এক শিক্ষণীয় বিষয়কে তুলে ধরেছেন যুধাজিৎ দাশগুপ্ত তাঁর ‘যে জীবন ফড়িঙের’ (৮-৬) প্রবন্ধটির মাধ্যমে। পৃথিবীর জীবজগৎ টিকে আছে খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে। খাদ্যশৃঙ্খল বাস্তুতন্ত্রে শক্তি এবং পুষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। যদি খাদ্যশৃঙ্খল থেকে মাত্র একটি উপাদানও সরিয়ে ফেলা হয়, তা হলে এর প্রতিক্রিয়ায় কোনও প্রজাতি বিলুপ্তও হয়ে যেতে পারে। এক দিকে জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে, অন্য দিকে জীবজগতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ছোটবেলায় গ্রামে কত পতঙ্গ দেখেছি। ফড়িং, গঙ্গাফড়িং, মথ, মৌমাছি, প্রজাপতি, গুবরে পোকা ছাড়াও নানা রঙের অসংখ্য নাম-না-জানা পতঙ্গ দেখেছি। রাতের অন্ধকারে গাছে জোনাকির আলো ভারী সুন্দর লাগত। এখন গ্রামে এদের সংখ্যা অনেক কম। কিছু ধরনের পতঙ্গ তো চোখেই পড়ে না। অতিরিক্ত আলোর জন্য লক্ষণীয় ভাবে জোনাকির সংখ্যা কমে গিয়েছে। এই আলো ওদের প্রজনন প্রক্রিয়া নষ্ট করে দিচ্ছে।
উদ্ভিদ জগতের পরাগমিলনের ক্ষেত্রে পতঙ্গের অবদান অসীম। পতঙ্গের কমে যাওয়া বা বিলুপ্তি পরাগমিলনে অসুবিধার সৃষ্টি করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলস্বরূপ হারিয়ে যাচ্ছে শ্যামাপুজো উপলক্ষে আগত শ্যামাপোকা। সবুজ রঙের এই পোকা গায়ে বসলে কুটকুট করে কামড়ায়। বেশ কয়েক বছর ধরেই এদের সংখ্যা কমছিল। গত বছর একেবারে কমে গিয়েছে। ছোটবেলায় আমরা দীপাবলির রাতে সর্ষের তেল ও সলতে দিয়ে মাটির প্রদীপ জ্বালাতাম, আর সকালে দেখতাম প্রদীপটি শ্যামাপোকায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে। মা, কাকিমারা সকালে উঠোন ঝাঁট দেওয়ার পর রাশি রাশি শ্যামাপোকা ফেলতেন। জাপান পতঙ্গ সংরক্ষণের ব্যাপারে অগ্ৰণী। প্রয়োজনে তাদের কাছ থেকে পতঙ্গ সংরক্ষণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া দরকার। আমাদের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে আছে পতঙ্গকুল। তাদের এই পৃথিবীতে সুস্থ ও স্বাভাবিক ভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে আখেরে আমাদেরই লাভ।
গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
বাঁচুক বৈচিত্র
পোকামাকড় কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ মানুষের আগ্রাসী মনোভাব। মানুষ তার আশপাশের ঝোপঝাড়, ফাঁকা জায়গা, ছোট জলা সব গ্রাস করছে নিজের প্রয়োজনে। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে চাইলে প্রথম কাজ হওয়া উচিত সচেতনতা গড়ে তোলা। এবং সেটা বিদ্যালয় স্তরেই শুরু করা উচিত। শহরাঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা প্রায় প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন। ছোটবেলায় তারা নাচ, গান, আবৃত্তি প্রভৃতি অনুশীলন করে। একটু বড় হলেই শুরু হয়ে যায় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার পূর্ব প্রস্তুতি। গ্রামাঞ্চলে সমস্যার প্রকৃতি একটু ভিন্ন। একটি উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। আমাদের বিদ্যালয়ের আশেপাশে আমরা প্রায় তিরিশ প্রজাতির পাখি, পনেরো প্রজাতির প্রজাপতি, আট প্রজাতির ফড়িং-সহ অনেক পোকামাকড় চিহ্নিত করতে পেরেছি। বিদ্যালয় চত্বরকে একটি জীববৈচিত্রপূর্ণ চত্বর হিসাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছে। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও খানিক উৎসাহ সৃষ্টি করা গিয়েছে। অনেকেই হয়তো এই রকম আরও কাজ করছেন। তাঁদের অন্যতম সমস্যা কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা। তার থেকেও বড় সমস্যা সঠিক সংযোগের অভাব। জানা-বোঝার ক্ষেত্রটি প্রসারিত করতে পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র পর্ষদ যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা করে, তা হলে অনেকের সুবিধা হয়।
সৌমেন রায়, শিক্ষক, মেউদিপুর হাই স্কুল
কুকথার স্রোত
সোমা মুখোপাধ্যায়ের ‘কোন অতলের দিকে’ (৭-৬) প্রবন্ধের বক্তব্যের সঙ্গে রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ একমত। এক জন পুলিশ আধিকারিকের প্রতি বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা যে কুরুচিকর ভাষা প্রয়োগ করেছেন, যে ভাবে তাঁকে তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করার পরিবর্তে ছেড়ে রেখে সহনশীলতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে, মনে হয় বীরভূম পুলিশের হাতেও একটি প্রতীকী শিরদাঁড়া তুলে দেওয়া উচিত। অনুব্রত এর আগে প্রকাশ্যে পুলিশকে বোম মারার নিদান দিয়েছিলেন। বিরোধীদের গুড় জল বাতাসা দিয়ে আপ্যায়ন বা ভোটের সময় চড়াম চড়াম ঢাক বাজানোর মতো হেঁয়ালিপূর্ণ কথা বলে প্রচারের আলো শুষে নিয়েছিলেন। গরুপাচার কাণ্ডে সিবিআই-এর হাতে গ্রেফতারি এড়াতে লুকোচুরি খেলতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। তবু তিহাড় যাত্রা ঠেকানো সম্ভব হয়নি। তবে জামিনে ছাড়া পেয়ে সম্প্রতি যে কাণ্ডটি তিনি ঘটিয়েছেন, তাঁর অতীতের সব রেকর্ড ম্লান হয়ে গিয়েছে। কুকথার স্রোত মূল ধারার রাজনীতিতে নতুন নয়। বরং নেগেটিভ পাবলিসিটি অনেক বেশি জনমানসে আলোড়ন তুলতে সক্ষম। বাম জমানায় বিনয় কোঙার বা অনিল বসু অশ্লীল কথা বলেছিলেন ঠিকই, তবে দলের পক্ষ থেকে তৎক্ষণাৎ তা ‘সেন্সর’ করা হয়েছিল। রাজ্যের বর্তমান শাসক দলের কাছ থেকে সেই সৌজন্য আশা করা অন্যায়। তাপস পাল থেকে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, উদয়ন গুহ থেকে অনুব্রত মণ্ডল— সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। এই ঘটনা কেবল জনৈক পুলিশকর্মীর অসম্মান নয়, অসম্মান গোটা বাহিনীর। দলের নেতার হাতে পুলিশের হেনস্থায় পুলিশমন্ত্রীর নিস্পৃহতাও বিস্ময়কর।
রাজশেখর দাশ, কলকাতা-১২২
বিশ্বায়িত
‘কিসের ইন্ডিয়া কিসের হিন্দ্’ (১৩-৬) শীর্ষক প্রবন্ধে বিশ্বজিৎ রায় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে উদ্ধৃত করে বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে যে ভাবে একাধারে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা ও অপরের সঙ্গে ‘সমন্বয়’ সাধনের প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যাখ্যা করেছেন, তার সঙ্গে সহমত। এ প্রসঙ্গে যাঁর কথা সর্বাগ্রে মাথায় আসে, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
পরাধীন ভারতে জীবনধারণের কারণে শাসক ব্রিটিশের প্রতি রাজনৈতিক বিতৃষ্ণা প্রবল মাত্রায় বিদ্যমান থাকলেও ব্রিটেন ও তার সঙ্গে ইউরোপের সাহিত্য পাঠে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে শুধু নিয়োজিতই রাখেননি, ভিক্তর উগো, শেলি, মুর, মিসেস ব্রাউনিং, ক্রিস্টিনা রোসেট্টি, টি এস এলিয়ট এবং জার্মান ভাষায় হাইনরেখ হাইনে ও গ্যোয়টের কিছু লেখার অনুবাদও করেন। আবার, রবীন্দ্রনাথের রচনাও পরবর্তী কালের সাহিত্য-জগতের অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্র অনুবাদ করেছিলেন। অর্থাৎ, পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে স্ব স্ব ভাষায় সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার একটা গঠনমূলক প্ৰয়াস। অন্যের যা ভাল, তা গ্রহণ করতে রবীন্দ্রনাথ কোনও দিনই কোনও সঙ্কীর্ণতার আশ্রয় নেননি। শুধু তা-ই নয়, নির্দ্বিধায় তিনি এ ব্যাপারে ঋণও স্বীকার করেছেন।
সমন্বয়ের উপরোক্ত ধ্যানধারণা তো ছিলই, তার সঙ্গে পরবর্তী কালে যুক্ত হয়েছে ‘গ্লোবালাইজ়েশন’ বা ‘বিশ্বায়ন’-এর নবতম ধারা, যা শুরু হয়েছিল সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর। যদিও তারও অনেক আগে, ১৯৬২ সালে মার্শাল ম্যাকলুহান তাঁর দ্য গুটেনবার্গ গ্যালাক্সি: দ্য মেকিং অব টাইপোগ্রাফিক ম্যান বইতে দেখিয়েছিলেন, দেশ-কাল-ভাষা-জাতি-ধর্ম-আদর্শের পরিধি অতিক্রম করে বিশ্ব কী ভাবে আস্ত একটি গ্রামের চেহারা নিতে চলেছে। সেখানেই তিনি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ শব্দবন্ধটি এবং দেখিয়েছিলেন সেই ‘ভুবনগ্রাম’-এ এক দেশ আর এক দেশের সঙ্গে, এক অঞ্চল আর এক অঞ্চলের সঙ্গে কী ভাবে জোটবদ্ধ। বাস্তবেও দেখা গেল, এই বিশ্বায়নের ফলে জাতীয়তায়, ধর্মে, সংস্কৃতিতে, সমাজ বিকাশের ঐতিহাসিকতায় বিশ্বচৈতন্য যেন একীভূত। এমতাবস্থায়, ‘বহুত্ববোধক বিদ্যাচর্চা’কে দূরে সরিয়ে রেখে অতীতের কিছু সংস্কৃত পাঠ্য বা সাবেক প্রথা অনুসরণ করা কিংবা ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমকে একটা সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রেখে দেওয়াটা কি কোনও কাজের কথা?
গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)