‘আলিঙ্গন নিয়ে সিধু অনড়ই’ (২২-৮) শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের প্রেক্ষিতে বলতে চাই, সিধুর এই অনড় মানসিকতায় ভারতবাসী হিসাবে আমি গর্বিত, আপ্লুত এবং অভিভূত। ভারতীয়রা কে কী খাবেন আর কে কী খাবেন না, তা যেমন রাষ্ট্র ঠিক করে দিতে পারে না, তেমনি কে কার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে তা ঠিক করে দেওয়ার অধিকারও রাষ্ট্রের নেই। তবে সেই সম্পর্ক যদি রাষ্ট্রের পক্ষে ক্ষতিকর হয়, তা হলে রাষ্ট্র অবশ্যই তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করবে। পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে আলিঙ্গন করে সিধু রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো কোনও অপরাধ করেছেন বলে আমার মনে হয় না। পরন্তু মনে হয় তিনি যা করেছেন সেটাই স্বাভাবিক। মানুষ আনন্দ উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ কখন ঘটাবে, কোথায় ঘটাবে, তা যদি রাষ্ট্র ঠিক করে দেয়, তা হলে মানুষের নিজস্বতা বা স্বাতন্ত্র্য থাকল কোথায়? ‘‘শিখ তীর্থযাত্রীদের জন্য কর্তারপুর সাহিবের দরজা খুলে যেতে পারে’’— এই সুসংবাদ শুনেই সিধু সেনাপ্রধানকে আলিঙ্গন করেছিলেন। তা যদি নাও হয়, যদি তা সাধারণ সৌজন্যবশতও হয়ে থাকে, তাতেই বা দোষ কোথায়? পাকিস্তানের সেনাপ্রধান বলেই কি সিধুর আলিঙ্গন যথাযথ নয়? পাকিস্তানের কোনও মন্ত্রী, আমলা বা বিখ্যাত মানুষ ভারতীয় সেনাপ্রধানের সঙ্গে সিধুর মতো আচরণ করলে সেই দেশ যদি তার সমালোচনা করে, ভারতবাসী হিসাবে প্রত্যেকের খারাপ লাগবে। বর্তমান ঘটনায় যেমন পাকিস্তানবাসীর মনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শোনা যাচ্ছে সুধীর ওঝা নামে এক আইনজীবী সিধুর বিরুদ্ধে মুজফ্ফরপুরের আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন। আমার মনে হয় সুধীরই রাষ্ট্রদ্রোহী। সিধু দু’দেশের সম্পর্ককে মসৃণ করার দিকে এক ধাপ এগিয়েছেন। সুধীর সেই মহৎ কর্মে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
নারায়ণ চন্দ্র দেবনাথ
ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
না বলা কথা
মৈনাক বিশ্বাস তফসিলি নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল সম্পর্কে অনেক অজানা কথা জানালেও, তিনি কী কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করে অম্বেডকরকে সংবিধান সভায় পাঠিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে নীরব। এই নীরবতা প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের। অম্বেডকরের জীবনীকাররাও এ সম্পর্কে আলোকপাত করতে দ্বিধা করেন। অবিভক্ত বাংলার কয়েক জন তফসিলি বিধায়ক যদি যোগেন্দ্রনাথের উদ্যোগে তাঁকে বাংলার আইনসভা থেকে নির্বাচিত করে সংবিধান সভায় না পাঠাতেন, তা হলে হয়তো ‘সংবিধানের রূপকার’ হিসেবে তাঁকে আমরা চিনতাম না।
তখনকার বোম্বাই অম্বেডকরের রাজনীতির মূল কর্মক্ষেত্র হলেও, কেন বাংলা থেকে তাঁকে সংবিধান সভায় যেতে হল? ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ১৯৪৬-এ দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনে বোম্বাই প্রদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি পরাজিত হন। সারা ভারতে তাঁর দল তফসিলি ফেডারেশন একটি মাত্র আসন পায় বাংলায়। পূর্ববাংলার বাখরগঞ্জ দক্ষিণ (সংরক্ষিত) আসনে জেতেন যোগেন্দ্রনাথ। ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ নামেই যিনি পরিচিত ছিলেন। এই নির্বাচনে স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য সংবিধান সভা গঠনের কথা বলা ছিল। প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যরাই সংবিধান সভার সদস্যদের নির্বাচিত করার অধিকার পান। অম্বেডকর বোম্বাই আইনসভায় পরাজিত হওয়ায় এবং তাঁর দলের শোচনীয় ফলাফলের কারণে তাঁর সংবিধান সভার সদস্য হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়।
দলিত প্রশ্নে কংগ্রেসের সঙ্গে মতবিরোধের কারণেই তিনি কংগ্রেসের সমর্থন পাননি।
অম্বেডকর চেয়েছিলেন বাংলার ইউরোপীয় সদস্যদের ভোটে জিততে। কিন্তু ইউরোপীয় সদস্যরা ভোটদানে বিরত থাকায় তিনি আতান্তরে পড়েন। তিনি জানতেন তফসিলি কংগ্রেস বিধায়করা দলের নির্দেশ অমান্য করে তাঁকে ভোট দেবেন না। হতাশ অম্বেডকরকে যোগেন্দ্রনাথ প্রতিশ্রুতি দেন, যে ভাবেই হোক বাংলা থেকে অম্বেডকরকে তিনি সংবিধান সভায় পাঠাবেন।
১৯৪৬-এ বাংলার আইনসভার নির্বাচনে ৩০টি সংরক্ষিত আসনের ২৬টি আসন দখল করে কংগ্রেস। মাত্র তিনটি আসন পান নির্দলরা। এর মধ্যে প্রমথরঞ্জন ঠাকুর কংগ্রেসের সমর্থনে সংবিধান সভার প্রার্থী হলে সংখ্যা দাঁড়ায় দুই। এঁরা হলেন নগেন্দ্রনারায়ণ রায় ও মুকুন্দবিহারী মল্লিক। এই অবস্থায় ফেডারেশনের একমাত্র সদস্য যোগেন্দ্রনাথের
পক্ষে অম্বেডকরকে জিতিয়ে আনা ছিল অসাধ্যসাধন।
সংবিধান সভার নির্বাচনের তারিখ ঠিক হয় ১৮ জুলাই। অম্বেডকরের পক্ষে প্রস্তাবক হিসেবে যোগেন্দ্রনাথ থাকলেও, সমর্থক হবেন কে? শেষ পর্যন্ত রংপুরের বিধায়ক নগেন্দ্রনারায়ণ রায় অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় এসে মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর করলে প্রার্থী হতে অম্বেডকরের আর কোনও বাধা
রইল না। তিনি যশোহর-খুলনা সংরক্ষিত আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন। ইতিমধ্যে মুকুন্দবিহারী মল্লিক ও টাঙ্গাইলের বিধায়ক গয়ানাথ বিশ্বাস অম্বেডকরকে সমর্থনের কথা জানান। ১৯ জুলাই ফলাফল ঘোষিত হলে দেখা যায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভোট পেয়ে অম্বেডকর নির্বাচিত হয়েছেন।
প্রলয় চক্রবর্তী
কলকাতা-১২৪
মহান নন
মৈনাক বিশ্বাস লিখেছেন, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল আজ বিস্মৃতির অন্ধকারে। তিনি বিস্মৃত নন। তবে মনে রাখার মতো মহান তিনি ছিলেন না। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রতি অনাস্থা আর ঘৃণাই ছিল তাঁর মূল রাজনৈতিক দর্শন। আধুনিক রাষ্ট্রের বহুত্ববাদী বিষয়বস্তুকে গুরুত্ব না দিয়ে, তিনি শুধুমাত্র এই মতবাদকেই প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যে, ব্রিটিশ পরবর্তী ভারতের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো যা-ই হোক না কেন, ঔপনিবেশিক শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্তরাই হবে এ দেশের মূল চালিকাশক্তি, সুতরাং এ দেশে দলিত ও মুসলমানরা শোষিত ও অবহেলিতই থেকে যাবেন। তাই ১৯৪৬ সালে তিনি ঘোষণা করলেন— ‘‘হিন্দুদের আওতায় থাকিয়া ঘৃণিত জীবনযাপনের চেয়ে মুসলমান বা অন্য কোনও জাতির আওতায় স্বাধীন ও সম্মানের সঙ্গে বাস করতে তফসিল জাতিরা বেশি পছন্দ করেন।’’ তিনি এটাও বলেছিলেন যে মুসলমান বা দলিতরা নিজেদের স্বার্থে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতেই পারেন।
আসলে ভারতীয় রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়াদের উদ্ধারকর্তা সেজে নিজের রাজনৈতিক আসন পোক্ত করার যে চলমান ঐতিহ্য রয়েছে, যোগেন্দ্রনাথ ছিলেন তার অন্যতম পুরোধা। নিজের রাজনৈতিক সাধ পূরণের জন্য তিনি মুসলিম লিগে যোগ দিয়েছিলেন এবং প্রাকস্বাধীনতা আমল থেকে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় পর্যন্ত মুসলিম লিগের বদান্যতায় ক্ষমতার স্বাদও পরিপূর্ণ ভাবে আস্বাদন করেছিলেন।
যোগেন্দ্রনাথকে কাছে পেয়ে জিন্নার মস্ত সুবিধা হয়েছিল। এক দিকে তিনি দেখাতে পারলেন, মুসলিম লিগ নিছক সাম্প্রদায়িক দল নয়। যোগেন্দ্রবাবুর মতো হিন্দু নেতা লিগের সঙ্গে আছেন। অন্য দিকে দেশভাগের দর কষাকষিটাও তাঁর পক্ষে সহজ হল। মুসলিম শাসিত পাকিস্তানে নমঃশূদ্র-সহ হিন্দুরা কতটা সম্মান ও স্বাধীনতা পেয়েছিলেন, তা সবাই জানেন। বেগতিক দেখে ‘জান ও মান’ নিয়ে যোগেনবাবু পালিয়ে এলেন। কোথায় পালিয়ে এলেন? যে রাষ্ট্রব্যবস্থার দুঃস্বপ্ন তিনি তাঁর অনুগামীদের দেখিয়েছিলেন, সেই দেশে। তাঁর স্বপ্নের দেশে যে হিন্দু দলিতরা পড়ে রইলেন, তাঁদের কথা আর মনে থাকল না।
এখানে এলেন আবার উদ্ধারকর্তা হয়ে। কিন্তু আর হালে পানি পেলেন না। কিন্তু আমৃত্যু চেষ্টা করেছেন, চার দিকে ছোটাছুটি করে ক্ষমতা ফিরে পেতে। তিনি বিস্মৃতির অন্ধকারে থাকবেন না। কিন্তু যে স্মৃতির মধ্যে থাকবেন, তা মহত্ত্বের পরিচায়ক নয়।
প্রিয়ব্রত মুখোপাধ্যায়
নিকুঞ্জপুর, বাঁকুড়া
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy