১৯৭৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারির পরিপ্রেক্ষিতে সেমন্তী ঘোষের “সংবিধান ‘হত্যা’ না করেই” (২৫-৬) শীর্ষক প্রবন্ধটি বর্তমানে খুবই প্রাসঙ্গিক। ভারতীয় সংবিধান যে ভারতীয় নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মুক্তির শেষ কথা নয়, সেই নিয়ে যথার্থ প্রশ্ন তুলেছেন প্রবন্ধকার। জরুরি অবস্থাজনিত কারণে যে ধরনের অত্যাচার নেমে এসেছিল মূলত বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বিরুদ্ধমত প্রকাশ করা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে, তা কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়। এও ঠিক যে, দেশের সংবিধানে শাসকের জরুরি অবস্থা জারির পূর্ণ ক্ষমতা আছে এবং সেই কারণেই কোনও মতেই তা সংবিধান অবমাননা নয়। সেই সময়ে জরুরি অবস্থার দায় সম্পূর্ণত কংগ্রেসকেই নিতে হবে। আসলে, রাজনীতিবিদরা গণতন্ত্র নিয়ে যতই গলা ফাটান, তাঁরা একটা বিষয় ভুলে যান, গণতন্ত্রের প্রকৃত ধারক ও বাহক কিন্তু সাধারণ জনগণই। ঠিক সেই কারণেই ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার অপব্যবহারের জবাব কংগ্রেস পেয়েছিল জনতার রায়ে ১৯৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়ে। সাধারণ মানুষ যে কোনও সরকারের কাছেই আশা করে, রাজ্য ও দেশকে তারা এগিয়ে নিয়ে যাবে সামনের দিকে। অথচ সেটা বেশিরভাগ সময়ই ভুলে গিয়ে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির আশ্রয় নিয়ে নিজেদের অনৈতিক কার্যকলাপ ঢাকার জন্য তারা অতীতকে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরে। ঠিক যেমন বাঘ ও মেষশাবকের গল্পে মেষশাবকের বাবার জল ঘোলা করার মিথ্যা বদনাম দিয়ে বাঘ যেমন মেষশাবককে হত্যা করেছিল, প্রায় সেই কায়দায়। কখনও ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারির জন্য তাঁর নাতি রাহুল গান্ধীকে অভিযুক্ত করায়, আবার আর জি কর কাণ্ড ও সম্প্রতি বিধানসভা উপনির্বাচনের বিজয় মিছিল থেকে ছোড়া বোমার আঘাতে বালিকার মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর সিপিএমের যুবনেত্রী দীপ্সিতা ধরকে বামফ্রন্ট জমানার বিভিন্ন খুনখারাপির কথা স্মরণ করিয়ে দৃষ্টিকটু ভাবে আক্রমণ করার মধ্যে সেই একই ঐতিহ্যের চিহ্ন।
বর্তমানে কেন্দ্রের অনৈতিকতার সমালোচক সাংবাদিকদের জেলে পোরা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নানা ভাবে হেনস্থা করা, কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করলেই দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা প্রভৃতি স্বৈরাচারও ঘোষিত জরুরি অবস্থার থেকে কোনও অংশেই কম নয়। আবার রাজ্য শাসক দলকেও বিরোধী কণ্ঠস্বরের বিরুদ্ধে একই নীতির প্রয়োগ করতে দেখা যায়, যা এমনকি তীব্রতায় বাম আমলের থেকেও কয়েক গুণ এগিয়ে। সংবিধান, জরুরি অবস্থা এবং বিরুদ্ধ সমালোচকদের নিয়ে ক্ষুদ্র রাজনীতি থেকে বিরত হয়ে প্রতিটি শাসকেরই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, যা আগামী প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে ও আশার আলো দেখাতে পারে।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
লোক দেখানো
সেমন্তী ঘোষ তাঁর “সংবিধান ‘হত্যা’ না করেই” শীর্ষক প্রবন্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সত্য কথাগুলি বলিষ্ঠ ভাবে তুলে ধরেছেন। জরুরি অবস্থা বুঝিয়ে দেয় সংবিধানকে কী ভাবে পড়া উচিত। প্রশ্ন হল এই ঔচিত্যবোধের পরিচয় কে দেবে? সংবিধানই বা কে পড়বে? শাসক, না কি শাসিত? এই প্রশ্নের উত্তর হিসাবে প্রথমে জবাব আসবে, অবশ্যই শাসক। সংবিধান ছুঁয়ে তাঁরাই তো তাকে রক্ষা করার শপথ গ্রহণ করেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি শাসকের ভূমিকার বিশেষ হেরফের হয়নি। জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় শাসকের বিশেষ উদ্যোগও চোখে পড়েনি। ভোটের ইস্তাহারের সঙ্কল্প বাস্তবে প্রতিফলিত হয় না। ততটুকুই সামনে আসে, যতটুকু সামনে এলে ভোট ব্যাঙ্ক সমৃদ্ধ হবে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, দেশের অধিকাংশ জনগণ প্রায় প্রতি দিনই জরুরি অবস্থার শিকার হচ্ছেন।
শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, কর্মসংস্থানের অধিকার-সহ চাহিদাগুলি পূরণ করতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। এ দিকে বিজেপি সরকার ঘটা করে সংবিধান হত্যা দিবস পালন করছে। ভোটের বাজারে রাহুল গান্ধী সংবিধান বুকে জড়িয়ে ঘুরেছেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সংবিধান রক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বিধানসভার বহু অধিবেশনে। আদতে ভারতবাসীর সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার ভার নিতে আজ পর্যন্ত কোনও শাসক কি সত্যি সত্যি সদিচ্ছা দেখিয়েছেন? সদিচ্ছার কথা যতটুকু বলেছেন তা লোক দেখানো। যেটুকু করেছেন তা দলের উন্নতির জন্যই করেছেন। সাধারণ মানুষের কথা ভাবেননি। কারণ ভোটে জিততে সকলের সমর্থন প্রয়োজন হয় না। ভোটে জেতার কৌশল হিসাবে আসে শুধু প্রতিশ্রুতি। ভোট শেষে সব ঢাকা পড়ে যায়। দেশের সংবিধান মানলে ভোটে জেতা নিয়ে সংশয় থাকে। দলীয় সংবিধান ভোটে জেতার নিশ্চয়তা দেয়। সাধারণ জনগণ অনুন্নয়নের অন্ধকারে পড়ে থাকেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এর কারণ কী? কেউ কেউ বলবেন জনসংখ্যার চাপ। ইচ্ছে থাকলেও শাসক পেরে ওঠেন না। সত্যিই কি তাই? পাল্টা প্রশ্ন উঠবে, জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার যে সুযোগ ছিল, অথবা এখনও আছে, কোনও শাসক আজ অবধি তা গ্রহণ করলেন না কেন? উত্তর হল, দুর্নীতির ঘেরাটোপ তৈরি করে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার একান্ত প্রচেষ্টাতেই সকলের মনোযোগ। মনে রাখতে হবে, বর্তমানে শাসকের মাথাব্যথার অন্যতম কারণ সচেতন নাগরিক। শাসক চিরকাল সুকৌশলে প্রশাসন আর দলকে গুলিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। সচেতন নাগরিককে এড়িয়ে চলেন। মানুষ বঞ্চিত হন। জনগণের অধিকারকে লঘু করে দেখানো হয়।
শাসকের যুক্তি এবং বিবেচনাবোধ কি দেশের সংবিধান অনুসারী? উত্তর হল, না। তা দলীয় অনুশাসনের অধীন। তাই দেশের টাকায় মন্দির মসজিদ বানাবার প্রতিযোগিতায় নেমে যায় সরকার। দেশের সংবিধান এমন প্রতিযোগিতায় সিলমোহর দেয় না।
কিন্তু শাসক সর্বদাই প্রশাসন আর দলকে এক পাত্রে রেখে শাসন কার্য পরিচালনা করতে চান। ধর্মের ওজরে বিভেদ তৈরি করা হয়। জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে মানুষকে হেনস্থা করে শাসকের মদতপুষ্ট প্রশাসন। সংবিধান ছুঁয়ে শপথ করার পরেও দলীয় অনুশাসনের বাইরে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয় না। তাই শেষ অস্ত্র হিসাবে রাষ্ট্রপ্রধানদের মুখে উঠে আসে ধর্মের কথা। জাতি পরিচয়ের কথা। অনায়াসে বিভাজনের নীতি গৃহীত হয়। সহনাগরিক পরস্পরকে আঘাত করে। নির্মোহ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অভাব দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করে প্রতি দিন।
দীপায়ন প্রামাণিক, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা
শুভ লক্ষণ
সেমন্তী ঘোষ তাঁর “সংবিধান ‘হত্যা’ না করেই” প্রবন্ধে খুব জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন, সত্যিই কি ভারতীয় সংবিধান ভারতীয় নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মুক্তির শেষ কথা বলে? যে জরুরি অবস্থা নিয়ে এত কথা, তা তো সংবিধান অমান্য করে হয়নি। লেখক সংবিধানের নানা স্ববিরোধিতা নিয়ে গবেষকদের লেখা উল্লেখ করেছেন। গণতন্ত্রে এই সংলাপ অপরিহার্য। জনগণ সংসদে প্রতিনিধি পাঠিয়েছে মানে এই নয় যে জনগণের হাত শূন্য হয়ে গিয়েছে, তাদের আর কিছু করারই নেই। তা ছাড়া দায়িত্ব পালনে সমস্ত প্রতিনিধি যে নির্ভরযোগ্য, তা-ও নয়।
ভারত বহু ভাষাভাষী, বহু সম্প্রদায় ও জাতপাতে বিভক্ত দেশ, দারিদ্র ও নানা রকম সাংস্কৃতিক বৈপরীত্যের জটিলতায় ভরপুর। তাই এমন কোনও সংবিধান তৈরি করা অসম্ভব যেখানে সব সমস্যার নির্দিষ্ট সমাধান স্পষ্ট ভাবে লেখা থাকবে। সংবিধান সংশোধনের ব্যবস্থা সংবিধানে তাই রাখা হয়েছে। তবে সেখানেও বিপদ। গুরুত্বপূর্ণ সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব সংসদে পেশ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই পাশ করিয়ে নেওয়া যায়। তার আগে তাই এ নিয়ে গণপরিসরে আলোচনা গণতন্ত্রের পক্ষে জরুরি। বর্তমানে সমাজমাধ্যম এই আলোচনার অবকাশ দেয়, তা শাসকের দৃষ্টিতে আনাও সম্ভব করে।
দুর্গেশ কুমার পান্ডা, সোনারপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)