‘অন্য ছুটি’ (১৭-৬) সম্পাদকীয়টি একটি সময়োপযোগী রচনা। আমাদের শৈশব এবং বর্তমান শিশুদের মাঝে দুই প্রজন্মের তফাত। জীবনশৈলীতে এসেছে বিস্তর ফারাক। পাঁচ দশক আগে এখনকার মতো অণু ফ্ল্যাট-ভিত্তিক পরিবার ছিল না। সেই সময়ে অধিকাংশ পরিবারই ছিল যৌথ। বেশির ভাগেরই ছিল দুই-তিন তলার নিজস্ব বাড়ি। সেখানে থাকতেন ঠাকুরদা-ঠাকুমা, কাকা-কাকিমা, আরও অনেকে। আজকের মতো সন্তানদের বাবা-মা, দু’জনই হয় কর্মজগৎ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন না, অথবা তাঁরা কাজে বেরোলে তাঁদের সন্তানদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকতেন দাদু-দিদা এবং অন্যরা। তাঁদের সাহচর্যে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠত শিশুরা। ফলে পারিবারিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে একটা অলিখিত বন্ধন থাকত, যা ছোট থেকে অনায়াসেই শিখে যেত শিশুরা। তা ছাড়া প্রত্যেক পাড়ার একটা নিজস্ব সংস্কৃতি ছিল। বড় মাঠ থাকত, সকাল বিকেল পাড়ার ছেলেমেয়েরা সেখানে খেলাধুলা করত, গল্প করত, সময় কাটাত। সেই সঙ্গে ছিল গরমে বা পুজোর ছুটিতে মামার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার রেওয়াজ। ছোটরা মাসতুতো, মামাতো ভাইবোনদের নিয়ে এক সঙ্গে খেলা করত ছুটির ওই দিনগুলোতে।
এখন সেই রীতি আর আছে কই? পারিবারিক সম্পর্কগুলোর কথা শিশুরা শিখছে বইয়ে। বড় শহর বা শহরতলির বিভিন্ন মাঠ-ময়দান দখল করে নিচ্ছে বড় বড় অট্টালিকা। জীবনের মতো শৈশবও আটকে গিয়েছে ছোট্ট মোবাইলের স্ক্রিনে। তাই দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর এক অভিনব উদ্যোগ করেছে বিদ্যালয়গুলো। তাদের অভিভাবকদের প্রতি পরামর্শ— গরমের ছুটিতে জীবনের দ্রুতগামী ট্রেনকে খানিকটা থামিয়ে দিয়ে শিশুদের নিয়ে এক সঙ্গে বসে সিনেমা দেখা, অপরিচিত জগতের সঙ্গে পরিচয় করানো। অভিনব উদ্যোগ হলেও শিশুর মনোবিকাশ এতে কতটা হবে বা নিজেদের ব্যস্ততার মাঝে অভিভাবকরাই বা আগামী দিনে কতটা উদ্যোগী হবেন— সেই প্রশ্ন থেকেই গেল।
তারক সাহা, হিন্দমোটর, হুগলি
সঙ্গ জরুরি
‘অন্য ছুটি’ সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা। আমরা সকলেই জানি, বিদ্যালয়ে শিশু অল্প সময় থাকে। সে বেশির ভাগ সময় কাটায় অভিভাবকদের সঙ্গে। অভিভাবকেরা তাঁদের সঙ্গ ও সাহচর্য দান করে শিশুশিক্ষার কাজ করে চলেন। এটি বিদ্যালয় শিক্ষার পরিপূরক। বহু অভিভাবক এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন হলেও অনেকেরই সেই সচেতনতা নেই। আর সেটা লক্ষ করেই বেশ কিছু স্কুল ‘ছুটির কাজ’-এ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও যুক্ত করার পরিকল্পনা করেছিল। নিঃসন্দেহে এটি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ।
লেখাপড়ার পাশাপাশি আরও যে সমস্ত বিষয় শিশুশিক্ষার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে, সেগুলি সম্পর্কেও প্রত্যেক অভিভাবকেরই কিছু ধারণা থাকা দরকার। তা না থাকলে, শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ অসম্ভব। শুধু নম্বরভিত্তিক পড়াশোনায় মনোযোগী হলে শিক্ষার্থীদের জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রই অন্ধকারে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। ছোটদের সঙ্গে থাকার জন্য খানিকটা সময় বার করে নিতে পারলেই, এই কাজের ধারণাটা সহজ হয়ে যায়। বাড়ির বড়দের ভুলে গেলে চলবে না, মা-বাবার সঙ্গে রাতের শহর দেখা, দাদু-দিদার কাছে গল্প শোনা, এক সঙ্গে সিনেমা দেখা, রান্না করা, জাদুঘর, পার্ক, বা শহরের বাইরে বেড়াতে যাওয়ার মতো নানা বিষয় উপেক্ষিত হলে শিশুমনে যে শূন্যতা তৈরি হয়, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। যদিও এখন সেই শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে ‘ডিজিটাল দুনিয়া’। বাড়ছে মোবাইল ফোনে আসক্ত শিশু ও কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা। মা-বাবা, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিশুর অন্য নিকটজনদের মধ্যে ছোটদের মোবাইল আসক্তি নিয়ে উদ্বেগ যথেষ্ট বাড়ছে। সেই আসক্তির ‘লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা’ও যে হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু অনলাইনে পড়াশোনার বাধ্যবাধকতা বা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে বহু ক্ষেত্রেই সে চেষ্টা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। বরং বাড়ছে একাকিত্ব, জেদ আর নানা ধরনের ভোগ্যপণ্য ব্যবহারের জন্য মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা। সেই চাহিদা মেটাতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা হচ্ছে বহু অভিভাবকের।
সরকারি স্কুলের নড়বড়ে পরিকাঠামোর জন্য অভিভাবকদের একটা বড় অংশ এখন বেসরকারি স্কুলগুলির উপর আস্থা রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। মা-বাবারা নিজেদের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী স্কুল নির্বাচন করে সন্তানের পড়াশোনা ব্যবস্থা করেন। ছেলেমেয়ের ‘কেরিয়ার’ গড়ে দেওয়ার জন্য তাঁদের এই প্রচেষ্টার সঙ্গত কারণও রয়েছে। তাঁরা জানেন, ভাল করে লেখাপড়া শেখাতে না পারলে জীবন যুদ্ধে জয়লাভ করাটা সন্তানদের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠবে। কিন্তু শৈশবের স্বাভাবিক চাহিদাগুলিকে অপূর্ণ রেখে কেরিয়ার গড়ার কাজটা কি সঠিক ভাবে করা সম্ভব? ছোটরা কি সারা দিন নিজেদের পড়াশোনা আর মোবাইল ফোন নিয়েই সময় কাটাতে বাধ্য হবে? খেলাধুলা, বন্ধুবান্ধব, প্রকৃতি ছাড়াও আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া থেকে দূরত্ব তৈরি হলে, এক ধরনের যান্ত্রিকতা জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। এই সত্যটা আমরা কবে উপলব্ধি করব? জীবন মানে কি শুধুই ভাল উপার্জন করে বেঁচে থাকা? স্কুলজীবনই যে মানবিক গুণগুলিকে আয়ত্ত করার উপযুক্ত সময়, এই সহজ কথাটি আমরা ভুলে যাই কী করে?
সুশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। শিশুমন না বুঝলে যে শিশুদের গড়ার কাজটা কোনও দিনই সুন্দর ভাবে করা সম্ভব নয়, এই সত্যটাকে এড়িয়ে গিয়ে সাফল্য পাওয়া কঠিন। তাই এ বার থেকে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদের উদ্দেশে কিছু ‘হোমওয়ার্ক’ দেওয়া শুরু হোক। নৈকট্য বাড়ুক বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের। আসলে ছোটদের গড়ে তোলার কাজটা মা-বাবা বা স্কুল, কারও একার নয়। সকলের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। দেখা যাক, ‘অন্য ছুটি’র এই উদ্যোগে আমরা কত জন নিজেকে যুক্ত করতে পারি।
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
দারিদ্র কম?
সম্পাদকীয় ‘সত্য ও পরিসংখ্যান’ (১৮-৬)-এর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। বিশ্বব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১১-১২ সালের তুলনায় ২০২২-২৩ সালে ভারতের চরম দারিদ্র ২৭.১% থেকে কমে ৫.৩% হয়েছে। নিঃসন্দেহে সুখবর। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে। দারিদ্র দূরীকরণের প্রশ্নে মূল বাধা হচ্ছে বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, নিয়ন্ত্রণহীন জনসংখ্যা ও শিল্পের রুগ্ণতা। বর্তমানে এই সমস্ত ক্ষেত্রের সব সূচকই ঊর্ধ্বমুখী। পেট্রল-ডিজ়েল-রান্নার গ্যাস’সহ সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। এক জন মানুষের সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকার জন্য প্রতি দিন যে পরিমাণ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন, আমাদের দেশে এক লক্ষণীয় সংখ্যক প্রান্তিক মানুষের সেই খাদ্য জোগাড় করার মতো সামর্থ্য নেই। সেই জন্যই বিশ্ব ক্ষুধার সূচকে আমাদের স্থান ১২৭টি দেশের মধ্যে ১০৫তম।
গ্রামীণ ভারতে কৃষিতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপটে ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ার ফলে ছোট কৃষকেরা পরিযায়ী শ্রমিকের পেশা বেছে নিচ্ছেন। অন্য দিকে, শিল্প উৎপাদনের হারও আশাব্যঞ্জক নয়। কোনও বড় ধরনের বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। উল্লিখিত সময়কালের মধ্যেই সম্পদের সুষম বণ্টনের পরিবর্তে সবচেয়ে বেশি সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছে সামান্য কয়েকটি শিল্প গোষ্ঠীর হাতে। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী ভারতের চরম দারিদ্রের হার নিম্নমুখী হয় কী করে? সরকারের উচিত সংখ্যাতত্ত্বের মোড়কে দারিদ্রের প্রকৃত চিত্রকে আড়াল না করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে দারিদ্রহীন ভারত গড়ে তোলার কাজকে ত্বরান্বিত করা।
শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)