E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: সম্প্রীতির আশা বুনি

বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার এই দাপাদাপির দিনে ‘সেকুলার’ ভাবধারা বহনকে সমাজে ঘৃণার চোখে দেখা হচ্ছে।

শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০২৫ ০৬:২৩
Share
Save

সেমন্তী ঘোষের ‘এখনও যদি না পারি,’ (২৫-৪) প্রবন্ধটি পড়ে স্তব্ধ হয়ে রইলাম। পহেলগাম পরবর্তী পরিস্থিতির অভিঘাত আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের ভিতকে কী ভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছে, তার উপর তীক্ষ্ণ আলো ফেলেছেন প্রবন্ধকার।

আমরা যারা ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী বিলীয়মান নাগরিকের দল, তাদের অসহায়তা এই লেখায় বাস্তবসম্মত ভাবে হাজির হয়েছে। বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার এই দাপাদাপির দিনে ‘সেকুলার’ ভাবধারা বহনকে সমাজে ঘৃণার চোখে দেখা হচ্ছে। যেন ধর্মনিরপেক্ষ কথাবার্তা বলা কোনও অন্যায় কাজের মতোই, যেন তাতে দেশপ্রেমের উপযুক্ত অনুপান মেশানো নেই। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির কথা ভয়ার্ত গলায় উচ্চারণ করতে হচ্ছে। অথচ আমরা কেউ স্থির হয়ে ভাবছি না, ভাবতে চাইছিও না, আসলে সন্ত্রাসবাদীরা ঠিক এই বিভাজনটাকেই গাঢ় করে আমাদের দেশকে পঙ্গু করতে চায়। জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে যে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতা-উত্তর সেই আলোড়িত সময়ে, আজ তার থেকে আমরা অনেকখানি সরে এসেছি। তাই আজ যাঁরা সাহস করে বলতে চাইছেন মুসলিম বা কাশ্মীরিরা সকলে খারাপ নন, তাঁরা আমার আপনার মতোই খেটে খাওয়া, হাসি-কান্নার দোলাচলে থাকা দোষ গুণে ভরা মানুষ। কিন্তু দেশদ্রোহী তকমা জুটছে তাঁদের।

অন্য প্রদেশের কথা জানা নেই, কিন্তু আমাদের এই বাংলায় সাম্প্রতিক কালে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার মানুষজনকে সমাজমাধ্যম বা অন্য মঞ্চে আক্রমণ করা যেন দস্তুর হয়ে উঠেছে। ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি আজ বিপন্ন। যেন সন্ত্রাসবাদীদের এই মানবনিধন যজ্ঞে সেও এক জন ঋত্বিক। সেও যেন এই যৌথ পাপের অংশীদার। এই যন্ত্রণা থেকে বেরোনোর পথ সে জানে না। তাই এই আন্দোলিত সময়ে এই লেখা কিছুটা বৃষ্টির ছাঁটের মতো এসে পড়ল। এই সন্ত্রস্ত সময়ে আর এক বার ‘আমি ধর্মনিরপেক্ষ’ উচ্চারণের সাহস মিলল। পরের প্রজন্মকে আলো দেখানোর কাজ, তাদের সাম্প্রদায়িকতার বিষফল চেনানোর কাজ আমাদের করে যেতেই হবে।

শান্তনু মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৯১

গরলস্রোতে

সেমন্তী ঘোষের ‘এখনও যদি না পারি’ প্রবন্ধের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হয়ে এই পত্র। পহেলগামের হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় ও পরবর্তী কালে সামরিক প্রত্যাঘাতের পরিস্থিতিতে অধিকাংশ ভারতবাসী যে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন তার মাধ্যমে এক ভয়াল মানসিকতা উঠে আসছে। সমাজমাধ্যমে, চায়ের দোকানে বা বাড়ির বৈঠকখানার সাধারণ আড্ডা-তর্কে স্বদেশপ্রেমীরা গর্জে উঠছেন যে ভাষায়, তা যথেষ্ট আশঙ্কার। ধরে নেওয়া হচ্ছে, ওই বিশেষ ধর্মের মানুষ মাত্রেই জঙ্গি এবং ভারতের শত্রু। সমাজমাধ্যম, যা মানুষের মত প্রকাশের এক খোলা জানলা, সেখানে যে সব পোস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে শাসানিও দেওয়া হচ্ছে ভারতে বসবাসকারী বহু নির্দোষ সংখ্যালঘু সম্প্রাদায়ভুক্ত সহনাগরিককে, অকারণে। যাঁরা ধর্মের আফিমে বুঁদ হয়ে, উগ্র জাতীয়তাবাদে প্রমত্ত হয়ে অন্য ধর্মের মানুষটিকে কোণঠাসা করে রাখতে চাইছেন, টেনে দিতে চাইছেন সংখ্যালঘুর জন্য লক্ষ্মণরেখা, তাঁরা ‘সেকু-মাকু’দের আর সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতার আলোকরেখাটিকে বিষনজরে দেখতে বাধ্য। কারণ বিভেদ তো দুই ধর্মে নেই, ভেদের উৎস ধর্মান্ধতায়। দেখে শঙ্কিত হই যে, এই হিংস্র অন্ধতা গ্রাস করছে সাক্ষর নিরক্ষর পণ্ডিত ছাত্র কিশোর বৃদ্ধ নির্বিশেষে এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে। সেই ধর্মান্ধতার গরলস্রোতে কিছু সংবাদমাধ্যম আবার উস্কানি দিচ্ছে।

এই অন্ধতা আমাদের বুঝতে দিচ্ছে না কেন প্রতিবেশী দেশে জঙ্গি আস্তানা বেড়েছে প্রবল ভাবে। কারণটা কোনও বিশেষ ধর্ম নয়, কারণটা প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও অন্য দেশগুলির দীর্ঘকালীন দারিদ্র, অশিক্ষা। জঙ্গি নির্মাতারা সুযোগ নেয় খালি পেটের, জীবনবোধের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত দরিদ্র ফাঁকা মগজে তারা বসায় বিস্ফোরণের পরীক্ষাগার। প্রকৃত ধর্ম মানুষকে পরিত্রাণ দেয় অশুভ বোধ থেকে, আর স্বার্থসিদ্ধির লালসায় কিছু ব্যক্তি মনগড়া ধর্মের কুমন্ত্রণা ঠুসে দেয় নিঃসহায় ভুখা মানুষের মস্তিষ্কে, তাদের অশুভের পথে চালনা করে। যে চালনা করছে সে হিন্দুও নয় মুসলিমও নয়, সে ভারতীয় বা পাকিস্তানিও নয়, সে অমানুষ। আর যে চালিত হচ্ছে সে রাষ্ট্র কর্তৃক দরিদ্র বঞ্চিত এক মানবরোবট।

সংঘর্ষবিরতি হয়েছে। জলযুদ্ধ জারি রয়েছে। এতে হয়তো রাজনৈতিক ভাবে চাপে পড়বে প্রতিবেশী দেশের প্রশাসন। কিন্তু সেই প্রশাসন বা শাসনতন্ত্রের উচ্চপদের নেতা, যাঁরা নিজেদের দেশে জঙ্গি সংগঠনের বিস্তার বন্ধ করতে, প্রতিবেশী দেশের নিরাপত্তাকে অবিঘ্নিত রাখতে চূড়ান্ত ভাবে ব্যর্থ, তাঁদের পাত্রে এতটুকুও জলের টান পড়বে না, এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। আগে থেকে দুই দেশের মধ্যে যদি সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের সেতু রচনা হত, যদি দুই দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি নিবিড় উদ্যোগে সরকারি সহায়তায় ব্যাপ্ত হত অশিক্ষার আঁধার দূরীকরণে, যদি শান্তি ও মূল্যবোধের শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ভাবে পৌঁছে দেওয়া যেত প্রত্যন্ত মানুষের মনে, তা হলে বোধ হয় এই বিষবৃক্ষের জন্মই হত না।

বিদেশি শক্তির অধীনে মাথা নত করে থাকা এক সুবিশাল ভূখণ্ড যে দিন ইতিহাসের পরিহাসে কয়েকটি টুকরো হয়ে স্বাধীনতা নামক সোনার পাথরবাটি পেয়েছিল সে দিন থেকে অশিক্ষা বেকারত্ব দারিদ্র নাছোড় ব্যাধির মতো নিত্যসঙ্গী তাদের। স্বাধীন রাষ্ট্রগুলির নেতারা এত দিন ধরেও সেই ব্যাধি দূর করেননি। ব্যাধি ভুলে থাকতে কেবল রণতূর্যের দামামা শুনিয়েছেন। আজ ভুগছে সেই দেশগুলির সাধারণ নিরপরাধ মানুষ যাঁরা নিজের নিজের ধর্ম পালন করতে চান নিভৃতে, অহিংস পথে।

অনির্বিত মণ্ডল, ইছাপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

দায়িত্ববোধ

সেমন্তী ঘোষের ‘এখনও যদি না পারি’ শীর্ষক প্রবন্ধ নিয়ে কিছু কথা। ধর্মান্ধদের আক্রমণ ও উল্লাসের উপরে উঠে মানবতাবাদ সর্বদাই জয়ী হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। আসলে, ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষাটা পক্ষপাতহীন ভাবে নিজের বাড়ি থেকে শুরু হওয়া প্রয়োজন। মুর্শিদাবাদে দাঙ্গার মধ্যেও দুই ভিন্নধর্মীয় বালকের এক থালায় ভাত খাওয়ার ছবি যেমন আনন্দ দেয়, তেমনই সমাজমাধ্যমে ঘুরতে থাকা ছোট ছোট ছেলের মুখে অন্য ধর্মীদের পোকামাকড়ের মতো পিষে ফেলার কথাবার্তা আমাদের ভাবিত করে। ব্যথিত করে বিভিন্ন ধর্মীয় সভায় আগত পূর্ণবয়স্কদের আক্রোশপূর্ণ পরধর্ম বিদ্বেষ। কিন্তু তাই বলে তো আমরা পাড়ার মোড়ের চাচার দোকানে চা খাওয়া বন্ধ করতে পারি না। ইদ-দুর্গাপুজো এক সঙ্গে কাটানো বন্ধ করতে পারি না। কাশ্মীর যাওয়াও বন্ধ করতে পারি না, কারণ দিনের শেষে কাশ্মীর আমাদের, দেশ আমাদের, ধর্মও আমাদের, মানুষকে রক্ষার দায়িত্বও আমাদের।

সৌম্যদীপ ঘোষ, ঢাকুরিয়া, কলকাতা

আত্মীয়-বন্ধন

‘এখনও যদি না পারি’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলতে চাই— এ কথাটা ঠিক যে, সব মানুষ এক রকম নন। তা না হলে, আমরা কি দেখতাম যে মুর্শিদাবাদে মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ তাঁর হিন্দু প্রতিবেশীর উপর যাতে আঘাত না আসে, সেই বিষয়ে তৎপর রয়েছেন? পহেলগামের ঘটনার সময় দেখলাম, কাশ্মীরের মানুষ পর্যটকদের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে এই মানসিকতাই কাম্য।

হিন্দু-অধ্যুষিত ভারতে হিন্দুরা মুসলিমদের সঙ্গে আন্তরিক ভাবে সহাবস্থান বজায় রাখেন বলেই মুসলিমরা পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা আফগানিস্তানের থেকে ভারতে সুরক্ষিত— সকলেই জানেন। যে কারণে কাশ্মীরের শালের কারবারিরা হিন্দু মহল্লাতে আত্মীয়ের মতো থেকে যান দশকের পর দশক।

দেবাশ্রিত রায়, রানাঘাট, নদিয়া

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Secularism jammu kashmir Pahalgam Terror Attack

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।