। একই সঙ্গে রাজনৈতিক পরিবর্তনটিও বিবেচনা করতে হবে। অভিজ্ঞতা থেকে একটি উদাহরণ দিই। ভারতে ১৯৬৯ এবং ১৯৮০ সালে মোট দু’দফায় ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ হয়। পাশাপাশি অন্য নানা ক্ষেত্রে জাতীয়করণের সঙ্গে সংগঠিত শ্রমিকের বিকাশ হচ্ছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে অন্যতম শক্তিশালী সংগঠিত ব্যাঙ্ক শিল্পে কম্পিউটার চালু করার ফলে স্থায়ী কর্মী ‘অদৃশ্য’ হতে থাকে। স্থায়ী কর্মীর কাজ কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে স্বীকৃত সংগঠিত শ্রমিক সংগঠনের আন্দোলন সেই থেকে শুরু। আমরা গালমন্দ খেয়েছিলাম— সেই তো কম্পিউটার ব্যবহার করতে হল। হ্যাঁ, প্রতিবাদ করে, স্থায়ী কর্মীর কাজ বজায় রেখে সম্মানজনক স্বীকৃতি আদায় করেছিলাম। আমাদের লড়াই কম্পিউটারের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল যথেচ্ছ ভাবে কম্পিউটারাইজ়েশন-এর বিরুদ্ধে। নব্বইয়ের দশক থেকে সংগঠিত-অসংগঠিত সব শিল্পে কম্পিউটারাইজ়েশন হতে শুরু হল। আজ সেই সব শিল্পে স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মীদের শ্রমসম্পর্কে চূড়ান্ত অস্থিরতা, অর্জিত অধিকার হারিয়ে দুরবস্থা এবং বেকারত্বের চরম বৃদ্ধি প্রমাণ করে কেন তখন ভারতের মতো শ্রমনিবিড় দেশে আমাদের আন্দোলন ন্যায্য ছিল।

দ্বিতীয় দফায় কোভিড-উত্তর বিশ্বে শুরু হল কৃত্রিম মেধা বা এআই-এর প্রয়োগ। এত দিন কায়িক শ্রমের জায়গা নিচ্ছিল কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি। এ বার মেধা শ্রমের জায়গা নিতে আরম্ভ করল এআই। বিশ্বে বড় বড় সংগঠিত শিল্পে এখন এআই বিকাশে কর্পোরেট পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে, যা ব্যাপক হারে শ্রমিক ছাঁটাই করছে, শ্রমিকের অধিকার সঙ্কুচিত করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে চারটি শ্রম কোড সমন্বিত আইন ও বিল (২০১৯-২০) পাশ হয়েছে। সরকার চাইল ভারতের শ্রম আইনকে আধুনিক ও সরল করতে। ঘোষিত লক্ষ্য শ্রমিক-নিয়োগকর্তা সম্পর্ক, মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশকে একই কাঠামোয় নিয়ে আসা। আসল লক্ষ্য, মালিকের ক্ষমতা বাড়িয়ে শ্রমিকের ক্ষমতা কমানো। গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে সরকারে রাজনৈতিক শাসন করছে লগ্নি পুঁজির সাঙাততন্ত্র। তাদের সম্পদ বাড়ছে। অপর দিকে বামপন্থী শক্তি দুর্বল হচ্ছে, শ্রমিকের সম্পদ সংগঠনশক্তি আরও দুর্বল হচ্ছে। অসংগঠিত শ্রমিকের দুর্দশা বাড়ছে।

কর্মক্ষেত্রে স্থায়ী শ্রমিকের নিয়মিত বেতন, সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য-সুবিধা, পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, বিমা— এ ধরনের সুরক্ষা থাকছে না। অসংগঠিত ক্ষেত্রে সাধারণত মৌখিক চুক্তি, যেখানে কিছুই স্থায়ী নয়। মজুরি ও বেতন মালিকের ইচ্ছানির্ভর। এ ভাবে কায়িক ও মেধা শ্রমিক অদৃশ্য হয়ে চলেছে। ভারসাম্য হারাচ্ছে সমাজবৃত্ত।

শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি

কুযুক্তি

জয়ন্ত বসুর “ধোঁকা‘বাজি’র উৎসব” (২০-১০) প্রবন্ধটি পড়ে মনে হল, কালিদাসের মতো আমরা যে গাছে বসে আছি সেই ডালই কেটে চলেছি। কর্মসূত্রে দিল্লিতে থাকার কারণে এ বছর দিল্লি ও সন্নিহিত এলাকায় বাজি বিক্রি ও ব্যবহারে আদালত ও প্রশাসন কিছুটা শিথিলতা প্রদান করায় এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে জয়োল্লাস লক্ষ করেছি। তাঁদের যুক্তি— বাজি নিয়ে নিষেধাজ্ঞা কেবলমাত্র ‘তাঁদের’ উৎসবের সময়েই করা হয়ে থাকে, অন্য সম্প্রদায়ের উৎসবের ক্ষেত্রে তা কখনও করা হয় না। দ্বিতীয় যুক্তি হল, সারা বছরই বায়ুতে দূষণের মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে অনেক উপরে থাকে। এর তিনটি প্রধান কারণ হল— পেট্রল/ডিজ়েলচালিত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি, নাড়া পোড়ানো এবং বহুতল নির্মাণের কাজ। সুতরাং বাকিগুলোর ক্ষেত্রে ব্যবস্থা না করে কেবল বাজির উপর নিষেধাজ্ঞা অযৌক্তিক। কালীপুজোর দিন আমি দিল্লির রাস্তায় ছিলাম রাত আটটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। রাত যত বেড়েছে শব্দ ও আলোর প্রাবল্য ততই বেড়েছে, বিশেষত আবাসন এলাকাগুলিতে। দিল্লিতে কালীপুজোর রাতে বায়ুদূষণের সূচক পৌঁছে গিয়েছিল ৩৪৫-এ। এমনকি দু’দিন পরেও তা ছিল ৩৫৩। এই দূষণে সমস্যায় পড়েন সকল শ্রেণি ও বয়সের মানুষ। সুতরাং সম্প্রদায়গত ভেদাভেদ ও ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের সকলকেই সদর্থক ভূমিকা নিতে হবে বায়ুদূষণ কমাতে।

প্রশান্ত দাস, খলিসানি, হুগলি

মেরুকরণ

সম্পাদকীয় ‘নিরামিষ-নীতি’ (১৫-১১) খুবই প্রাসঙ্গিক। আরএসএস ও বিজেপি এই নিয়ে হিন্দুত্বের মধ্যেও বিভাজন ঘটাতে সচেষ্ট হয়েছে। ধর্মীয় মেরুকরণ নিয়ে সমগ্র দেশে কী ভাবে বিষ ছড়ানো হচ্ছে, তা আজ কারও অজানা নয়। কোনও ধর্মীয় গুরু বা বিরোধী নেতৃত্বের পরিসংখ্যান নয়, আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবতই তথ্য দিয়েছেন, হিন্দু সমাজের ৭২ শতাংশ মানুষ মাংস খান। প্রশ্ন করা যেতে পারে, তবে ধর্মের অছিলায় কেন বাকি ২৮ শতাংশ হিন্দুর খাদ্যাভ্যাসে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে? এই বিপজ্জনক খেলার বিরুদ্ধে বিভেদ ভুলে সব বিরোধী দলকে প্রতিবাদের রাস্তায় নামতে হবে।

অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Labours Workers

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy