অনিমিখ পাত্রের ‘কঠোর বিকল্পের পরিশ্রম নেই?’ (২৬-৮) প্রবন্ধের শিরোনামটিই তীব্র শ্লেষাত্মক এবং বাস্তবোচিত। প্রবন্ধটি রাজ্যের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার করুণ চিত্রটি তুলে ধরেছে। আজ থেকে প্রায় ১৭৫ বছর আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বল্পসংখ্যক মানুষকে নিয়ে প্রবল বাধার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এ দেশের আধুনিক শিক্ষা গড়ে তোলার জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন, অর্থ সংগ্রহ করেছেন, অর্থবান মানুষদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন জমি দান করার অনুরোধ নিয়ে। সেই পথ ধরেই এ দেশের আধুনিক শিক্ষার ভিত্তিটা তৈরি হয়েছিল। স্বাধীন দেশের উন্নতির বনিয়াদ গড়ে উঠেছিল সে দিনেরই আলোর মানুষদের কঠোর পরিশ্রমে। আজকের আমলা-নির্ভর শিক্ষা-কাঠামো শিক্ষার অভিমুখটাকে দাঁড় করিয়েছে সরকারি ব্যবস্থাকে ভেঙে কর্পোরেট শিক্ষা-বাজার তৈরি করার দিকে।
লেখক ঠিকই প্রশ্ন তুলেছেন যে, গত দশ-পনেরো বছরে কী এমন ঘটল যে এমন ত্রাহি ত্রাহি রব উঠল চতুর্দিকে! আসলে সরকারি পরিবহণ, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেসরকারিকরণের মতো বেসরকারি স্কুলও গজিয়ে উঠছে গ্রামে-শহরে। প্রশাসনিক ব্যক্তিদের পরিশ্রমহীন বিকল্পের ভাবনার কারণে সরকারি স্কুলগুলি ধুঁকছে। পুরাতন জমিদারের বসতবাড়ির মতো রাজ্যে হাজারো স্কুল ছাত্রস্বল্পতায় ভুগছে নজরদারির অভাবে। প্রশাসনও হয়তো সুযোগ খুঁজছে, কী করে স্কুলের জমিগুলিকে হস্তগত করে বেসরকারিকরণের পথ খুলে দেওয়া যায়। তবে এর শুরুটা হয়েছিল তারও অনেক আগে, পূর্বতন সরকারের জমানায়। যখন সরকারি স্কুলে ইংরেজি ও পাশ-ফেল তুলে দেওয়া হয়। সে দিন ব্যাঙের ছাতার মতো ইংরেজি মাধ্যম স্কুল গজিয়ে উঠেছিল। ইংরেজি ও পাশ-ফেলহীন সরকারি স্কুল থেকে ব্যর্থমনোরথ ছাত্ররা ভিড় করেছিল হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বেসরকারি স্কুলগুলোতে। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত শিক্ষা পরিচালন সংস্থাগুলিকে ভেঙে দিয়ে সে দিনও এই বিকল্প সাজিয়েছিলেন প্রশাসন ও কর্তাব্যক্তিরা। আজ সেই ভাবনা ও কাজের বহরটা বেড়েছে। আসল কথা, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে অকার্যকর না করলে যে খোলা যাবে না কর্পোরেট শিক্ষা-বাজার!
তপন চক্রবর্তী, কলকাতা-৩৪
অজ্ঞানতা
সুমন কল্যাণ মৌলিকের লেখা ‘রানা প্রতাপের হার-জিত’ (২৮-৮) শীর্ষক প্রবন্ধ সম্পর্কে কিছু কথা। আধুনিক ইতিহাসচর্চায় দক্ষিণপন্থীদের দ্বারা ইতিহাসবিকৃতি নতুন কিছু নয়। তবে, আজকের দিনে এই বিকৃত ইতিহাসের প্রচার অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা সাধারণ মানুষের জনজীবনে ধর্মীয় বিভেদ ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। সমাজমাধ্যমে এখন মানুষ অবলীলায় তাঁদের জানা তথাকথিত ‘ইতিহাস’ নিয়ে গুরুগম্ভীর মন্তব্য পেশ করছেন এবং সাধারণ মানুষ তা সারল্যের সঙ্গে গ্রহণ করছেন। অন্য দিকে, প্রকৃত ইতিহাসবিদরা কঠোর পরিশ্রম করে অতীতের বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে প্রকৃত তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাস ব্যাখ্যা করছেন, যা এখন মানুষ তাকিয়েও দেখেন না।
কিছু দিন আগেই অষ্টম শ্রেণির কিছু ইতিহাসের বইয়ে একটি সময়কালকে বলা হয়েছে ‘অন্ধকার যুগ’। এই সম্বোধন ভিত্তিহীন এবং মুসলমানদের বিদেশি প্রতিপন্ন করার একটি পন্থা। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বলেছেন, আগত মুসলমানরা ভারতকেই তাঁদের বাসস্থান বানিয়ে এখানকার সাধারণ মানুষের সামাজিক জীবনের সুখদুঃখ ভাগ করে নিয়েছেন। এই মেলামেশা থেকে বিকশিত হয়েছে নতুন শিল্প ও সংস্কৃতি, যা বিশেষ ভাবে ভারতীয়। তিনি মন্তব্য করেন যে, মোগল রাজারা দেশকে একীভূত করেছিলেন এবং সর্বাত্মক উন্নতির একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। নেতাজি আরও বলেন যে, ভারতে আগতদের মধ্যে ব্রিটিশরাই প্রথম এবং একমাত্র ব্যতিক্রম, যারা এ দেশের সঙ্গে মিশে না গিয়ে গোটা দেশটিকে পুরোপুরি অধিকার করতে চেয়েছে। দেশনায়কের মতে, মোগলদের পর ব্রিটিশ শাসনেই কিন্তু ভারতীয় জনগণ প্রথম বারের জন্য অনুভব করতে শুরু করেছিল যে তারা সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে কেমন বিজাতীয় আধিপত্যের শিকার।
ইতিহাসবিদ রাম শরণ শর্মা আব্দুল ওয়াহাব মাহমুদ স্মারক বক্তৃতায় বলেন যে, এই মধ্যযুগেই হিন্দু সংস্কৃতির সর্বাপেক্ষা বিবর্তনের চিহ্ন মেলে। কাশ্মীর থেকে সে সময় বহু অমূল্য নথি পাওয়া যায়, বাংলার স্বতন্ত্র উদ্ভব ঘটে সুলতানি ও মোগল আমলে। মধ্যযুগেই পশ্চিম ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি জৈন নথি পাওয়া যায়। এই নথিগুলি পাওয়া না গেলে হিন্দু নবজাগরণ সম্ভব হত না। বিমলকৃষ্ণ মতিলালও এ বিষয়ে গভীর চর্চা করেন। সুতরাং সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের আলোয় এই কালপর্ব ভারত-ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায় রূপেই উদ্ভাসিত হয়।
ভারতের ইতিহাস প্রসঙ্গে আরও নানা রকম অসঙ্গতি লক্ষণীয়। তা সে আর্য সমস্যা নিয়েই হোক, বা আধুনিক ভারতে জাতীয়তাবাদের যথার্থ চরিত্র নিয়েই। আজ যখন দেশের অগ্রণী নেতাদের বলতে শুনি প্রাচীন ভারতে উড়োজাহাজ ছিল বা প্লাস্টিক সার্জারির প্রচলন ছিল; অথবা দেশের মন্ত্রীদের বলতে শুনি হনুমান নাকি প্রথম মহাকাশযাত্রা করেছিলেন, তখন দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র বসু বা পণ্ডিত নেহরুর মতো প্রগতিশীল নেতাদের অভাব বিশেষ ভাবে অনুভব করি।
প্রয়াস মজুমদার, কলকাতা-৩৪
বিচার নেই?
‘বাক্যের শক্তি’ (২৪-৮) শীর্ষক সম্পাদকীয়টি শুরু হয়েছে শিব ও পার্বতীর কথোপকথন দিয়ে। এই কথোপকথনের মাধ্যমে বোঝা যায় যে হত্যাকারী বা পরসম্পদ-হরণকারীরা যেমন স্বর্গে যাওয়ার অধিকারী নয়, তেমনই রূঢ়ভাষীরাও স্বর্গে যাওয়ার অধিকারী নয়। অর্থাৎ, মূল কথা, উভয়েই সমান অন্যায় বা পাপের অধিকারী। এ বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
হত্যাকারী বা পরসম্পদ-হরণকারীরা ধরা পড়লে শাস্তি পায়। আগেকার দিনে রাজার হাতে অনেক সময়ই এই ধরনের অন্যায়কারীদের কঠোর শাস্তি পেতে হত। আধুনিক বিচারব্যবস্থায় তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধী শাস্তি পায়, কিন্তু রূঢ়ভাষীদের শাস্তি হয় কি? কঠিন বাক্য যার প্রতি প্রয়োগ করা হয় তার জীবন তছনছ হয়ে যায় অনেক সময়, দিনের পর দিন বাক্যের বেত্রাঘাত সহ্য করতে না পেরে সে আত্মহননের পথে চলে যেতে পারে, অথবা অবসাদের শিকার হয়। বাস্তবে দেখা যায়, যাঁরা বাক্যবাণের দ্বারা আঘাত করেন তাঁরা তাঁদের খুব কাছের লোক। যাঁর বা যাঁদের কারণে এই সব মানুষের এই পরিণতি হয়, তাঁদের কোনও শাস্তি হয় না।
অনেক আত্মগর্বিত মানুষ উচ্চকণ্ঠে বলেন, তিনি সত্যি কথা বলতে ভয় পান না। কিন্তু যে সত্য কথা সকলের মনে আঘাত করবে, সেই সত্য কথা কি না বললেই নয়? অথবা সেটা বলারও একটা ধরন থাকে— সেটাই হল শিষ্টাচার, বা কাছের মানুষের প্রতি ভালবাসা। কোনও কোনও মানুষ অন্যকে আঘাত দিয়ে কথা বলে বা অপমান করে আনন্দ পান। এই ধরনের মানুষেরা সাংসারিক জীবনে চরম অশান্তি ডেকে আনেন। আর বর্তমান সমাজে তো রাজনৈতিক নেতাদের মুখে কুবাক্য, কুকথার স্রোত বয়ে যায়, যার কোনও শাস্তিই নেই। এর প্রভাব পড়ছে সমগ্র সমাজে, সমাজ যেন ক্রমশ ক্ষিপ্ত, নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে।
বহু শিশুই পরিবারের মধ্যে ছোট থেকে নিষ্ঠুর বাক্যের ব্যবহার দেখছে। পরবর্তী কালে হয়তো সেও অন্যের প্রতি নিষ্ঠুর বাক্য প্রয়োগ করতে পিছপা হবে না। কিন্তু এই তিরস্কারের বেত্রাঘাত থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? সুন্দর ভাবে কথা বলাও একটা ‘আর্ট’ বা শিল্প, যা মানুষকে চৰ্চা করতে হয়।
দেবযানী চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৬
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)