E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: মনুষ্যত্বের প্রমাণ

সব মানুষের মনের জোর, মানসিকতা এক রকম হয় না। কেউ কেউ অতি সংবেদনশীল হন, তাঁরা ঘুরে প্রত্যাঘাত করতে পারেন না।

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:৫১

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ‘মৃত্যুই যখন প্রতিবাদ’ (২৩-৮) পড়ে লজ্জিত হলাম। যখন কোনও লেখাপড়া না জানা মানুষ অপরাধ করে ফেলেন, তখন একটা অজুহাত থাকে যে, তিনি শিক্ষার আলো পাননি, তাই ঠিক-বেঠিক, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করতে পারেননি, অপরাধ করে ফেলেছেন। নীতিবোধ তৈরি হলে এমনটি করতেন না। কিন্তু এই ক্ষেত্রে মূলত যে দু’জনের বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার)-এর প্রয়াত তরুণ গবেষক অনমিত্র রায়ের অভিযোগ ছিল, তাঁরা যথেষ্ট শিক্ষিত, সে-হেতু ন্যায়-অন্যায়ের বোধটি তাঁদের খুব ভালই থাকার কথা। তবু তাঁরা সংবেদনশীল ছেলেটিকে উত্ত্যক্ত করেছেন, মানসিক নির্যাতন করেছেন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, অন্য ছেলেরাও তো ওই একই সিস্টেমের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা সবাই তো আত্মহনন করছেন না। এখানে বলা প্রয়োজন, সব মানুষের মনের জোর, মানসিকতা এক রকম হয় না। কেউ কেউ অতি সংবেদনশীল হন, তাঁরা ঘুরে প্রত্যাঘাত করতে পারেন না। তবে অনমিত্র কিন্তু এ ক্ষেত্রে চুপ থাকেননি, তিনি ‘অ্যান্টি র‌্যাগিং কমিটি’র কাছে চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যার কোনও সমাধান হয়নি। গাইড পক্ষপাত করেছেন, সিনিয়র মাতব্বরি করেছেন। তাঁরা এক বারও ভাবেননি তাঁদের অসহযোগিতামূলক আচরণ একটি অতি সংবেদনশীল মানুষকে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

অথচ, তাঁরা তরুণটির সঙ্গে অনেক দিন কাটিয়েছেন, তাঁর স্বভাব, তাঁর দুর্বলতা— সবই জানতেন, তা হলে একটু মানবিক হওয়া কি যেত না? এই রকম উচ্চশিক্ষার আদৌ কোনও দাম আছে কি, যাতে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায় না, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় না? এক জন বাকিদের থেকে একটু আলাদা হলেই তাঁকে নিয়ে নির্মম আমোদ করতেই হবে? আমরা কেউই সম্পূর্ণ নিখুঁত নই, প্রত্যেকের কিছু না কিছু খামতি আছে। তা হলে কেন ওই অতি সংবেদনশীল তরুণটির কথা শোনা হল না? একটি তরুণ তাজা প্রাণ, যিনি সমাজকে অনেক কিছু দিতে পারতেন আগামী দিনে, তিনি জীবন অসম্পূর্ণ করে চলে গেলেন। এর দায় আমাদের প্রত্যেকের। এই ভুল থেকেই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। আঘাত করে নয়, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে নিজেদের মনুষ্যত্বকে প্রমাণ করতে হবে।

সর্বানী গুপ্ত, বড়জোড়া, বাঁকুড়া

যন্ত্রণাবিদ্ধ

‘মৃতেরা এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনো’ জীবনানন্দ দাশ-এর বিখ্যাত পঙ্‌ক্তিটি মনে পড়ল ‘মৃত্যুই যখন প্রতিবাদ’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে। ‘কখন মরণ আসে’ কেউ জানে না। কিন্তু, কখনও কখনও মৃত্যুকে আহ্বান করা হয় একান্ত-আপন সুহৃদের মতো, যার কাছে সঁপে দেওয়া যায় নশ্বর জীবন। বেঁচে থাকাটা যখন অপমানের জ্বালায় নিরন্তর দগ্ধ হয়, তখন একাকী সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যার সাম্প্রতিক উদাহরণ অনমিত্র রায় নামে আইসার-এর এক গবেষক ছাত্র, যিনি প্রাক্-মৃত্যু পর্বে সমাজমাধ্যমে এক দীর্ঘ পোস্ট করেন, যাতে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ ছিল তাঁর ‘অ্যান্টি র‌্যাগিং কমিটি’র কাছে দায়ের করা অভিযোগের কথা, তাঁর সতীর্থ কর্তৃক প্রতিনিয়ত মানসিক ভাবে আক্রান্ত হওয়ার কথা। বিষয়টি তাঁর সুপারভাইজ়ার এবং আইসার কর্তৃপক্ষ জানলেও কোনও ব্যবস্থা করেননি। সংবাদ সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে এই আইসারেই এক জন ছাত্রের দেহ পাওয়া গিয়েছিল আবাসনের শৌচাগারে, ২০২২ সালের এপ্রিলে মিলেছিল এক পিএইচ ডি ছাত্রের মৃতদেহও, মিলেছিল তাঁর সুইসাইড নোটও। এই ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের এক গবেষণা-গাইডের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। এ বার অনমিত্রের মৃত্যু নিয়ে সরব হয়েছেন সেখানকার শিক্ষার্থীরা।

নির্যাতনের জন্য কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হলেও যখন দোষীর বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হয় না, তখন অনেক ক্ষেত্রেই নির্যাতিত নিজেকে এই পৃথিবীর পক্ষে অনুপযুক্ত বলে মনে করেন। হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের রোহিত ভেমুলা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে জাতপাত এবং বর্ণ-বৈষম্যের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এই গবেষকের আত্মহননের পরও শিক্ষা হয়নি দেশের নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর। প্রশ্ন জাগে, তথাকথিত সাধারণ ছাত্রদের থেকে একটু ভিন্ন প্রকৃতির হলেই কি তাঁকে মানসিক নিপীড়ন সইতে হবে?

কোনও স্মরণসভা, মোমবাতি মিছিল, গান, কবিতার মাধ্যমে অনমিত্রদের ফিরিয়ে আনা যায় না, ভবিষ্যতেও যাবে না। অনমিত্রদের আত্মহননকে এক মুহূর্তের আবেগ বলে উড়িয়ে দিলে মনুষ্যত্বের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।

ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫

ভণ্ডামি

বিগত কয়েক বছর ধরেই দুর্গাপুজো উপলক্ষে কয়েক হাজার পুজো কমিটিকে অনুদান দিয়ে আসছে রাজ্য সরকার। দশ হাজার টাকা থেকে বেড়ে সেই অনুদানের অঙ্ক এখন দাঁড়িয়েছে এক লক্ষ দশ হাজার টাকায়। প্রথম থেকেই এই অনৈতিক অনুদানের সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকেই। তাঁদের যুক্তি ছিল, টাকার অভাবে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো না থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা যখন ধুঁকছে, বিদ্যালয়গুলিতে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর অভাবে স্কুল শিক্ষার মান একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, মিড-ডে মিলে নাবালক ছাত্রছাত্রীরা একটু পুষ্টিকর খাবার পাওয়ার আশায় উন্মুখ হয়ে থাকলেও সরকারি টাকার অপ্রতুলতায় ও ঔদাসীন্যে কোনও মতে খাবারটুকু গলাধঃকরণ করতে বাধ্য হচ্ছে, সেখানে জনগণের দেওয়া কয়েক কোটি করের টাকা প্রতি বছর পুজো কমিটিগুলির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।

প্রশ্ন হল, ক্ষমতার জোরে সরকারি অর্থের এই অপব্যয় আর কত দিন চলবে? অথচ, এই অর্থ পরিকল্পনামাফিক নাগরিক জীবনের কল্যাণ সাধনে ব্যয় করা হলে কিছুটা হলেও নাগরিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আসত। গ্রামের তো বটেই, শহরের রাস্তাগুলির কিছুটা হাল ফেরানো যেত, সরকারি স্কুলগুলিতে পরিকাঠামোগত সংস্কার করে ছাত্রছাত্রীদের ফিরিয়ে আনা যেত। কিন্তু ক্ষমতা অতি বিষম বস্তু। আশ্চর্য এই যে, শাসক দলের সমর্থকরা এমনও দাবি করেন যে, পুজোয় এই পরিমাণ অনুদান দিয়ে সরকার নাকি জনগণের করের টাকা পুজো কমিটিগুলির মাধ্যমে সমাজকল্যাণমূলক কাজে খরচ করে। এ যুক্তি বেজায় হাস্যকর। নাগরিক সমাজের জন্য সরকারি অর্থে জনকল্যাণমূলক কাজ করার দায়িত্ব সরকারি কর্মীদের। পুজো কমিটিগুলির উপরে সেই দায়িত্ব বর্তাবে কেন? কোনও পুজো কমিটি যদি প্রকৃতই নিজেদের অঞ্চলে জনকল্যাণমূলক কাজ করতে ইচ্ছুক হয়, তা হলে তারা তাদের সংগৃহীত অর্থেই সেই কাজ করতে পারে। তার জন্য সরকারি অনুদানের মুখাপেক্ষী হতে হবে না।

সমীর কুমার ঘোষ, কলকাতা-৬৫

পুজো-অর্থনীতি

দুর্গাপুজো আজ কেবল ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসব নয়, এটি বাংলার অর্থনীতির অন্যতম শক্তি। ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রাপ্তির পর থেকে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুজো গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছে। কোটি কোটি টাকার বাজেট, স্পনসরশিপ, পর্যটন শিল্পের বিকাশ— সব মিলিয়ে পুজো এখন প্রায় একটি ক্ষুদ্র শিল্পের মতো। কলকাতার অর্থনীতিতে শুধু শারদোৎসবের বাজারেই কয়েক লক্ষ মানুষের অস্থায়ী কর্মসংস্থান হয়। আলোকসজ্জা থেকে শুরু করে প্যান্ডেলশিল্প, রংমিস্ত্রি থেকে কাপড়ের দোকান— প্রত্যেকেই এর সুফল পায়।

তবে আমার প্রশ্ন এইখানেই— অর্থনীতির চাপে কি আমরা উৎসবের আত্মাকে বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছি? আজকাল অনেক প্যান্ডেলই হয়ে উঠছে কেবল ব্র্যান্ড প্রচারের মঞ্চ। দেবী আরাধনার ভক্তি, শিল্পীদের সৃজনশীলতা ও পাড়ার মিলনের আবহ কোথাও কোথাও ম্লান হয়ে যাচ্ছে। পুজো যদি শুধু টাকার হিসেবেই বাঁধা পড়ে, তবে তা শেষ পর্যন্ত আর উৎসব থাকবে না, হয়ে উঠবে নিছক বাণিজ্য।

দুর্গাপুজো বাংলার গর্ব। তাই এর সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তিকে স্বীকার করেও আমাদের মনে রাখতে হবে— এই উৎসবের আসল ভিত্তি হল তার মিলনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। তাই অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গে পুজোর সাংস্কৃতিক দিকটিকেও সমান গুরুত্ব দেওয়াই হবে সময়ের প্রকৃত দাবি।

ইন্দ্রনারায়ণ মণ্ডল, কোটাসুর, বীরভূম

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Society Social Duties

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy